দরজায় কালীপুজো, সরগরম কুমোরটুলি
যাঁদের ধর্ম শিল্প, বর্ণ ঐতিহ্য এবং জাতি শিল্পী, এমন মানুষের খোঁজ যদি আপনি করেন তাহলে আপনাকে পৌঁছে যেতে হবে কুমোরটুলিতে।
যাঁদের ধর্ম শিল্প, বর্ণ ঐতিহ্য এবং জাতি শিল্পী, এমন মানুষের খোঁজ যদি আপনি করেন তাহলে আপনাকে পৌঁছে যেতে হবে কুমোরটুলিতে। সেই কুমোরটুলি, যেখানে বছরের পর বছর ধরে শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় দেবদেবী মৃন্ময়ী রূপে আবির্ভূত হন। এই সেই আঁতুড়ঘর যেখানে মাটি কথা বলে। কুমোরদের বংশানুক্রমিক সাম্রাজ্য যেখানে সময়ের চাকার সাথেই আপন গতিতে চক্রাকারে ঘুরে চলেছে। আর কালীপুজো যখন দরজায় কড়া নাড়ছে তখন তো আপনাকে প্রতিমার জন্য ঢুঁ মারতেই হবে এই কুমোরপাড়ায়।
হাতে মাত্র একটা দিন। তাই কুমোরপাড়ায় শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি তুঙ্গে। কিছু ঠাকুর ইতিমধ্যেই পাড়ি দিয়েছে প্যান্ডেলে। কিছু প্রতিমায় শেষ মুহুর্তের টাচ দিচ্ছেন শিল্পীরা। বারোয়ারির উদ্যোক্তাদের ভিড়। ঠাকুর নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড়। কুমোরটুলি এলাকায় পা দিতেই চোখে পড়ল পেল্লাই সাইজের এক কালী প্রতিমা। যেটির উচ্চতা কম করেও একটি তিনতলা বাড়ির সমান। মূর্তিটি ইতিমধ্যেই ২ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানালেন শিল্পী। এবার রাজপথ থেকে গলিতে ঢোকার পালা। মৃৎশিল্পী বিনয় পাল জানালেন ৩ হাজার টাকা থেকে কালীমূর্তির রেঞ্জ শুরু, সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা। প্রতিমাশিল্পী প্রবীর পাল আবার ২ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকার মূর্তিও গড়েছেন। জিএসটির জোরালো ধাক্কায় মাটির প্রতিমার দাম খানিক বেড়েছে। ক্যামেরা নিয়ে চিত্রগ্রাহকদের ছবি তোলার আকুলতা প্রতি মুহুর্তে প্রমাণ করছিল এই অঞ্চল ঘিরে বাঙালির আবেগকে। মূর্তি গড়াই শুধু নয়, সেটিতে রঙ করাও কাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। রঙের পর সেটিতে একটি বিশেষ স্প্রে করার মাধ্যমে বার্ণিশ করা হয়, অর্থাৎ প্রতিমাটি দেখতে আরও ঝকঝকে তকতকে হয়ে ওঠে। মিস্ত্রিদের মাটির তাল দু’হাতে সামলিয়ে গন্তব্যের দিকে দ্রুত পায়ে যাত্রা দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম কুমোরটুলি মৃৎশিল্পী সমবায় সমিতির অফিসে। এখানে পাওয়া গেল সমিতির যুগ্ম সম্পাদক রঞ্জিত সরকারকে। তাঁর থেকে জানা গেল মূর্তিতে কোনও জিএসটি না থাকলেও মাথার চুল ও কাপড়ে ৫ শতাংশ, অস্ত্রে ১৮ শতাংশ এবং রঙে ২৮ শতাংশ জিএসটির বোঝা চেপেছে। তাতে অবশ্য কুমোরপাড়ায় খুব একটা চাপ পড়েনি। কারণ পুজোতে মূর্তি তো লাগবেই। একটু বেশি দাম হলেও তা মানিয়ে নিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। বরং এবারও শুধু কলকাতা বা তার আশপাশ নয়, কুমোরটুলির প্রতিমা বাংলার গণ্ডি অতিক্রম করে ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহারেও পাড়ি দিচ্ছে।
এ পাড়ার শিল্পীদের অপরিসর স্টুডিওতে তৈরি মাটির প্রতিমা শিল্পের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। বছরভর এ পাড়ায় বিদেশি পর্যটক থেকে গবেষকের ভিড় লেগে থাকে। তবু এই প্রজন্মে যাঁরা ঠাকুর গড়ছেন তাঁদের অভিযোগ, কুমোরটুলি যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়েছে। পরিকাঠামোর উন্নতি না হওয়ায় এবং শিয়ালদহ মার্কেট, উল্টোডাঙ্গা মুচিবাজার, শ্যামবাজার ইত্যাদি এলাকায় মিনি কুমোরটুলি আত্মপ্রকাশ করায় এখানকার ছোট খদ্দেরের সংখ্যা গেছে কমে। উপরন্তু লক্ষ্মীপুজোর পর খুবই স্বল্প সময়ে কালীপ্রতিমা তৈরি করে ফেলতে হয়। এই সব নানান কারণে পরবর্তী প্রজন্ম মুখ ফিরিয়েছে এই পেশা থেকে। ফলত ভবিষ্যতে বাংলার ঐতিহ্যের এই শিকড় জীবিত থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান বর্তমান মৃৎশিল্পীরাই।