বইমেলায় লোকে কি কিনতে যায়? এই প্রশ্ন শুনে সিংহভাগ মানুষের ঠোঁটের কোণে উঁকি দিয়ে যাবে একটা তির্যক হাসির রেখা। বইমেলা যখন, সেখানে লোকে বই-ই কিনতে যাবে। এটাই তো স্বাভাবিক। যদি এমনটা আপনিও ভেবে থাকেন, তবে পরামর্শ দেব, এমন ভাবনা থেকে দূরে থাকুন। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, বইমেলার অ থেকে ঔ দখল করে থাকে রাশি রাশি বইয়ের পাহাড়। তা বলে বইয়ের মেলায় নিছক বিকিকিনি বইয়েরই চলে না! বিগত বছরগুলোর মত ২০১৮-র কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলাও সেই কথারই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
সল্টলেক করুণাময়ী থেকে কয়েক পা এগোলেই চোখে পড়ে বাঙালির বৃহত্তর বই উৎসবের প্রাঙ্গণ। মেলার পেটের ভিতর ঢুকে পড়লে যে দিকে দু চোখ যায়, চোখ পড়ে অনন্ত বইয়ের স্টলে। নিঃসন্দেহে বইয়ের স্টলের সেই রাজত্বই মেলার মূল আকর্ষণ। সেই রাজত্ব মোটেই একচেটিয়া নয়। মেলার ১ নম্বর গেটের মুখেই বইয়ের স্টলের পাশে নিজেদের সংসার গুছিয়ে বসে পড়েছেন শিল্পীদের ঝাঁক। তাঁদের কেউ কাগজ বা কাপড়ের ক্যানভাসে জলরঙ ছবিতে তুলি টানতে মগ্ন। কেউ ব্যস্ত ধানের শিষে নাম খোদাইয়ের কাজে। কেউ বা দক্ষ হাতে সূচ-সুতো নিয়ে টেবিল ক্লথে সৃষ্টি করে চলেছেন চিত্ররূপময় কারুকাজ। আবার কেউ চোখে দেখে জলজ্যান্ত মানুষের প্রতিকৃতি বানিয়ে চলেছেন একাগ্র চিত্তে। বইয়ের স্টল ঘেঁষে সেজে ওঠা সেই স্বপ্নসুন্দর রঙের দুনিয়া বইপ্রেমীদের বইয়ের সংসারের সদস্য হতে অনবরত হাতছানি দিয়েই চলে। তবে সেই রঙিন দুনিয়াকে নিজের ঘরের চৌকাঠ পার করাতে চাইলে পকেটে ৫০০-২০০০ টাকার রেস্ত থাকতে হবে বইকি।
নারীমহলের সাজসজ্জার কথা মাথায় রেখে এবারেও মেলায় হাজির রূপের হাটের পসারিরা। একবার সেই সাজমহলে চোখ পড়লে, চোখ সরিয়ে নেওয়া কঠিন হবে। মেয়েরা যেখানে, রূপসজ্জার টুকিটাকি সেখানে। বইমেলাতেও ঘটেনি তার ব্যতিক্রম। মেলায় ৫০ শতাংশ ভিড় যদি হয় বইয়ের স্টলে, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় বাকি ৫০ শতাংশের ৩০ শতাংশ লোক ঢুঁ দেন ফুড প্যাভিলিয়নে। আর বাকি ২০ শতাংশ ভিড়টাই টেনে নেন রূপসজ্জার কারিগররা। কেনই বা তা হবে না? কানের দুল, গলার হার, খোঁপার কাঁটা বা হাতের ব্যাঙ্গেল, এক বিশাল সাজঘর নিয়ে বইমেলায় চলে এসেছেন শিল্পীরা। আর তাঁদের ঘাড়ের কাছে হামলে পড়েছেন অষ্টাদশী থেকে তিরিশোর্ধ্ব মহিলা ব্রিগেড।
অনেকেই বেঁচে যাওয়া টাকা দিয়ে কিনছেন হস্তশিল্পের মনোহরণ পণ্য। কেউ কিনছেন হাতে তৈরি ডায়েরি, প্যাড। কেউ আবার দরদাম করে কিনছেন বেতের হ্যারিকেন, পাটের তৈরি ব্যাগ, ক্যালেন্ডার, বিখ্যাত ব্যক্তিদের হাতে আঁকা পোট্রেট, ফোটো ফ্রেম, তিলোত্তমা নগরীর হালহদিশ তুলে ধরা স্কেচ বুক।
সামনেই ভ্যালেন্টাইনস ডে। ভ্যালেন্টাইনকে উপহার হিসেবে কার্ড দেওয়ার প্রথায় এখনও সেভাবে ঘাটতি দেখা যায় না। কেউ মনের মতো কার্ড পেতে ছোটেন আর্চিস গ্যালারিতে। কেউ আবার নতুনত্বের স্বাদ নিতে হাজির বইমেলায়। কারণ এখানেই মিলবে মনের মতো হাতে আঁকা কার্ড। সেইসব কার্ডের সহজ সরল বার্তা অনুভূতির বহিঃপ্রকাশের জন্য আদর্শ। ‘বসন্ত এসে গেছে’ বা ‘যদি কোনওদিন তুমি দুহাত দিয়ে ঝিনুক কোড়াও’-এর মতো সহজ সরল লিখন মন ছুঁয়ে যাচ্ছে ক্রেতাদেরও। বলা বাহুল্য, ৩০-২০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হওয়া সেই সমস্ত শুদ্ধ হাতের জাদুতে তৈরি বাহারি জিনিসের বিক্রিবাটা চলছে বেশ ভালোই।
মেলা মানেই উৎসব, মেলা মানেই সাজগোজ হৈ-হুল্লোড়। উচ্ছ্বাসী বইপ্রেমী বা সংযমী বইপোকাদের সমাগম বছর বছর জমিয়ে তোলে বইয়ের অস্থায়ী বাজারকে। সে কথা ভালমতোই জানেন ব্যবসায়ীরা। তাই বিপুল সংখ্যক ক্রেতাদের পেতে বইমেলায় বই ক্রেতাদের পাশাপাশি হাজির হয়ে থাকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা। ক্রেতা মানেই লক্ষ্মী। আর সেই লক্ষ্মীলাভের আশায় এবারের বইমেলায় উপস্থিত স্বর্ণালঙ্কার প্রস্তুতকারী সংস্থা পি সি চন্দ্র জুয়েলার্স, জীবন বীমা সংস্থা, আচার, ডাটা গুঁড়ো মশলা বা দার্জিলিং চায়ের বিক্রেতারাও। মেলামুখী জনতার নজর টানতে সুন্দর করে সেজে উঠেছে কলকাতা পুলিশের স্টলও। যার সামনে রাখা একটি বাইক আরোহী পুলিশের মডেলের সামনে মানুষের সেলফি তোলার ভিড় চোখে পড়ার মতো। ভ্রমণপ্রিয় মানুষের জন্য মেলায় বসেছে গুজরাট ট্যুরিজমের স্টলও।
নাটকের প্রতি যাঁদের অমোঘ টান, তাঁদের জন্যেও আছে সুখবর। মেলা প্রাঙ্গণের ভিতরেই গড়ে উঠেছে নাট্যদলের স্টল। আছে মুক্তমঞ্চ। যেখানে ‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান’-এর নানা পরিচয়ের মানুষ মুক্ত মঞ্চে সাক্ষ্য দিচ্ছে নতুন ভাবনা চিন্তার, নব নব সৃজনশীলতার।