বছরের বারো মাসে তেরোর বেশি পার্বণে হুল্লোড় বাঙালির জীবনসুধা। বইমেলাও সেই পার্বণের ভিড়ে নিজের মত জায়গা করে নিয়েছে অনেকদিন। বাঙালির পার্বণ মানেই খাওয়া দাওয়া। তাই বইমেলায় রসনা বিলাসের অন্ত নেই। বিশ্বাস হচ্ছে না এই কথা? চলুন তবে সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্ক লাগোয়া প্রাঙ্গণে এই বছর বইমেলার নতুন ঠিকানায়। মেলা চত্বরে ঢুকতেই সার বেঁধে সেজে ওঠা বইয়ের দোকানের ‘ট্র্যাক’ ছাড়িয়ে যদি বইমেলার পেটের ভিতরে ঢুকে পড়েন, আস্তে আস্তে একটা চেনা গন্ধ নাসিকাগহ্বরে এসে ঠেকবে আপনার। আর আপনি যদি খালি পেটে বইমেলায় ঢোকেন, তাহলে সেই গন্ধ আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে এক আলিবাবার আস্তানায়। যে দিকে দুচোখ যাবে, সেদিকেই রাশি রাশি সুগন্ধি খাবারের খাজানা মাতাল করে দেবে আপনার রসনাকে। বিরিয়ানি, পোলাও, মিষ্টি, আইসক্রিম, পেস্ট্রি, লুচি, খিচুড়ি, কি নেই! মনে হবে বুঝি ‘গুপী বাঘা’-র সেই অফুরান খাবারের জাদু হাঁড়ি ‘ফুড প্যাভিলিয়ন’-এর চেহারায় উঠে এসেছে বইমেলায়।
যদিও বইমেলায় বইয়ের পাশাপাশি ঢালাও ভূরিভোজের এই ছবি নতুন কিছু নয়। মিলনমেলায় আয়োজিত বইমেলাতেও আলাদা প্যাভিলিয়নই বরাদ্দ হয় অসংখ্য অস্থায়ী খাবারের দোকানের জন্য। নামী অনামী এই সমস্ত ফুড স্টলের কদর প্রতিবারের মতো এবারেও তুঙ্গে। হাতে গোনা কয়েকটা স্টলে হয়তো বই ক্রেতাদের ভিড় চোখে পড়েছে। তবে ব্যবসার নিরিখে বলতেই হবে ‘লক্ষ্মী অচলা’ বইমেলার খাদ্যবিক্রেতাদের ঘরে।
মেলায় ঘুরতে ঘুরতে যদি তেষ্টায় গলাটা একটু শুকিয়ে ওঠে, তার জন্য আছে চা-কফি-সফট ড্রিংকসের স্টল। সাথে মুখরোচক চটপটা স্ন্যাক্স। সেইসব স্টলে তরুণ তরুণীদের ভিড় চোখে পড়ার মত। অবশ্য বইমেলার যে খাবারের স্টলেই যান, সেখানেই বেলা গড়াতে উপচে পড়েছে খিদেয় কাতর জনতার ঢল। যাঁর মুখে যেমন স্বাদ, সেইমত তাঁরা রসনার তৃপ্তি মেটাতে হামলে পড়েছেন খাবার স্টলগুলিতে। সেখানে মোগলাই চাইলে মোগলাই পাবেন, চাইনিজ চাইলে চাইনিজ। আবার দক্ষিনী খাবারে পেট ভরাতে চাইলে আছে তার ব্যবস্থাও। বাঙালি আবার যেখানেই যায়, সেখানেই খোঁজে বিশুদ্ধ বাঙালি খাবার। সেক্ষেত্রেও নিরাশ হতে হবে না তাঁদের। ভারী খাবারের পর একটু মিষ্টি মুখ নাহলে যেন বাঙালির চলে না। তাই মিষ্টিপ্রেমীদের জন্য কাঁচের বাক্স