আশ্বিনে মহালয়ার মধ্যে দিয়ে যে উৎসবের সূচনা হয়েছিল, কার্ত্তিকে তার শেষটা একেবারেই বাঙালির মনের মতো হল না। ‘মা গো আনন্দময়ী, নিরানন্দ কোর না’, ভক্তদের এই প্রার্থনা কিন্তু পুরোপুরি শুনলেন না মাকালী। তাই দীপান্বিতার আগমনে ডাকিনী-যোগিনীর মতোই তাঁর অনুচর হয়ে বঙ্গে প্রবেশ করে নিম্নচাপ। যা ভাসিয়ে নিয়ে গেল আলোর উৎসবকে।
কলকাতার বেশ কিছু নামজাদা বারোয়ারি কালীপুজোর উদ্যোক্তারা বছরভর অনেক পরিকল্পনা করেন এই কটা দিনের অপেক্ষায়। কিন্তু অপ্রত্যাশিত এই বৃষ্টি মহানগরীর দর্শনার্থীদের ঘোরার আনন্দটাকেই মাটি করে দিল এবার। ফাটাকেষ্টর মণ্ডপ সেজে উঠেছিল বেলুড় মঠের আদলে।। কিন্তু শহরের এমন এক নামজাদা পুজোয় কার্যত দর্শকের ভিড় তেমন হলই না। পুজো প্রাঙ্গনে অপরিসর নিচু গলির মধ্যে জমে যায় জল। বৃষ্টির জন্য খুব বেশি মানুষও পৌঁছাতে পারেননি এখানে।
সোমেন মিত্রের পুজো মণ্ডপের সামনে কর্তব্যরত পুলিশকর্মী জানালেন বৃষ্টির ফলে ঠাকুর দেখার ভিড় বেশ খানিকটা মার খেয়েছে। আবার বৃষ্টি থামলে কিছু মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করেই পুজো দেখতে এসেছিলেন। তবে অনেকটাই মার খেয়েছে এই পুজোকে কেন্দ্র করে রাস্তার দুধারে বসা মেলা। এই পুজোর কাছেই ৭৫ বছরে পা দেওয়া পপুলার ফ্রেন্ডস ক্লাবের পুজো। বৃষ্টি খানিক ক্ষতি করেছে মণ্ডপের। দর্শনার্থীর সংখ্যাও অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেকটাই কম হয়েছে। প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীতে তাদের উদ্যোগ অনেকটাই মাঠে মেরে দিল বৃষ্টি।
এখান থেকে একটু এগোলেই মহাত্মা গান্ধী রোড ক্রসিং। সেটা ছাড়িয়ে ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার দিকে এগোলে নজরে পড়ে পরপর কালীপুজোর মণ্ডপ। ট্রাম লাইনের পাশের ফুটপাথ জুড়ে রয়্যাল ক্লাবের পুজো। প্রতিমার টানে অনেকেই এখানে পুজো দেখতে আসেন। কিন্তু মেঘলা দিনের ফাঁকা প্যান্ডেল বুঝিয়ে দিল পুজোর দিনগুলো কেটে গিয়ে কোথাও যেন উদ্যোক্তাদের মধ্যেও উৎসাহে টান পড়েছে।
আমহার্স্ট স্ট্রিট বালক সংঘের পুজোর মঞ্চে দেখা মিলল এক নিরাপত্তা রক্ষীর। উদ্যোক্তাদের এখানেও তেমন একটা দেখা পাওয়া গেল না। অগত্যা নিরাপত্তারক্ষীই ভরসা। তিনি জানালেন শেষ দুদিনে যখনই বৃষ্টি বিরতি নিয়েছে তখনই মানুষের ভিড় চোখে পড়েছে। ৪৮-এর পল্লী যুবশ্রীতে ভাইফোঁটার সকালেও গুটিকতক দর্শকের দেখা মিলল। এ পুজোও হয় ট্রাম লাইনের পাশের ফুটপাথ জুড়ে। বেশ কিছু বছর ধরেই মানুষের অন্যতম আকর্ষণ এখানকার বিশালাকায় প্রতিমা। কিন্তু বৃষ্টিতে এখানেও মানুষের দেখা নেই। পথচলতি মানুষজনকে দেখা গেল মায়ের দিকে চেয়ে কপালে আঙুল ঠেকাতে।
জানবাজারের জাগরণীর এ বছরের থিম ছিল রাণী রাসমণির ২২৫ তম জন্মদিবস পূর্তি। পুরনো পুজো। কলকাতার অন্যতম সেরা পুজোর তালিকায় অবশ্যই এই পুজো জায়গা পেয়েছে। সুদৃশ্য প্যান্ডেলে সুউচ্চ মাতৃপ্রতিমা অবস্থান করছেন। ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি এখানকার আনন্দেও থাবা বসিয়েছে। ফাঁকা প্যান্ডেলে উদ্যোক্তাদের দেখা এখানেও অমিল। দর্শনার্থীও তেমন নেই। স্থানীয়রা জানালেন, সন্ধের দিকে যদি বৃষ্টি থামে, তাহলে হয়তো কিছু মানুষের আনাগোনা হলেও হতে পারে।
আলোর উৎসব দীপাবলির খুশিতে অনুঘটকের কাজ করে আতসবাজির রোশনাই। আতসবাজি ছাড়া দীপাবলি অসম্পূর্ণ। কিন্তু সেই আতসবাজির দেখা মিলল কই! কালীপুজোর দিন সন্ধে থেকেই আবহাওয়ার মেজাজ বদল আতসবাজি পোড়ানোর উৎসাহে ভাটা ফেলেছিল। অনেকেই আবহাওয়ার কারণে কিছু বাজি পুড়িয়ে গুটিয়ে ফেলেছিলেন বাজির ব্যাগ। কারণ স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া আর প্রবল ঝোড়ো হাওয়ার দাপট। কলকাতায় ক্রমাগত ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি যেমন মিইয়ে দিয়েছিল পুজো দেখার মেজাজকে। ঠিক তেমনিই আতসবাজির রোশনাই আকাশের মুখ আলো করল নামমাত্রই।
উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল বা হুগলির শ্রীরামপুর ও তার সংলগ্ন অঞ্চলেরও পিছু ছাড়েনি বৃষ্টি। কিন্তু বর্ষণের ফাঁক-ফোঁকরেই দেখা গিয়েছে আকাশ রাঙানো কিছু বাজির রোশনাই। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মানুষ বাড়ির ছাদ বা উঠোনে বাজি পুড়িয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন।
বৃষ্টিস্নাত হয়েই শেষ হল এবারের শ্যামাপুজো ও দীপাবলি উৎসব। প্রকৃতির উপর কারও হাত নেই। তবে সকলের একটাই প্রার্থনা, আগামী বছর যেন শক্তির আরাধনায় এরকম বিঘ্ন না ঘটে।