অপরূপা সুন্দরী মা করুণাময়ীর সদাজাগ্রত এক প্রাচীন মন্দির
পাথরের বেদীতে শায়িত মহাদেবের মুখোমুখি দেবী কালিকা। ফালা ফালা চোখ। নাকে টানা দেওয়া নথ। মাথায় রূপোর মুকুট। পায়ে নূপুর। গলায় মুণ্ডমালা।
তৎকালীন প্রসিদ্ধ জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের সিদ্ধপুরুষ ছিলেন নন্দদুলাল রায়চৌধুরী। একসময় তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে আজকের ঠিকানায় ৩২ মহাত্মা গান্ধী রোড (টালিগঞ্জ), কলকাতা-৮২-তে নির্মাণ করলেন করুণাময়ী কালীমন্দির। মন্দিরটি বাংলার নিজস্ব স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে নির্মিত। নবরত্ন মন্দির, একইসঙ্গে দ্বাদশ শিবমন্দির। ১৭৬০ সালে কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করলেন মা করুণাময়ীর শিলাবিগ্রহ।
কালীঘাটের কাছে ‘করুণাময়ী ঘাট রোডের’ কাছে একটি প্রাচীন বটগাছ ছিল সুদূর অতীতে। সাধক নন্দদুলাল স্বপ্নে দেবীর প্রত্যাদেশে ওই গাছের নিচে খুঁজে পান একটি কালো পাথরখণ্ড। তাঁরই কৃপায় পাওয়া গেল এক ভাস্করকে। ঈশ্বর আদিষ্ট ভাস্কর একখণ্ড কষ্টিপাথর থেকে ছেনি হাতুড়ির আঘাতে নির্মাণ করলেন মহাকালের বুকে নয়নাভিরাম মাতৃমূর্তি মা করুণাময়ীর করুণাঘন রূপ।
বড় রাস্তার ধারেই মন্দিরের প্রবেশতোরণে লেখা আছে ১৭৬০ সালে স্থাপিত। মন্দিরঅঙ্গনের দু-পাশে ৬টা করে মোট ১২টা শিবমন্দির। সংরক্ষণ ও যত্নের অভাবে নন্দদুলাল প্রতিষ্ঠিত নবরত্নের মন্দিরটি নির্মাণের পর ১৫০ বছরের মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অনুমান, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরক্ষেত্রে নতুন করে আটচালা দেবীমন্দির নির্মাণ করে দেন নন্দদুলালের উত্তরপুরুষের কোনও এক বংশধর।
নাটমন্দিরযুক্ত দেবীমন্দিরের গর্ভগৃহে স্থাপিত বিগ্রহ মা করুণাময়ী। পাথরের বেদীতে শায়িত মহাদেবের মুখোমুখি দেবী কালিকা। ফালা ফালা চোখ। নাকে টানা দেওয়া নথ। মাথায় রূপোর মুকুট। পায়ে নূপুর। গলায় মুণ্ডমালা। সবসনা দেবী অপরূপা। হাতে শাঁখার সঙ্গে সোনার বালা। দেবী জাগ্রত বলে খ্যাতি আছে। নবকলেবরে মন্দির নির্মাণ করা হলেও মন্দিরের শিবলিঙ্গ ও করুণাময়ীর শিলাবিগ্রহ আদি ও অকৃত্রিম। এর কোনও পরিবর্তন করা হয়নি।
বর্তমান মন্দিরে আগে ছাগবলি দেওয়া হত। ২০০২ সালের দীপান্বিতা কালীপুজোর দিন থেকে বলিপ্রথা বন্ধ হয়। প্রতি অমাবস্যায় মায়ের বিশেষ পুজো ও হোমযজ্ঞাদি হয়। ঘটা করে পুজো সুসম্পন্ন হয় কার্তিকের অমাবস্যায়। এ ছাড়া বারো মাসে তেরো পার্বণ তো লেগেই আছে। ভোর ৬টায় মন্দির খোলা হয়, বন্ধ হয় দুপুর ১২টায়। বিকেল ৪টে থেকে খোলা থাকে রাত ১০টা পর্যন্ত।
মা করুণাময়ীকে নিয়ে কয়েকটি জনশ্রুতি এইরকম — একবার মন্দির সংলগ্ন পুকুরের স্নানঘাটে একজোড়া সোনার নূপুর পাওয়া গেল। পেয়েছিলেন স্থানীয় এক সধবা মহিলা। স্নান সেরে ঘাট থেকে উঠে আসার সময় তাঁর নজরে পড়েছিল। তিনি নূপুরজোড়া এনে তৎকালীন মায়ের সেবাইত শ্রদ্ধেয় অসিত রায়চৌধুরীর হাতে তুলে দেন। তখন তিনি মায়ের বিগ্রহটির কাছে ছুটে গিয়ে দেখেন সত্যিই কোনও নূপুর নেই মায়ের রাঙাচরণে। সেবাইত কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না পায়ের নূপুর গেল কি করে স্নানঘাটে!
সেই রাতেই মা করুণাময়ী সেবাইতকে স্বপ্নে জানালেন, এটা চুরির কোনও ঘটনা নয়। মা পুকুরে স্নান সেরে মন্দিরে আসার সময় ভুল করে নূপুরজোড়া ফেলে এসেছিলেন ঘাটে।
একসময় মন্দিরের আশপাশ ভরা ছিল ঝোপজঙ্গলে। তখন গ্রামের স্থানীয় মানুষেরা মন্দিরসংলগ্ন এলাকায় প্রাতঃকৃত্য করে চলে যেত। এইভাবে দিনের পর দিন চলতে লাগল। কথিত আছে, একটি ভৌতিক ছায়া, মতান্তরে কোনও এক অদৃশ্য মহাপুরুষের পদচারণা শুনতে পায় গ্রামবাসীরা। ফলে ভয়েতে তারা তখন থেকে বন্ধ করে দেয় শৌচকর্মাদি। এমন নানান কথা আজও লোকমুখে শোনা যায় টালিগঞ্জের সদাজাগ্রত দেবী কালী করুণাময়ী মাকে নিয়ে।