অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসেই হারের মুখ থেকে কোনওক্রমে জিতে ফিরল ভারত। অনভিজ্ঞতার মাশুল গুনল বাংলাদেশ। আর ভারতবাসীর মনে পড়ে গেল চেতন শর্মার বলে জাভেদ মিয়াঁদাদের সেই শেষ বলে ছক্কা হাঁকিয়ে ভারতকে হারানোর স্মৃতি। ১৬৭ রানের টার্গেট। প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ। খাতায় কলমে যারা ভারতের ধারে কাছে আসেনা। তাই হয়তো উড়িয়ে জিতের স্বপ্ন দেখছিল ভারত। ছক্কার পর ছক্কা হাঁকিয়ে বাংলাদেশকে হেলায় হারানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে একের পর এক উইকেট উপহার দিতে থাকে ভারত। যার ফল এদিন কড়ায় গণ্ডায় মেটাতে হল তাদের। ফাইনাল প্রায় হাত ছাড়া হওয়ার অবস্থা থেকে দীনেশ কার্তিকের অবিস্মরণীয় ব্যাটিংয়ে জিত পেল ভারত। ১ বলে ৫ রান করতে হবে। এই অবস্থায় সৌম্য সরকারের বলে ছক্কা হাঁকিয়ে জয় নিশ্চিত করেন দীনেশ।
রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ। রুদ্ধশ্বাস সমাপ্তি। শেষ বলে ম্যাজিক। গোটা মাঠ জুড়ে শ্রীলঙ্কার বাসিন্দাদের ভারতের জন্য গলা ফাটানো। সব মিলিয়ে কলোম্বোর প্রেমদাসা স্টেডিয়াম এদিন সাক্ষী রইল এক দুর্দান্ত খেলার। আর মাত্র ১ বলের ব্যবধানে ইতিহাস অধরা রয়ে গেল বাংলাদেশের। ট্রফি জেতাও হলনা। ভারতকে টি-২০-তে হারাতে না পারার শাপমোচনও হলনা।
টস জিতে এদিন বাংলাদেশকে প্রথমে ব্যাট করতে পাঠান ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা। ব্যাট করতে নেমে শুরুতে পাওয়ার প্লে কাজে লাগাতে তেমন দাপটে ব্যাটিং করতে দেখা যায়নি বাংলাদেশকে। মাঝখান থেকে লিটন দাস (১১) ও তামিম ইকবাল (১৫) দ্রুত ফেরেন। তামিমের ছক্কা হাঁকানোর শট যেভাবে একদম বাউন্ডারি লাইনে ব্যাল্যান্স সামলে ধরে শার্দূল ঠাকুর কামাল দেখান তাতে চমকে যান সকলে। যে ক্যাচ তিনি ধরলেন তা এই প্রতিযোগিতার সেরা ক্যাচ হয়ে রইল। এরপর সৌম্য সরকারও দ্রুত ফেরার পর বাংলাদেশ চাপে পড়ে যায়। সাব্বির রহমান ও মুশফিকুর রহমান উইকেট আঁকড়ে লড়তে থাকেন। তবে রানের গতি অনেক কমে যায়। দলের ৬৮ রানের মাথায় মুশফিকুর ফেরার পর মাহমুদুল্লাহ রানের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করলেও ২১ রান করে ফেরেন তিনি। যদিও সাব্বির রহমান একদিক ধরে রাখেন। রানও তুলতে থাকেন। ম্যাচের শেষ কয়েক ওভারে যেভাবে সাব্বির রহমান মারতে থাকেন তাতে বাংলাদেশের রানের খরা অনেকটা কাটে। সাব্বির ৭৭ রান করে বাংলাদেশকে একটা চ্যালেঞ্জিং স্কোর করার সুযোগ করে দেন। অন্যরা ব্যর্থ হলেও শেষের দিকে মিরাজ বেশ কিছু রান দলের খাতায় যোগ করেন। ২০ ওভারের শেষে বাংলাদেশ ৮ উইকেট হারিয়ে তোলে ১৬৬ রান।
