Mythology

বাহন কুকুর, করেন মদ্যপান, কালভৈরবের মাহাত্ম্যকথা

কালভৈরবকে যে কোনও সুরাই পরিবেশন করা চলে। দিশি বা স্কচ, যে কোনও সুরা হলেই হল। কোনওটাতেই কালভৈরবের আপত্তি নেই।

অটো এল সুন্দর পিচের রাস্তা ধরে একটু নির্জন পরিবেশের মধ্য দিয়ে উজ্জয়িনী জেলের সামনের রাস্তা দিয়ে কালভৈরবের মন্দির সংলগ্ন বিস্তৃত প্রাঙ্গণে। উজ্জয়িনী স্টেশন থেকে সরাসরি এলে মন্দিরের দূরত্ব সাড়ে সাত কিমি। গড়কালিকা থেকে সোজা এখানে এলাম বলে দূরত্ব অনেক কম, ২ কিমি।

পুরনো উজ্জয়িনীর ভৈরবগড়েই কালভৈরব মন্দির। এখানকার বিস্তৃত প্রাঙ্গণে মাত্র কয়েকটি দোকান। দোকানি বসে আছে কালভৈরবের ফটো আর পুজোর নানান সামগ্রী নিয়ে।


রাজস্থানি ঢঙে সুসজ্জিত বিশাল তোরণদ্বার, কাঠের। পরপর কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে তোরণদ্বার পরতেই পাথর বাঁধানো চত্বর। প্রথমেই এলাম একেবারে কোণে ডান দিকে একটা ছোট্ট মন্দিরে। এখানে স্থাপিত দেবতা সুদর্শন চতুর্ভূজ, কালোপাথরে নির্মিত। নাম দাঁতেশ্বরজি। বিগ্রহের সামনেই রয়েছে ছোট্ট একটি শিবলিঙ্গ।

এখান থেকে বাঁয়ে সরে এবার আরও কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলাম কালভৈরবের মূলমন্দির চত্বরে। এখানে রয়েছে নিম আর বেলগাছের সুশীতল ছায়া। এর পরেই কালভৈরব মন্দির। মানব শিল্পধারায় অনুকৃত এই মন্দিরের ছোট ছোট চূড়া রয়েছে অনেকগুলি আকৃতি ও উচ্চতায় বিশাল নয়, ছোট মন্দির। মন্দিরের তিনদিকে কিছুটা করে টিনের ছাউনি। প্রথম এই মন্দির কে নির্মাণ করেছিলেন তা জানা যায়নি। তবে আজকের মন্দিরটি প্রায় চারশো বছর আগে নির্মাণ করেন পারমার রাজা ভদ্রসেন, মতান্তরে মধুজি সিন্ধিয়া। অনাড়ম্বর মন্দির, মন্দিরের দেবতা, মন্দির প্রাঙ্গণও। শিপ্রা তটেই ভৈরবগড়, কালভৈরব। এখান থেকে শিপ্রা একেবারেই হাতের নাগালে। উঠে এলাম নাটমন্দিরে।


তেল-চকচকে মসৃণ কষ্টিপাথরের একটি কুকুর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বসে আছে কালভৈরবের দিকে। শিবের যেমন নন্দী বা বৃষ, তেমনই কালভৈরবের বাহন কুকুর। আরও একটু এগতেই মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে দরজার পাশে ডানদিকে রয়েছে সিঁদুরে রাঙানো বেশ বড় আকারের গণেশ বিগ্রহ বাঁদিকের দেওয়ালে অম্বিকা দেবী। এবার ছোট দরজা পেরিয়ে ঢুকলাম শান বাঁধানো মূল মন্দিরে। ভিতরটা নির্মিত একেবারে ত্রিকোণাকৃতি যোনিদেশের মতো। দেখলেই বোঝা যায় তন্ত্রে উল্লিখিত বিভিন্ন ‘যন্ত্রম’-এর একটি। শাস্ত্রসম্মতভাবেই নির্মিত এটি। খুব ভালোভাবে লক্ষ না করলে বিষয়টা সকলেরই নজর এড়িয়ে যাবে। মন্দিরের ভিতরে আরও একটি সাদা পাথরের মন্দিরের মতো, তাতে পিতলের চূড়া আছে তিনটি। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত অবন্তীর প্রসিদ্ধ কালভৈরব।

লাল সিঁদুরে রাঙানো বেশ বড় আকারের গোলাকার মুখমণ্ডল। গোলাকার চোখ-মুখ আর টানাটানা ভ্রু- যুগল। প্রশস্ত কপালে শৈবতিলক চাঁদের মতো করে আঁকা, ভস্মতিলক। পূর্ণাঙ্গ গড়ন কিছু নেই। মুখমণ্ডলের পর থেকে নীচে কয়েক হাত পর্যন্ত কাপড় বেড় দিয়ে ঢাকা। বিগ্রহের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকলে গা শিউরে ওঠে। কাশীতে বিশ্বনাথের যেমন, এখানেও মহাকালেশ্বরের সেনাপতি বা পার্ষদ কালভৈরব। অবন্তীনগরের দ্বাররক্ষী। মন্দিরমধ্যে ডানপাশে একটি কুঠরিতে রয়েছে সিঁদুর মাখানো দেবী চামুণ্ডার মূর্তি। কালভৈরবের সামনের ছোট্ট বিগ্রহটি পাথরে খোদিত বটুক ভৈরবের।

