বইমেলা বাঙালির মননে, হৃদয়ে। কত মানুষ! তাঁদের কত রকমের পঠন চাহিদা। কত রকম পছন্দ। সব মিলে মিশে বইমেলা মানেই তো এক মিলনোৎসব। সেখানেই কারও কারও ভালোলাগা আর কিঞ্চিত বিরক্তি মিশে গেল বইমেলার এককোণায়। সুর যেমন কোথাও মনের তারগুলোকে জুড়ে একটা মোহময়তা তৈরি করছিল, তেমনই বাড়তি শব্দ তছনছ করে দিচ্ছিল সুরতালছন্দের ভালোলাগাটা। আর সেখানেই বিরক্তি। এবার বইমেলায় সুন্দর করে সেজে উঠেছে জাগো বাংলা স্টল। স্টলের সামনে বিশাল প্রাঙ্গণে গোল করে চেয়ার পাতা। উচ্চওয়াটের বক্স। সেখানে মাঝেমধ্যেই শিল্পীরা আসছেন। গান গাইছেন। সে গান বাজছে ওইসব বক্সে। অনেকেই দাঁড়িয়ে শুনছেন। অন্যদিকে সুবিশাল এবং সুসজ্জিত জাগো বাংলা স্টলের পাশেই রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের পশ্চিমবঙ্গ মণ্ডপের বাইরে পাতা হয়েছে মুক্তমঞ্চ। সেখানে উদীয়মান লোকশিল্পীরা নিজেদের গান মানুষকে গেয়ে শোনানোর সুযোগ পাচ্ছেন। গানের সঙ্গে খান কতক বাদ্যযন্ত্র বাজানোর ব্যবস্থাও রয়েছে। সেখানেও দাঁড় করানো রয়েছে বক্স। এই দুই জায়গাতেই গান শুরু হলে মেলায় হেঁটে চলা মানুষ ক্ষণিকের জন্য দাঁড়াচ্ছেন। শিল্পীদের গান শুনছেন। যা একজন শিল্পীকে বাড়তি অক্সিজেন দেয়। কিন্তু এই শ্রোতাদের মাঝেমধ্যেই হচ্ছে মুশকিল। পাশাপাশি দুই স্টলে একসঙ্গে মাঝেমধ্যেই শুরু হয়ে যাচ্ছে গান। দুই গান মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে শব্দকল্পদ্রুম। শিল্পীরাও মাঝে মধ্যে এই গানের গুঁতোয় মেজাজ হারাচ্ছেন। বিরক্ত হচ্ছেন। গান গাইতে গিয়ে কানে ঢুকছে তীব্র শব্দে অন্যদিকের গান। আর সবচেয়ে বিরক্ত হচ্ছেন কোনও একটি স্টলের সামনে গান শুনতে দাঁড়ানো শ্রোতারা। অন্যপাশের আওয়াজ তাদের চরম বিরক্তির কারণ হচ্ছে। অনেকেই ধ্যুত বলে চলে যাচ্ছেন। হাল্কা হয়ে যাচ্ছে ভিড়। হতাশ হচ্ছেন শিল্পীরা। সকলের সামনে নিজেদের গান তুলে ধরার এ এক বিরাট সুযোগ শিল্পীদের কাছে। একটি মহতী উদ্যোগও। কিন্তু সেই উদ্যোগ এবার মেলাপ্রাঙ্গণে পদে পদে হোঁচট খেল এই ‘গানের লড়াই’তে।
মেলায় এমন প্ল্যাটফর্ম থাকতেও কিন্তু অনেক তরুণ তরুণীকে দেখা গেছে ইতিউতি কয়েকজন মিলে সুর তালে মেতে উঠতে। খানিক আপনমনেই। নিজেদের কথা। নিজেদের সুর। হাতে গিটার। আর উদাত্ত কণ্ঠ। সঙ্গে বন্ধুদের হাততালির দুরন্ত সঙ্গত। খোলা আকাশের নিচে বইমেলার ভিড়ে কোথাও যেন এক উদাস বাউল গেয়ে যাচ্ছে তার গান। কেউ কোথাও নেই। শুধু বন্ধ চোখ আর খোলা কান যেন তাদের সবটুকু প্রেরণা নিংড়ে দিচ্ছে। উৎসাহ দিচ্ছে। কে যেন বলছে, গেয়ে যাও বন্ধু, গেয়ে যাও। গিটার বেজে চলে। গানের শব্দতরঙ্গ বাতাসে মিশে কিছু মানুষকে দোলা দেয়। দাঁড়িয়ে পড়েন তাঁরা। পায়ের সঙ্গে সঙ্গে মনটাও যেন বিশ্রাম পায়। তারুণ্যের এই উদাত্ত কণ্ঠ বুকে জমে থাকা সব কথা গানে গানে বলে যায় আপন খেয়ালে। ওদের বোধহয় প্ল্যাটফর্ম লাগেনা। নিজের ভাল লাগাতেই শুরু, নিজের ভাল লাগাতেই শেষ। মাঝে পাথেয় শুধু কিছু মানুষের ক্ষণিকের তারিফ। বড় ভাল গাইলে ভাই। তোমার গলা আছে। পিঠ চাপড়ে একসময়ে সকলেই মিশে যায় ভিড়ে। এভাবেই একসময়ে সব শান্ত হয়। গিটার হাতে বাড়ি ফেরে তারুণ্য। তবু খালি মাঠে হয়তো কোথাও বাতাসে মিশে থাকে ফেলে যাওয়া সুর। সে সুর নকল করেই পরদিন সকালে কোনও পাখি হয়তো গেয়ে ওঠে ঘুমা ভাঙানি গান। জেগে ওঠে তরুণের দল। গেয়ে ওঠে গান। অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে!