মহারথী অর্জুন প্রতিষ্ঠিত প্রবল জাগ্রত দুর্গা মন্দিরের মাহাত্ম্যকথা
পাহাড়ের উপর বিশাল মন্দির। কথিত আছে এখানেই শিবের উপাসনা করে 'পাশুপথাস্ত্র' অর্জন করেন পাণ্ডুপুত্র অর্জুন। পরে অর্জুনই এখানে মন্দিরটি তৈরি করেন।
কৃষ্ণা নদীর ধারে সাজানো শহর বিজয়ওয়াড়া। শহরকে ঘিরে রেখেছে পূর্বঘাট পর্বতমালা। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই সবুজ ঘেরা ছোট ছোট পাহাড়। শহরের পিচ ঢালা রাস্তাগুলো চড়াই উৎরাই। বোঝা যায় পাহাড় কেটেই তৈরি হয়েছে অপেক্ষাকৃত নতুন শহরটি। শহরের জন্ম ধর্ম মেনে পাশে পাওয়া গেছে কৃষ্ণা নদীকে। কৃষ্ণা ড্যাম বেঁধেছে নদীর জল। কৃষ্ণার গা বেয়ে উঠেছে পাহাড়ে সারি। তারই একটি ইন্দ্রকিলাদ্রি পাহাড়।
উঁচু পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে রাস্তা। গাড়ি ওঠার মত না হলেও বেশ চওড়া। পাহাড়ের প্রায় মাথার কাছে কনক দুর্গা মন্দির। সহজ কথায় দুর্গা মন্দির। রাজ্যের বাইরে দুর্গা মন্দিরের নাম শুনলে মন্দ লাগে না। দেখার ইচ্ছাটাও বেশ চাড়া দেয়। কনক দুর্গা মন্দিরে যাওয়া মানে এক কথায় রথ দেখা আর কলা বেচা দুটোই একসাথে সেরে নেওয়া। ঘোরাকে ঘোরাও হল, আর দেবী দর্শনও হল।
বিজয়ওয়াড়া শহরের কোলাহল ছেড়ে কিছুটা দুরে এই মন্দিরে যেতে গেলে পাহাড়ে চড়া ছাড়া অন্যপথ নেই। পাহাড়ের গা বেয়ে তৈরি পাথুরে রাস্তা দিয়ে যত উপরে ওঠা যায়, ততই কৃষ্ণা নদীটা অপরূপ হতে শুরু করে। দূরে রেল ব্রিজ। তার উপর দিয়ে ট্রেন গেলে পাহাড়ের উপর থেকে গোটা ট্রেনটাকে খেলনা গাড়ি বলে মনে হয়। নদীর উপর ভেসে বেড়ানো নৌকাগুলো ছবির মতো দেখতে লাগে। কনক দুর্গা মন্দিরটা সত্যিই সুন্দর। পাহাড়ের উপর বিশাল মন্দির। কথিত আছে এখানেই শিবের উপাসনা করে ‘পাশুপথাস্ত্র’ অর্জন করেন পাণ্ডুপুত্র অর্জুন। পরে অর্জুনই এখানে কনক দুর্গা মন্দিরটি তৈরি করেন।
দুর্গাপুজোর সময় এই মন্দিরই শুধু নয়, গোটা ইন্দ্রাকিলাদ্রি পাহাড়টা কনের সাজে সেজে ওঠে। আলোক মালায় ঝলমল করে গোটা পাহাড়। পুজোর দিন গুলোয় ভিড়ও হয় চোখে পড়ার মতন। তবে কনক দুর্গা মন্দিরে সবচেয়ে বেশি মানুষের ঢল নামে দশেরা বা বিজয় দশমীর দিন। সেদিন শুধু স্থানীয় মানুষজনই নন, দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ভিড় জমান এখানে। আকর্ষণটা শুধুই দুর্গাদর্শন নয়। কৃষ্ণার উপর ড্যামের কালো পিচ ঢালা রাস্তায় থিকথিক করে মানুষ। আলোর মালায় সাজানো পক্ষীরাজ নৌকা রাজকীয় সাজে সেজে ওঠে এদিন। তারপর কৃষ্ণার একপাশ থেকে যেদিকে কনক দুর্গা মন্দির সেদিকে পাড়ি দেয় পক্ষীরাজ। সন্ধে নামায় কৃষ্ণার জলের রঙ তখন শুধুই কালো। সেই কালো জলের উপর দিয়ে রাজকীয় ঢঙেই ভেসে চলে সেই নৌকা।
কৃষ্ণার চারপাশে হাজারো মানুষের চোখ তখন শুধুই সেই আলোক সজ্জিত নৌকার দিকে। নৌকা অন্যপাড় ছুঁতেই শুরু হয় বাজি পোড়ানো। তাক লেগে যায় সেই বাজির রোশনাইতে। কত রঙ, কত তার রঙ্গ। অন্ধ্রপ্রদেশের বাণিজ্য নগরী বিজয়ওয়াড়া শহরের নানা প্রান্ত থেকেও মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে যায় রংবাহারি আতসবাজির আলোয়। দশেরার দিন কৃষ্ণা নদীর জলে পুণ্যস্নানও সারতে দেখা যায় অনেককে। সাগরস্নান বা কুম্ভস্নানের মত মানুষের বিশ্বাস দশেরার দিন কৃষ্ণার জলে স্নান করলে ধুয়ে যায় পাপ। অর্জন হয় পুণ্য।
কনক দুর্গার আর এক নাম বিজয়া। সেই থেকেই এই শহরের নাম বিজয়ওয়াড়া। বেশ সাজানো শহর বিজয়ওয়াড়ার অবস্থান অন্ধ্রপ্রদেশের অর্থনৈতিক মানচিত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিজয়ওয়াড়ার প্রধান আকর্ষণ কনক দুর্গা মন্দির। এই মন্দিরের টানেই পর্যটকরা হাজির হন বিজয়ওয়াড়ায়। বিজয়ওয়াড়া স্টেশনে ট্রেন থামলেই দূরে পাহাড়ের উপর কনক দুর্গা মন্দির নজর কাড়ে। স্টেশন থেকে গাড়িতে মিনিট দশেক লাগে ইন্দ্রকিলাদ্রি পাহাড়ের পাদদেশে অব্ধি পৌঁছতে। তারপর উপরে উঠতে যার যা সময় সময় লাগে।
জানা যায় প্রাচীন বেদেও এই কনক দুর্গা মন্দিরের উল্লেখ আছে। এ শহরে এখনও কেউ যদি ঘুরতে আসেন তো তা কেবল কনক দুর্গার টানেই। স্থানীয় মানুষের কাছে কনক দুর্গা বড়ই জাগ্রত। কথিত আছে, এক সময়ে অসুররাজ মহিষাসুরের তাণ্ডবে বিজয়ওয়াড়ার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। তখন মহিষাসুরকে বধ করে শহরবাসীকে এই অশুভ শক্তির হাত থেকে রেহাই দেন কনক দুর্গা।
ইন্দ্রকিলাদ্রি পাহাড়ে চূড়া থেকে কিছুটা নিচে কনক দুর্গা মন্দিরটা। কিন্তু বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে তৈরি করা হয়েছে। মন্দিরের মধ্যে অধিষ্ঠাত্রী দেবী কনক দুর্গা। চারফুট উঁচু মুর্তির সারা গায়ে ঝলমল করছে অলংকার। তবে দেবী এখানে দশভুজা নন। কনক দুর্গার আটটি হাত। প্রতিটি হাতেই অস্ত্র। পায়ের তলায় ত্রিশূলবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে মহিষাসুর।
কনক দুর্গা মন্দিরের পাশেই রয়েছে মালেশ্বর স্বামীর স্মৃতি সৌধ। পাহাড়ে ওঠার পথে মাঝেমধ্যেই নজর কাড়ে শিব, কৃষ্ণ, কালীর-র মত দেবদেবীর ছবি। মন্দিরের স্থাপত্যে একটা দক্ষিণী ছাপ সুস্পষ্ট। দক্ষিণের মন্দিরগুলো দেখলেই যে ঘরানার স্থাপত্য নজরে পড়ে অনেকটা সেরকম।
বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসবের দিনগুলো নিজের চেনা শহরটায় কাটাতে কার না ভাল লাগে। হয়তো এ আনন্দের বিকল্প হয়না। তবু একটা বছর যদি স্বাদ পাল্টানোর জন্য দুর্গাপুজোটা বাইরে কাটাতে হয় তাহলে অন্তত পুজোর চারটে দিন, অথবা নিদেনপক্ষে দশেরাটা কাটানোর জন্য বিজয়ওয়াড়ার কনক দুর্গা মন্দির অতুলনীয়। নিজেদের চেনা দুর্গাপুজোর থেকে শতশত মাইল দূরে এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা সন্দেহ নেই।
কোথায় থাকবেন?
হোটেল গ্রিন ভ্যালি, গ্রিন ভ্যালি কমপ্লেক্স, কনভেন্ট স্ট্রিট
দ্য গেটওয়ে হোটেল, এম জি রোড
ফরচুন মুরলি পার্ক, এম জি রোড
মার্গ কৃষ্ণা, তারাকাটরু, রামচান্দ্রা নগর, বেঞ্চ সার্কেল
কোয়ালিটি হোটেল, ডিভি মানর, এম জি রোড
হোটেল মমতা, ইলারু রোড
বিক্রম হোটেল, বেঙ্গলি স্বামী স্ট্রিট
শ্রীনিবাস হোটেল, এম জি রোড
এগুলো ছাড়াও শহরের ওল্ড বাজার এলাকায় বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে। স্টেশনের কাছেও মধ্যবিত্তের আয়ত্তের মধ্যেই বেশ কিছু হোটেল আছে। বাণিজ্য নগরী হওয়ায় বিজয়ওয়াড়ায় হোটেলের কোনও অভাব নেই।
কিভাবে যাবেন?
রেল যোগাযোগ – বিজয়ওয়াড়া জংশন সাউথ সেন্ট্রাল রেলওয়ের সবচেয়ে বড় জংশন। কলকাতা থেকে দক্ষিণ ভারতমুখী সব ট্রেনই বিজয়ওয়াড়ার ওপর দিয়ে যায়।
সড়ক যোগাযোগ – অন্ধ্রপ্রদেশ স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের বাস রয়েছে। তাছাড়া বিজয়ওয়াড়া স্টেশন থেকে বেসরকারি বাসের কোনও অভাব নেই। সব দিকেই বাস যাচ্ছে। রয়েছে অটো সার্ভিসের সুবিধাও। বিজয়ওয়াড়া শহরের ছোটখাটো দূরত্বে পৌঁছনোর জন্য সাইকেল রিক্সাও রয়েছে।
বিমান যোগাযোগ – বিজয়ওয়াড়া শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে গানাভারম বিমানবন্দর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিমানে এখানে পৌঁছন সম্ভব।
খুব সুন্দর লাগলো.. জয় মা দুর্গা
Very nice description, liked whole heartedly.