কথায় বলে, নামে নয়, কাজে নিজেকে বড় করে তুলতে হয়। গবেষক পড়ুয়াদের কাছে তাই নাম মাহাত্ম্যে নয়, মৌলিকত্ব ও বিশেষত্ব গুণে বড় আদরের, বড়ই আপন ‘লিটল ম্যাগ’। আকারে সে যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, নিজ গুণে ‘লিটল’ পত্রিকাই কালক্রমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিশ্বকোষে পরিণত হয়েছে গবেষক-পাঠকদের কাছে। বই যদি হয় হৃদয়ের ডান অলিন্দ, তাহলে নির্দ্বিধায় ‘লিটল ম্যাগ’-কে বলা যায় হৃদয় প্রকোষ্ঠের বাম অলিন্দ। সাহিত্য হোক বা বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি বা সাংস্কৃতিক জগত, সর্বত্রই লিটল ম্যাগাজিনের অবাধ বিচরণ। নতুন ভাবনার খোরাক। নতুন আঙ্গিকের দিশারি। হতে পারে ভুল। হতে পারে ঠিক। কিন্তু নিজের ভাবনাকে একশো শতাংশ উজাড় করার নামই লিটল ম্যাগাজিন। তাই বইমেলার চওড়া ময়দানে তাদের জন্য বরাবরের মত বরাদ্দ অংশে নিজের মত করেই সেজেছে ‘লিটল ম্যাগাজিন মেলা’। বইমেলা আছে বইমেলার জায়গাতেই। আর ‘লিটল ম্যাগ’-এর সাম্রাজ্য তার জায়গায়।
মিলনমেলার প্রাঙ্গণ ছেড়ে নতুন আস্তানায় উঠে আসায় এবার কিছুটা ভোল বদলেছে লিটল ম্যাগাজিন। স্থান সংকুলানের কারণে এবার লিটল ম্যাগের আসরে জায়গা পায়নি বেশ কিছু কম পরিচিত লিটল ম্যাগ। তবে ভাল কাজের স্বীকৃতি তো একটা আছেই। আবার লিটল ম্যাগের জলসায় জায়গা করে নিয়েছে বেশ কয়েকটি নতুন লিটল ম্যাগের মুখ। পুরাতন নতুন দুই মিলে গত বছরগুলির মত এবারেও জমজমাট লিটল ম্যাগাজিন মেলা। সেই মেলায় আছে একাল, ঐহিক, উজাগর, অন্তঃসার, তবুও প্রয়াস এবং আরো কত লিটল ম্যাগ। জঙ্গলমহল, কাগজের ঠোঙা এবং আরও অন্যান্য লিটল ম্যাগ প্রকাশনীও নিজের মত করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মেলায় উপস্থিত বাংলাদেশ, স্পেন, ফ্রান্স ও পৃথিবীর অন্য দেশের অন্য জগত নিয়ে কাজ করা গবেষণামূলক প্রবন্ধের সম্ভারও। তাঁদেরই কেউ কেউ ক্রেতাদের সোৎসাহে ডেকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন তাঁদের বইয়ের বিশেষত্ব। ক্রেতা যদি কোনও লিটল ম্যাগে মুগ্ধ হয়ে কিনতে ইচ্ছুক হন, তাহলে এক গাল হাসিতে ভোরে উঠছে তাঁদের মুখ। যে সব তরুণ পাঠক পাঠিকা নিছক ছবি তোলার চক্করে ঘুরছেন লিটল ম্যাগের দরবারে, তাঁদের কর্মকাণ্ডও কিন্তু নির্ভেজাল হাসি এনে দিচ্ছে বিক্রেতাদের ঠোঁটে। ‘ছোট্ট’ বইমেলার লাগোয়া একদল কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের দেখে আপনা আপনি থমকে যায় পায়ের গতি। মুখে কাপড় বাঁধা পড়ুয়ারা চুপচাপ বিক্রি করে চলেছে ‘অর্ধেক আকাশ’। সদ্য জন্ম নেওয়া তাঁদের প্রতিবাদের হাতিয়ার ‘অর্ধেক আকাশ’ আসলে একটি খবরের কাগজ। সঙ্গে দোসর ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের প্রচেষ্টায় তৈরি ‘লিটল ম্যাগ’। সেই লিটল ম্যাগের হাত ধরেই রাজ্য বা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের সাথে হওয়া অন্যায়ের সমকালীন কাহিনিকে সকলের সামনে তুলে ধরে চলেছেন নির্বাক ও সবাক পড়ুয়ার দল।
ঠিক তার পাশেই স্বমহিমায় বিরাজ করছে একটি দীর্ঘাকার ছাউনি দেওয়া লিটল ম্যাগাজিনের চত্বর। চারপাশটা অনেকটা মুক্তমঞ্চের মতো। সার বেঁধে রাখা টেবিলে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বজায় রেখেই বসেছে এক সোনার সংসার। কাব্য-কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, অনুবাদমূলক রচনা, বিদেশের সাহিত্য বা সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তিল তিল করে তিলোত্তমা হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে লিটল ম্যাগের মধ্যমণিরা। সন্তানতুল্য ‘ম্যাগ’ গুলিকে নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিক্রেতাদের মধ্যে উন্মাদনার শেষ নেই। মূল ধারার বইয়ের সাথে পাল্লা দেওয়ার বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় হয়তো আকারে ছোট মণিমুক্তোগুলি সেভাবে এঁটে উঠতে পারছে না। বিরাট বিরাট মহীরুহের সাথে লড়াইয়ে মেলার আসরে হয়তো প্রতিপদে এক অসম লড়াই লড়তে হচ্ছে তাঁদের। তা বলে একেবারে হাল ছেড়ে দেননি ‘লিটল’ সন্তানদের অভিভাবকেরা। যাঁরা লিটল ম্যাগাজিনের কদর বোঝেন, তাঁরা ঠিকই তাঁদের প্রয়োজনীয় বই কিনতে হাজির হচ্ছেন লিটল ম্যাগের চত্বরে। এমনটাই জানা গেল ‘পুরাবর্ত্ম’-এর উঠতি কবি শমীক জয় সেনগুপ্তের কাছ থেকে। ভালো লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে ছিল, বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে। তার জন্য প্রয়োজনে আজীবন লড়াই করতে প্রস্তুত লিটল ম্যাগপ্রেমীরা। সেই আত্মবিশ্বাসের ঝলক পাওয়া গেল ‘ডুবুরি’-র বিদেশি কবিতার অনুবাদ লেখক বর্ষীয়ান অসীম মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠেও। শুধু অসীমবাবু একা নন, মেলা প্রাঙ্গণের প্রায় ২০০ টির মতো লিটল ম্যাগের সেনাদলও সেই বিশুদ্ধ বিশ্বাসে বছরের পর বছর পা রাখছেন বইমেলায়।
বইমেলা এবারে বদলেছে তার পুরাতন ঠিকানা। সল্টলেকের প্রাণকেন্দ্রে আসর জমালেও মিলনমেলার ‘গ্র্যান্ড লুক’ কোথাও যেন ভাটার মুখে ফেলে দিচ্ছে লোক সমাগমের জোয়ারকে। আসলে মেলার যাযাবর হয়ে ওঠার এই বিষয়টি হয়তো ঠিক সামলে উঠতে পারেননি জেলার বইপোকারা। যাতায়াতের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে লিটল ম্যাগের বিক্রেতাদেরও। বাসা বদলের অসুবিধার প্রভাব কোথাও যেন আঁচ ফেলেছে লিটল ম্যাগের বিক্রিবাটাতেও। আক্ষেপের সুর শোনা গেল লিটল ম্যাগের বেশ কয়েকজন বিক্রেতাদের গলায়। তবু আগামী দিনে সাফল্যের পথে হেঁটে চলায় বিশ্বাসী সকলেই। তাই লঘু মেজাজে আড্ডা দিতে দিতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্টলে বসে অনুসন্ধিৎসু ক্রেতা পাঠকের অপেক্ষায় ক্লান্ত হন না কেউই। আজই বইমেলার শেষ দিন। আজ অবধি লিটল ম্যাগের পসরা সাজিয়ে তাঁরা প্রত্যেকেই অপেক্ষা করে আছেন জহুরিদের জন্য।