State

এবারও জমজমাট চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো

হুগলি জেলার চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো বাংলার মানচিত্রে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। এই পুজোর জাঁকজমক কলকাতার দুর্গাপুজোকে সমানে সমানে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর আকর্ষণ একসময়ে ছিল বিশাল বিশাল প্রতিমা আর দুরন্ত আলোকসজ্জা। বিগত কয়েক বছরে বাজেট যেমন বেড়েছে, তেমনই চোখধাঁধানো হয়েছে প্যান্ডেল। ফলে কলকাতায় দুর্গাপুজো দেখতে আসার মত সেই আমেজ নিয়ে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো দেখতে যাওয়া যেতেই পারে।

তা যে হয়ও তা চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর ষষ্ঠীর দিন থেকেই পরিস্কার। সন্ধে নামার অপেক্ষা। তারপর থেকেই শুধু মাথা আর মাথা। মানুষের ভিড়, আলোর ঝলকানি, দুর্দান্ত সব প্যান্ডেল আর উৎসবের আনন্দে গোটা চন্দননগরে দুর্গাপুজোর আমেজ। কলকাতায় যেমন জগদ্ধাত্রী পুজো হয় কেবল নবমীর দিন। চন্দননগরে কিন্তু তা নয়। এখানে ৪ দিন ধরেই পুজো হয়। ফলে ভিড় হয় ৪ দিনই।


চন্দননগর স্টেশন থেকে প্রায় ঢিলছোঁড়া দূরত্বে কলাবাগান সার্বজনীনের পুজো। ৫০ লক্ষ টাকা বাজেটের এই পুজোর থিম তাক লাগিয়ে দিচ্ছে আট থেকে আশি সবাইকে। কেতাদুরস্ত ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপর ভর করেই ৫০ বছরে পা দেওয়া এই পুজোর এবারের থিম আগামী ৫০ বছর পর পৃথিবী কী অবস্থায় থাকবে? মণ্ডপের ভেতরে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সারি, যেগুলিতে অক্সিজেন প্রায় নিঃশেষিত। তাই মানুষ করজোড়ে গাছের কাছে বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন প্রার্থনা করছে। প্রসঙ্গত, ‌যাঁরা এবার দুর্গাপুজোয় টালা বারোয়ারির পুজো দেখেছেন, তাঁদের কাছে এই প্যান্ডেল ও প্যান্ডেলভাবনা নতুন কিছু নয়।

এরপর আন্ডারপাস ব্যবহার করে রেললাইন পেরিয়ে অন্য পাড়ে এলেই ফটকগোড়ার পুজো আপনাকে স্বাগত জানাবে। পুজোর সম্পাদক প্রভাকর দাস জানালেন তাঁদের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা মন্দিরের আদলে তৈরি স্থায়ী মণ্ডপেই তৈরি হয়। চন্দননগর স্টেশন রোড ধরে গঙ্গাপাড়ের স্ট্যান্ডের দিকে খানিক এগোলেই চোখে পড়বে বাগবাজার সার্বজনীন। এই পুজো কমিটির সদস্য অভিজিৎ ধাড়া জানালেন ১৮৩ বছরের প্রাচীন এই পুজোর মূলমন্ত্রই হল সাবেকিয়ানা। তিনি আরও জানান, তাঁরা থিমের বিরুদ্ধে, কারণ তাঁদের বিশ্বাস থিমের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে সাবেকিয়ানার জৌলুস।


মাইকে গানের কলি, চারপাশে অগণিত মানুষের ঢল আর রাস্তার দুধার জুড়ে কখনও অপুর সংসার তো কখনও অশোকচক্র, কখনও বা জাতীয় পতাকা সহযোগে গান্ধীজিকে নিয়ে করা আলোকসজ্জা দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম মানকুণ্ডুর নতুন পাড়ায়। তাদের এ বছরের থিম থাইল্যান্ডের শ্বেত বৌদ্ধ মন্দির। নতুন কিছু নয়। এখানেও এবার যে প্যান্ডেল হয়েছে তা কলকাতার দুর্গাপুজোয় করা দেশপ্রিয় পার্কের প্যান্ডেল বা বরানগরের নেতাজি কলোনির প্যান্ডেলের রেপ্লিকা। ফলে ‌যাঁরা ওই পুজোর প্যান্ডেলে ঢুঁ মেরেছেন তাঁদের নতুন করে প্যান্ডেল দেখে অবাক হওয়ার সুযোগ নেই।

চন্দননগরের বোড় কালীতলায় পুজো ৪৮ বছরে পড়ল। পুজো কমিটির গোপাল রায় জানালেন, ছৌ নাচ সহ পুরুলিয়ার নানান শিল্পকে দর্শকদের কাছে তুলে ধরাই তাঁদের উদ্দেশ্য। এর পাশের পুজোটিই হল বোড় সার্বজনীন জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটির পুজো। তাদের থিম ‘সৃষ্টির গোলকবৃত্ত’। সৃষ্টি ও বিনাশের মেলবন্ধন মাথায় রেখেই অ্যালুমিনিয়াম নেট, প্লাস্টার অফ প্যারিস সহযোগে তাঁদের গোলকবৃত্ত প্রস্তুত করেছেন পুজো উদ্যোক্তারা।

একই রাস্তা ধরে খানিক এগোতেই পাওয়া গেল বাংলার গ্রামের স্নিগ্ধ ছোঁয়া। ৭৪ তম বর্ষে পালপাড়ার এবারের নিবেদন ‘রাঙামাটি গ্রাম পঞ্চায়েত’। কুঁড়েঘর, কুটিরশিল্প, বাউল সহকারে কংক্রিটের এই সাম্রাজ্যে সবুজকে বাঁচিয়ে রাখার আর্তি ফুটে উঠেছে এখানকার মণ্ডপসজ্জায়। চন্দননগরের আলোকসজ্জার সম্রাট শ্রীধর দাসের পাড়া কলুপুকুর চৌমাথা তাদের মণ্ডপ সাজিয়েছে শৈশবের খেলনা হিসেবে ব্যবহার হওয়া সাজসরঞ্জাম দিয়ে। সাম্প্রতিককালে এই শহরের আরেক সাড়া জাগানো পুজা হেলাপুকুর সার্বজনীন। যাদের এবারের উপস্থাপনা ‘তুমি আদি, তুমি অন্ত’। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের মিলিত শান্ত একটি রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানে। আলাপ হল পুজো কমিটির সম্পাদক কানাই ঘোষালের সঙ্গে। জানালেন তাঁদের পুজোর শোভাযাত্রার এবারের থিম ছিল ‘বাহুবলী’ এবং গতবার ব্রাজিলের সাম্বা নৃত্যের ছন্দে মেতেছিল এই শোভাযাত্রা। ওপার বাংলার উৎসবে মাটিতে আলপনা দেওয়ার রীতিকে সম্মান জানিয়ে চন্দননগরে প্রথম আলপনার রীতি তাঁরাই প্রচলন করেন বলেও দাবি করলেন কানাইবাবু।

প্রশাসনের সুষ্ঠ ভিড় নিয়ন্ত্রণ, রাত জেগে পরিবার-প্রিয়জনের সঙ্গে ঠাকুর দেখা আর রাতের আলো মেখে ফরাসডাঙ্গার মায়াবিনী হয়ে ওঠা, সব মিলিয়ে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো এবারও তার ঐতিহ্যবাহী জৌলুস বজায় রেখে উৎসব মুখর।

Show Full Article

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button