সাজিয়ে মেলা প্রাঙ্গণে এবার হাজির কলকাতার কিছু সেরা মিষ্টান্ন বিপণি। ঘণ্টা খানেক ধরে বই সাম্রাজ্যর গোলকধাঁধায় ঘুরে যাঁরা ক্লান্ত, তাঁরাও বাড়ি ফেরার আগে সান্ধ্যভোজনটা সেরে গেলেন মেলার ফুড কোর্টেই। মুখরোচক খাবারের স্টলের সামনে শুধুই মাথা আর মাথা। এরই মধ্যে কলেজছাত্রী অঙ্কিতা পাঠকের গলায় শোনা গেল হাহাকারের সুর। কোনোরকমে ফুড কোর্টে রাখা চেয়ারগুলো রীতিমত যুদ্ধ করে দখল করেছে সে ও তার পরিবার। ২ বছর ধরে মেলায় বই কিনতে আসছে অঙ্কিতা। মেলা ছাড়ার আগে এই ফুড কোর্টে এবারেও ঢুঁ মারতে ভোলেনি। অঙ্কিতার মতে, খাবারের মান যাই হোক, পরিবারের সাথে মেলা ঘুরে খাবার খাওয়ার এই আনন্দটাই তো থেকে যায় মনের মণিকোঠায়।
তবে মেলা কয়েকদিন গড়াতেই কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট, প্রতিবারের মত এবারেও খাদ্যপ্রেমীদের অঘোষিত ‘ফুড কার্নিভাল’-এর দাপটের মাশুল দিতে হবে মেলা চত্বরকেই। যতই মেলার অস্থায়ী ‘ফুড কোর্ট’-এ ব্যবস্থা থাকুক ডাস্টবিনের, যতই রোজ তা পরিস্কার করা হোক, বিপুল জনস্রোতের ফেলা বর্জ্যের ঠেলায় ভালোই নাকাল হতে হচ্ছে মেলার আয়োজকদের। তার ওপরে এক জায়গায় এত রকমের খাবারের স্টল। সবমিলিয়ে একটা মিশ্র উগ্র গা গুলিয়ে ওঠা গন্ধে যেন ভরে উঠেছে বইমেলার ফুড কোর্ট, এমন অভিযোগও করতে শোনা গেল মেলা ঘুরতে আসা মানুষজনকে। আবার, ভালো বই কেনার থেকে মেলায় আসা লোকজন তো ছবি তুলছে বেশি আর খাবার খাচ্ছে বেশি। এই অভিযোগের সুরও শোনা গেল কয়েকজন প্রকাশকের গলায়।
৫ টাকা বা ১০ টাকার চা, কফি ২০ টাকা, ৩০ টাকা দাম শুনে ছ্যাঁকা খেয়ে সরে যেত হল কয়েকজন যুবতীকে। ‘বাইরে গিয়ে চল কিছু খেয়েনি। ঠিক দামে পাব’, এই বিশ্বাসেই মেলা প্রাঙ্গণ ছেড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিতে দেখা গেল তাঁদের। তবে মেলার ভিতরে খাবারের দাম তো বেশি হবেই। তারউপরে সল্টলেকের মতো ‘কস্টলি’ জায়গায় মেলা হচ্ছে বলে কথা। তাই অযথা হাত না চেপে একদিন না হয় মন খুলে একটু খরচ করে খাওয়া-দাওয়াই হল। সেই বিশ্বাসেই বইমেলার আনন্দকে ভরপুর চেটে-পুটে নিতে দেখা গেল অধিকাংশজনকে। আর আসছে বছর আবার হবে। অর্থাৎ, বই কেনার পাশাপাশি মেলার ভিতরে গড়ে ওঠা একটুকরো ‘খাদ্য মেলা’-কে ফের জমজমাট করে তুলবেন ভোজনপ্রিয় মানুষ, সেই ইঙ্গিতও পাওয়া গেল বইমেলার নতুন রাজ্যে।