শতশত বছর ধরে আজও সারাদিন তীর্থযাত্রী আর ভক্তদের অবিরাম স্রোত বয়ে চলেছে ভৈরবমন্দির অভিমুখে। উজ্জয়িনীতে এসে এই মন্দির দর্শন না করলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে উজ্জয়িনী ভ্রমণ। মন্দিরনগরী উজ্জয়িনী। এরই এক প্রান্তে ছোট্ট একটি পূজাবেদিতে অধিষ্ঠিত দেবতা কালভৈরব যে কোনও মত্ত মাতালের মতো সুরা পান করেন আকন্ঠ। এ চোখে না দেখলে কানে শুনে কারও বিশ্বাস হবে না এতটুকু। যে কোনও মানুষের দেওয়া সুরা-উপচার প্রকাশ্য দিবালোকে, এমনকি রাত্রিকালেও, যে কোনও সময়ে পান করার ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা যে ভৈরবগড়ের কালভৈরবের আছে, এ যুগের কোনও বিজ্ঞানমনাদের ধারনাতেই আসবে না।

কালভৈরবকে যে কোনও সুরাই পরিবেশন করা চলে। দিশি বা স্কচ, যে কোনও সুরা হলেই হল। কোনওটাতেই কালভৈরবের আপত্তি নেই। মন্দিরের পূজারি একটি স্টেনলেস স্টিলের থালায় সুরা পরিবেশন করে কালভৈরবের উদ্দেশ্যে তন্ত্রের মন্ত্রোচ্চারণ ও তান্ত্রিক অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে প্রার্থনা করে থালাপূর্ণ সুরা দেবতার ঠোঁটের ফাঁকে সামান্য কাত করে ধরলে তা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায় চোখের সামনে। এইভাবে বোতলের পর বোতল সুরা দিলে তা নিঃশেষ হয়ে যেতে বেশি সময় লাগে না। একেবারে সামনে থেকে পরিস্কার দেখা যায় কোনও ছিদ্র নেই মুখের মধ্যে। পাথরের মূর্তির এই সুরাপান দেখে আমি নিজে যেমন বিস্মিত হয়েছি, তেমনই মোহিত হন যাঁরা আসেন কালভৈরবে।

মন্দিরের পূজারিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওষ্ঠাধারের ফাঁকে যখন কোনও গর্ত নেই, তখন এই সুরা যাচ্ছে কোথায়? উত্তরে পূজারি জানিয়েছেন, সুরা কোনও গর্তের ভিতরে গড়িয়ে পড়ছে কিনা তা জানার সন্দেহ প্রকাশ করে ইংরেজ আমলে একবার গোটা মন্দিরটা জব্বর খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছিল। কিন্তু ভৈরবের সুরাপানের রহস্যের ছিটেফোঁটাও মীমাংসা হয়নি।

একমাত্র পূজারি ছাড়া এই মন্দিরের আর কেউই কালভৈরবকে সুরা পান করাতে সক্ষম হবে না, এ কথা জানিয়েছেন পূজারি স্বয়ং। যে কোনও অবিশ্বাসী একবার পরীক্ষা করে দেখে আসতে পারেন।

কালভৈরব মন্দিরের বাঁ পাশেই রয়েছেন পাতাল ভৈরব। এসে দাঁড়ালাম একটি গুহামুখের সামনে। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই মাটির নীচে গুহামন্দির। একেবারে ছোট্ট গুহামুখ। মোটা মানুষের পক্ষে ঢোকা মুশকিল। প্রথমে আধশোয়া হয়ে দুটো পা ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে ঢুকিয়ে দিলাম দেহটাকে। পরপর রয়েছে বেশ কিছু সিঁড়ি। এইভাবে তিনবার তিনটে ছোট ছোট গুহামুখের মধ্য দিয়ে একেবারে নেমে এলাম নীচে। অন্ধকারময় এই গুহামন্দিরে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে স্থানীয় এক সাধুবাবা দেখালেন ছোট্ট পাথরের চ্যাপটা একটা শিবলিঙ্গের মতো দেওয়ালের গায়ে। এই পাথরে চোখ-মুখ আছে। এই বিগ্রহটিই পাতাল ভৈরব। এক সময় এই গুহাটি ছিল অনেক লম্বা। অনেকের মৃত্যুর কারণে নাকি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ভিতরের কিছুটা অংশ।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button