বৃষ্টি ঝিরঝির করে পড়েই চলেছে। তারমধ্যেই বেজে চলেছে শ্যামা সঙ্গীত। পূন্যার্থীদের বিশাল লাইন। এমনই এক আবহে কালীপুজোর রাতে অন্যতম সতীপীঠ কালীঘাটে মাতৃদর্শনের আকাঙ্ক্ষাকে বুকে করে হাজার হাজার মানুষ ঠায় অপেক্ষমান। প্রতিবছরের মত এইবারেও ভিড় ছিল উপচে পরার মত। নিম্নচাপের বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই মাতৃদর্শনের আকাঙ্খায় বাঁধ ভাঙ্গা ভিড়।
গুটি গুটি পায়ে লাইন এগোল মন্দিরে মায়ের সামনে। একাধিক পুরোহিত উপস্থিত সেখানে। এক একজন এক একটি পরিবারের সকলের হাতে ফুল দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। অনেকটা পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার মত। পুরোহিতের সঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণ শেষে সেই ফুল ডালা নিয়ে তা পুরোহিত গিয়ে ঢেলে দিচ্ছেন মায়ের পায়ে। কালীপুজোর দিন কালীঘাটে মহালক্ষ্মীর আরাধনা হয়ে থাকে। যা এবার দিনের বেলাতেই সম্পন্ন হয়েছে। রাত্রে মাকালীর আরতি, ভোগ নিবেদন।
কালীপুজোয় অনেক ভক্ত মায়ের উদ্দেশ্যে পঞ্চব্যাঞ্জন ভোগের থালা নিবেদন করে থাকেন। থালায় সাজানো থাকে পোলাও, নানা রকম ভাজা, মাছ ভাজা, কাতলা বা রুই মাছের ভিন্ন স্বাদের পদ, পাঁঠার মাংস, লুচি, মিষ্টি, দই, চাটনি, খিচুড়ি ও লাবড়া। মানে এক কথায় রাজকীয় পরিবেশন। এই ভোগের ভাগীদার আপনিও হতে পারেন। ভক্তদের কথা মাথায় রেখে কালীঘাটে রান্না হয় খিচুড়ি আর মাছ ভাজা। কাঠের জ্বালে রান্না হওয়া খিচুড়ি আর মাছ ভাজা বিনামূল্যে পেতে গেলে রাত্রে বেশ কিছুটা সময় দিতেই হবে। কারণ নিশিকালে হয় ওই ভোগ। যা পুজোর দিন সাধারণের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে গেলে সরু লাইন ধরে যেতে হয়। ভেতরে অধিষ্ঠিত মা দক্ষিণাকালী। রূপোর তৈরি মায়ের আসন। মায়ের মূর্তি কষ্টিপাথরের। কালো গায়ের রংয়ের সঙ্গে মেটে বা কমলা রঙের চোখ। মায়ের জিভ, হাত ও হাতের খাড়া সোনার তৈরি। মায়ের সামনে প্রচুর জবাফুলের মালা আর প্রদীপ। পুরোহিত ডালা থেকে ফুল নিয়ে মাকে দিয়ে দেন আর প্রদীপের আশিস মাথায় ছুঁয়ে, কপালে মেটে কমলা সিঁদুরের টিপ পড়িয়ে দেন। ভক্তের হাতে শাঁখাপলা লাল চেলি থাকলে সেগুলিও মাকে নিবেদন করা হয়। খুব কম সময়ের মধ্যে মায়ের পুজো আর দর্শন পর্ব শেষ করতে হয়। পাশেই শিব মন্দির। সেখানে কেউ কেউ বসে যজ্ঞও করে থাকেন। শিব মন্দিরের ঠিক পাশেই রয়েছে বলির জায়গা। কালীপুজোর দিন মায়ের দর্শন সবার কাছে এক পরম প্রাপ্তি।
এখান থেকে বেরিয়ে দ্বিতীয় গন্তব্য কেওড়াতলা মহাশ্মশানে শ্মশানকালীর পুজো। প্রায় ১৬ ফুট উচ্চতা নিয়ে শ্মশানকালীর অধিষ্ঠান। দ্বিভুজা দেবীর একহাতে মাংস ও দ্বিতীয় হাতে কারণবারি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত লম্বা চুল। দেবীর গায়ের রং কাজল কালো। চোখ দুটি টকটকে লাল। তবে শ্মশানকালীর এই মূর্তিতে জিভ নেই। তাই দেবী শক্তিরূপী ও ভয়ঙ্করী হলেও পাশাপাশি কোথাও দেবীর মাতৃরূপও বর্তমান।
কালীপুজোর দিন। ফলে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে রাতের পুজো দেখতে বহু মানুষের ভিড় জমেছিল। ঢাক ঢোল, প্রদীপ, লম্বা ধুপ, ফুল মালা আলোয় ভরা ছিল দেবীর মণ্ডপ। কেওড়াতলা মহাশ্মশানে দেবীকে কৃষ্ণকালী রূপেও পুজো করা হয়। এখানে মায়ের এক হাতে খাঁড়া, অন্য হাতে মূরলী। শ্মশানকালীর একাধারে ভয়ংকর রূপ, আবার অন্যদিকে কৃষ্ণকালীর স্নিগ্ধরূপের বৈপরীত্য অবাক করে।
কালীপুজোর দিন মাতৃ দর্শন মানে সন্তানের সঙ্গে মায়ের সাক্ষাৎ, এ এক অপূর্ব অনুভূতি। শত কষ্ট সহ্য করে অপেক্ষার পর মায়ের দর্শন যেন সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে দেয়। মেলে অপার শান্তি।