১৬টি মন্দির, একটিতেও দেবদেবীর বিগ্রহ নেই, রহস্যেঘেরা এক অজানা শৈবতীর্থ
এক তীর্থের কথা, যাতে তীর্থস্থানটির প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়ে, রুচি আসে। প্রায় ১৪০০ বছর আগে এই তীর্থের আবিষ্কার করেছিলেন এক মহাত্মা।
সারাজীবনে পাঁচ হাজার পথচলতি রমতা সাধুর সঙ্গ করেছি। তাদের অনেকের মুখে শুনেছি নানা তীর্থের বিবরণ, মাহাত্ম্যের কথা, পুরাণের কথা। শুনে অভিভূত হয়েছি। সাধু সন্ন্যাসীদের বলা সেসব তীর্থে অনেকেই যায় না। অনেকে জানেই না। যারা জানে তাদেরও অনেকের যাওয়ায় অরুচি। এখানে তেমনই এক তীর্থের কথা বলা হল, যাতে তীর্থস্থানটির প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়ে, রুচি আসে। যাত্রাপথ কাটারমলের সূর্যমন্দির হয়ে গণনাথ।
জিপ ভাড়া করলাম। কাটারমল আর গণনাথ হয়ে পৌঁছে দেবে কৌশানি। বাসে বা মারুতিতে কাটারমলে যাওয়ার কোনও অসুবিধে নেই তবে গণনাথের পথ জিপ ছাড়া অন্য কোনও যানের উপযুক্ত নয় বলে জানালেন ড্রাইভার।
আলমোড়া-কৌশানির পথে জিপ একটানা ১৪ কিমি চলার পর থামল। পাহাড়ের উপর কাঁচা একটা রাস্তা দেখিয়ে ড্রাইভার বললে, এ পথ গিয়েছে কাটারমল সূর্যমন্দির পর্যন্ত। রাস্তা খারাপ। জিপ যাবে না। উঠতে হবে পায়ে হেঁটে। সঙ্গীসহ নেমে এলাম জিপ থেকে। ড্রাইভার রইল আমাদের আসার অপেক্ষায়।
এবার শুরু হল চড়াই। পাথুরে পথে কখনও মাটি, কখনও ধুলো। এ পাহাড়ে সবুজের নামগন্ধ যেটুকু আছে তা না থাকারই মতো। নেড়া পাহাড়। রুক্ষ চুলের মতো। প্রায় ২ কিমি চড়াই ভেঙে ওঠার পর পেলাম ছোট্ট একটি জনপদ। স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই বহু দূরে পাহাড়ের আরও উপরে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কাটারমল সূর্য মন্দির। চড়াই উতরাই করতে করতে গেল আরও প্রায় ১ কিমি। এসে দাঁড়ালাম সূর্য মন্দির প্রাঙ্গণে।
এখানকার মূল মন্দিরটি সূর্যদেবের। আকারে বড়, এই মন্দিরটিকে ঘিরে ডাইনে বাঁয়ে সামনে আরও ১৬টি মন্দির। কোনওটা ছোট কোনওটা বেশি বড় নয়, মাঝারি আকারের। এর একটিতেও কোনও দেবদেবীর বিগ্রহ নেই।
টুক টুক করে এসে দাঁড়ালাম সূর্যমন্দিরে। পাশেই বিশাল একটি অশ্বত্থ গাছ। বড় বড় পাথরের চারকোনা স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে নাটমন্দির। গর্ভমন্দিরে বসা অবস্থায় পাথরে নির্মিত সূর্যদেবের বিগ্রহ। সুদর্শন চতুর্ভুজ মূর্তিটি আকারে ছোট। এর এক পাশে ইজিচেয়ারে হেলান দেওয়ার কায়দায় আরও কয়েকটি দেববিগ্রহ। দু-একটি ছাড়া অধিকাংশই ক্ষতবিক্ষত। পূজারি জানালেন, অনেকগুলি মূর্তি চুরি হয়ে গিয়েছে, তাই অন্য মন্দির থেকে বিগ্রহগুলি এনে রাখা হয়েছে এখানে। এর দরজা আছে, ওগুলির নেই।
