মাথায় লাল রঙের কাগুজে ক্রাউন। খুদে খুদে হাতের আঙুলে ধরা সাদা প্লাস্টিক। খুব একটা ভারী নয় বলেই সে পেয়েছে নতুন বইয়ের প্যাকেট সামলানোর গুরুদায়িত্ব। চঞ্চল খুদে পা দুটোর মতই চঞ্চল একজোড়া চোখ। সেই চোখ মেলা প্রাঙ্গণে খুঁজে চলেছে পছন্দের বইয়ের সম্ভার। সেখানে ঢুকে পড়তে পারলেই হিপ হিপ হুর রে। হ্যারি পটার, ঠাকুরমার ঝুলি, নন্টে ফন্টে, এক ডজন ছোটোদের গল্প। সব কিছুকে একসাথে চোখ দিয়ে গিলতে পারবে গল্পপ্রিয় শিশু। মনের মতো গল্পের বই তো আর বড়দের বইয়ের দোকানে পাওয়া যায় না। আর কলেজ স্ট্রিট বা পাড়ার বইয়ের দোকানেও মেলে না একসাথে এত বইয়ের গন্ধ নেওয়ার সুযোগ। ছুঁয়ে দেখার সুযোগ। উল্টে পড়ার সুযোগ। রাশি রাশি বইয়ের রঙিন মলাটে চোখ বোলাতে প্রতিবছর তাই হাজির হতেই হয় কলকাতা বইমেলায়। লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে। মা বাবা পই পই করে মনে করিয়ে দেন সে কথা। স্কুলের বই পড়ার পাশাপাশি জানা চাই দেশ বিদেশের নানা ঘটনা, নানা গল্পকথা। পরিবারের সাথে খুদেদেরকেও তাই ঢুঁ দিতেই হয় বইয়ের মেলায়।
প্রতিবারের মত এবারেও জমে উঠেছে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। মেলায় রোজ ভিড় জমাচ্ছেন বইপ্রেমী বড়দের দল। তাঁদের সাথে মেলা চত্বরে ইতিউতি চোখে পড়ে মা বাবার হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো ছোট্ট কালো কালো মাথার সারিও। তাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে মেলা চত্বরে প্রতিবারের মত এবারেও বসেছে শিশু সাহিত্যের ঘর। সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্ক সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ডের গা ঘেঁষা বইমেলায় ঢোকার প্রবেশ পথের মুখেই বাঁদিকে চোখ ফেলুন। দেখবেন মেলায় ঢোকার মুখেই উপস্থিত ছোটোদের প্রিয় স্টল। শৈশবের অনেকটা অংশ জুড়ে থাকে ‘কার্টুন’। সেই কার্টুন চরিত্রদের সাথে পরিচয় করাতে স্টল নিয়ে হাজির দোকানিরা। কার্টুনের সেই স্টল চোখে পড়তেই মা-বাবার কাছে আবদার করে উঠছে বাচ্চারা। ‘ওই দোকানটায় যাই চলো’। বাচ্চার আবদার মেটাতে সেই স্টলে হাসিমুখে পা বাড়াচ্ছেন অভিভাবকেরাও।
মেলার সরণী ধরে একটু এগোলেই পড়ে ‘চিত্রলেখা’ স্টল। দোকানে এত ভিড় যে ঠেলে ঢোকা যায় না। সেই ভিড়ের মাঝে সেঁধিয়ে উঁকি দিলেই বোঝা যাবে ভিড়ের কারণ। দোকানের ভিতর থরে থরে সাজানো আঁকার বই। বাচ্চাদের সৃজনশীলতার কথা মাথায় রেখে স্কুলে নার্সারি থেকেই আঁকার ক্লাসের ব্যবস্থা থাকে। অনেক মা বাবাই বাচ্চাদের আবার ভর্তি করিয়ে দেন আঁকার কোচিংয়ে। সেই কথা মাথায় রেখেই ‘চিত্রলেখা’ এবার হাজির আঁকা ও নানা ডিজাইনের পসরা নিয়ে। যা নজর কেড়েছে ৮ থেকে ৮০ সকলের।
আগের বছরগুলোর মত এবারেও বাংলা ও ইংরাজি কিশোর সাহিত্যের সম্ভার নিয়ে মেলায় আসর জমিয়ে বসেছে ‘কিশোর ভারতী’, ‘দেব সাহিত্য কুটির’, ‘ছোটোদের কচিপাতা’, ‘সংহতি প্রকাশনী’, ‘দক্ষ ভারতী’-র মতো নামকরা স্টল। ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরা নাকি বাংলা বই পড়ে না। এমন একটা অভিযোগ প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায় আজকাল। সেই অভিযোগ যে সর্বাংশে সত্যি নয় সে কথার প্রমাণ দিল বইমেলার খুদে অতিথিরাই। তারা একদিকে ‘জাঙ্গল বুক’-এর মোগলি, ‘হ্যারি পটার’-কেও আপন করে নিয়েছে। আবার সেই খুদেদেরই দুহাত ভরে কিনতে দেখা গেল ভূতের গল্প বা ক্ষীরের পুতুলের মত বইও। হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট-এর মত কমিক চরিত্রেরাও ভালোই বাজার দিয়েছে দোকানিদের। গোয়েন্দা বা অ্যাডভেঞ্চারমূলক রচনারও ভালোই বিক্রিবাটা চলছে বলে দাবি বই বিক্রেতাদের। তবে এবারের বইমেলায় ‘ড্রইং বুক’-এর চাহিদা যে মারাত্মক তা এককথায় স্বীকার করলেন শিশু সাহিত্য স্টলের বিক্রেতারাও। আঁকার বই বিক্রি করতে করতে তাঁরাও যে হিমশিম খাচ্ছেন সে কথা লক্ষ্মীলাভে হাস্যমুখ বিক্রেতারা স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করলেন না।
এবারের বইমেলার ঠিকানা নতুন। তার সাজসজ্জাতেও এসেছে নতুনত্বের ছোঁয়া। ফ্রান্স থিম প্যাভিলিয়ন হিসাবে যদি হট টপিক হয় বড়দের কাছে, তাহলে শিশুদের জন্যেও আছে অন্য চমক। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এখন একটাই লক্ষ্য। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সবই হয়ে উঠুক ডিজিটাল। ডিজিটাল বোর্ড বা বইয়ের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ এরমধ্যে চালু হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি স্কুলে। যদিও তা হাতে গোনা। তবু সব স্কুলের ‘ডিজিটাইজেশন’ হওয়া এখন সময়ের অপেক্ষা। আগামী প্রজন্মও বলা ভাল ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে ডিজিটাল শিক্ষা পদ্ধতিতে। মা বাবার ফোন, ট্যাব বা ল্যাপটপ কিংবা বাড়ির কম্পিউটারেই পড়াশোনার অনেক কাজ সেরে নেয় খুদে পড়ুয়ারা। তারা এখন অনেক বেশি স্মার্ট। বই পড়ার থেকে বই চাক্ষুষ করার প্রবণতাও এখন বেশি। সে কথা মাথায় রেখেই মেলা প্রাঙ্গণে হাজির ‘গল্প দাদু ডট কম’। এই স্টলটি এক ডিজিটাল রূপকথার জগত। এখানে বই খুঁজতে গেলে হতাশ হতে হবে আপনাকে। কিন্তু বইয়ের বদলে স্টলে আছে এক অন্য গল্প আসরের দুনিয়া। গল্প দাদুর আসর আজকের ‘হাইটেক’ প্রযুক্তির যুগে বিরল। বাচ্চাকে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর মতো সেই ধৈর্যও আর নেই। তার উপরে রয়েছে পড়াশোনার বিশাল চাপ। স্কুলের পড়া করে গল্পের বই পড়ার সময় কোথায়? তবু বই তো পড়তেই হবে। সেই বই পড়ার দরকার নেই বাচ্চাদের। বরং গল্পকথা শুনে দেখেও শেখা যায় অনেক কিছুই। তাই ‘গল্প দাদু ডট কম’-এর স্টলে রাখা হয়েছে অডিও-ভিস্যুয়াল ব্যবস্থা। কম্পিউটারে এক সুরেলা নারীকণ্ঠ ছোটোদের শুনিয়ে চলেছে গল্প। কানে একবার হেডফোন গুঁজে সেই ডিজিটাল গল্পের দুনিয়ায় ঢুকে পড়লে মন চাইবে না সিট ছেড়ে উঠতে। এমনটাই দাবি ডিজিটাল গল্পের বিক্রেতা একদল তরুণ মুখের।
ছবিতে রামায়ণ, আঁকার বইয়ে প্যাকেট ভর্তি করে বইমেলা ঘুরে খুশি হাওড়ার সালকিয়া থেকে আসা দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র অভিরূপ সাহা। এই বছর প্রথম সে এসেছে মা বাবার সাথে। আসছে বছরও সে আসবে। তার দুষ্টু চাহনি সেই কথার জানান দিল। শুধু অভিরূপই নয়, অভিরূপের মতো আর সব ছোটরাও যে বইমেলার ভাণ্ডার খুঁড়ে বই কিনে খুশি, সে কথা স্পষ্ট হয় গেল তাদের ছটফটে প্রাণবন্ত হাসিমাখা মুখ দেখেই।