১৬৭ টার্গেটকে সামনে রেখে ব্যাট করতে নেমে প্রথম থেকেই মারমুখী মেজাজে ধরা পড়েন রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ান। পাওয়ার প্লের সম্পূর্ণ সুবিধা ঘরে তুলতে শুরু করেন তাঁরা। সুবিধে হয় বাংলাদেশ প্রথম থেকে স্পিনার দিয়ে বল করানোয়। যদিও রান তোলার তাড়ায় ক্যাচ দিয়ে ফেরেন শিখর (১০)। সুরেশ রায়না ব্যাট হাতে নামেন। কিন্তু লেগের বাইরের বলকে খোঁচা মেরে ০ রানে ফিরতে হয় তাঁকে। এবার চাপে পড়ে যায় ভারত। রোহিতের সঙ্গে জুটি বাঁধেন কেএল রাহুল। কয়েকটা ভাল শট খেললেও রাহুলও ছক্কা হাঁকানোর চেষ্টায় ব্যক্তিগত ২৪ রানের মাথায় ক্যাচ তুলে প্যাভিলিয়নে ফেরেন। এবার রোহিত জুটি বাঁধেন মণীশ পাণ্ডের সঙ্গে। আর এখানেই ম্যাচ অন্য দিকে মোড় নেয়।
বলের সঙ্গে রানের ফারাক বাড়তে থাকে। ক্রমশ চাপ বাড়তে থাকে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের ওপর। আর সেই চাপ যে কতটা ভয়ংকর চেহারা নেয় তা রোহিত শর্মার জোর করে ছক্কা মারতে গিয়ে আউট হওয়া থেকেই পরিস্কার। ব্যক্তিগত ৫৬ রানের মাথায় রোহিত ফেরার পর মণীশ ও বিজয় শঙ্কর জুটি বাঁধেন। কিন্তু এই অবস্থা থেকে খেলা বার করে আনার মত ক্ষমতা যে এঁদের নেই তা এরপর থেকেই প্রমাণ হতে থাকে। ১৮ তম ওভারে মুস্তাফিজুরের বলে যেখানে রানের আশু প্রয়োজন, সেখানে বিজয় শঙ্কর ব্যাট হাতে দেখিয়ে দিলেন কীভাবে একের পর এক বল মিস করে দলকে চাপে ফেলা যায়। এই অবস্থায় মণীশ পাণ্ডে বড় রানের তাগিদে মারতে গিয়ে আউট হন। তখন প্রায় শেষ ভারতের সব আশা। ১২ বলে দরকার ৩৪ রান। যা প্রায় অসম্ভব। এই অবস্থায় ব্যাট হাতে নেমে এবার কামাল দেখানো শুরু করলেন দীনেশ কার্তিক।
ছক্কা, চার, ছক্কা। পরপর ৩ বলে এই ৩টে শট যেন গোটা ম্যাচের চেহারাই বদলে দিল। ৯ বলে দরকার ১৮ রান। খুব কঠিন নয়। এই অবস্থা থেকে ৬ বলে ১২ রান দরকার এই অবস্থায় খেলা গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই অবস্থা থেকে ফের চাপ তৈরি হয়ে যায়। শেষ ওভারের প্রথম ৫ বলে আসে মাত্র ৭ রান। আবার বিজয় শঙ্করের উইকেটও পড়ে। অবস্থা দাঁড়ায় শেষ বলে হয় ভারতকে ছক্কা হাঁকাতে হবে। নতুবা হার। এই অবস্থায় সৌম্য সরকারের অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলে সজোরে শট নেন দীনেশ। যা মাটির কিছুটা উপর দিয়ে তীব্র গতিতে পার করে বাউন্ডারি লাইন। ছক্কা। আর এই ছক্কা হাঁকানোর সঙ্গে সঙ্গে সৌম্য সরকার কেঁদে বসে পড়েন মাঠে।
ভারতীয় শিবির তখন যেন নিজেদের বিশ্বাস করতে পারছে না। এই ম্যাচও তাঁরা জিতেছেন? গোটা দলটা দীনেশ কার্তিকের ওপর গিয়ে কার্যত আনন্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভারতীয় শিবির যখন আনন্দে ভেসে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ শিবিরে কান্নার রোল। মাঠেই কান্নায় ভেঙে পড়েন কেউ কেউ। ইতিহাস যে একটা বলের ব্যবধানে হাতছাড়া হতে পারে তা বোধহয় তাঁরা তখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না।
এদিন ইমার্জিং প্লেয়ার অফ দ্যা ম্যাচ হন চাহল। ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ দীনেশ কার্তিক। ম্যান অফ দ্যা সিরিজ হন ওয়াশিংটন সুন্দর। আর রোহিত শর্মার হাতে ওঠে নিদাহাস ট্রফি।