আলমোড়া ছাড়ার পর কোশী আমাদের সঙ্গিনী। এর দু’ধারের দিগন্ত-বিস্তৃত অজস্র গাছ। নিঃশব্দ ছন্দে কোশী চলেছে কোমর দুলিয়ে দুলকি চালে। ছিপছিপে সুন্দরী কোশীর যৌবনের কোনও উদ্দামতা নেই এখানে। শান্ত স্বপ্নের মতো নীল। কোশী আমাদের সঙ্গে চলছে পাশাপাশি- কখনও ডাইনে, কখনও বাঁয়ে। মাইলস্টোনে চোখে রাখতে রাখতেই এসে গেলাম আরও ১৭ কিমি। সরাসরি আলমোড়া থেকে ধরলে ৩৪ কিমি। এবার ডানদিকের জিপ ছোট্ট একটা পুল পার হয়ে পিচের রাস্তা ধরে এল আরও ৩ কিমি। পাহাড়ের শিরদাঁড়া বেয়ে জিপ ক্রমশ উঠতে লাগল আরও উপরে। কাঁচা পথ। জিপ ছাড়া অন্য কোনও বাহনের ওঠার উপায় নেই। শুরু হল গভীর ঘন জঙ্গল। আঁকেবাঁকে হাজার হাজার চিরগাছ ঝকঝক করছে। কুমায়ুনের গাম্ভীর্যই আলাদা।
মনটা ভরে উঠল এই অপূর্ব মাদকতায়। প্রতিদিনের বাঁধাধরা একঘেয়ে জীবনের বাইরে বেরলেই ভ্রমণ। ভ্রমণে মনের আরাম, প্রাণের ক্ষুধা নিবৃত্তি হয়। দুর্গম পথে ভ্রমণে রোমাঞ্চ আর আনন্দ বড় বেশি, তবে এ পথ এখন আর মোটেই দুর্গম নয়। তা হলেও পাহাড়ি পথের আকর্ষণই আলাদা। অনন্তের মৌন ইতিহাস যেন এখানেই লেখা আছে। এ পথের নির্জনতায় আছে জমিদারি আভিজাত্য।
একটানা ১২ কিমি পথ পিছনে ফেলে জিপ এসে দাঁড়াল পাহাড় অরণ্যের ঘাঁটিতে, একটু সমতলে। ড্রাইভার পথের নির্দেশ করল আঙুল উঁচিয়ে। এবার শুরু হল হাঁটা। জিপ যাবে না। খানিকটা হাঁটার পর সমানে উতরাই। পা টিপে টিপে নামতে লাগলাম নিচে। পাশেই দুর্ভেদ্য জঙ্গল। প্রায় ১ কিমি নামার পর একেবারে এসে গেলাম গণনাথের হাতের মুঠোয়। ছোট্ট একটা দরজা পার হয়ে পরপর কিছু সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলাম আরও নিচে। প্রথমে বাঁয়ে পড়ল দত্তাত্রেয় মন্দির। আরও একটু এগতেই শুরু হল পাহাড়ি গুহা। গুহা বলতে অনেকটা জায়গা জুড়ে পাহারের গা খাবলে নিয়ে যেমনটা হয়, তেমনই। নিরাভরণ গুহামন্দির। একেবারে মেঝের সঙ্গে প্রায় মিশানো কালো পাথরের শিবলিঙ্গ একটু মুখ তুলে চেয়ে আছে উপরে। গুহার উপরে ঝোলানো পিতলের একটা পাত্র থেকে জল পড়ছে টপ টপ করে। শিবলিঙ্গের পাশে একে একে রয়েছে গণেশ, নারায়ণ আর মহাদেবের সুদর্শন বিগ্রহ। চেহারায় প্রতিটি মূর্তিই প্রাচীন।
গুহামন্দিরের সামনের দিকেই পরপর কয়েকটি ঘর। এর একটিতে ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধ সাধুবাবা। কথায় জানলাম বয়স ৭২। মাথায় জটা নেই। পরনে গেরুয়া বসন। সৌম্য শান্ত চেহারা। চুল দাঁড়িতে মহাকাল এক কৌটো সাদা বার্নিশ ঢেলে দিয়েছে। প্রণাম করে বসলাম মুখোমুখি হয়ে। জানতে চাইলাম স্থানের অতীত কথা। প্রশান্ত গম্ভীর কণ্ঠে সাধুবাবা জানালেন, ‘বেটা, প্রায় পঞ্চাশ বছরের ওপর পড়ে আছি এখানে। কোনও ঐতিহ্য নেই এই পাহাড়ি শৈবতীর্থে, নেই ইতিহাসের কোনও অনুসন্ধান। আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগে এই তীর্থের আবিষ্কার করেছিলেন শ্রীবল্লভ উপাধ্যায় নামে এক মহাত্মা। শিবলিঙ্গের নাম গণনাথ। স্থানের নাম হয়েছে তাঁরই নামে।’