প্রলয়, ঝঞ্ঝা, তাণ্ডব ক্যাপ্টেন হ্যাডক হলে ঠিক কি বলতেন জানা নেই। তবে মঙ্গলবার সন্ধেয় কলকাতা যা দেখল তা ব্যাখ্যা করতে কোনও একটা বিশেষণ যথেষ্ট নয়। এমন সর্বগ্রাসী প্রলয়ঙ্করী ঝড় কলকাতা অনেককাল দেখেনি। কালবৈশাখী হয়েছে বটে। কিন্তু তার প্রলয় তাণ্ডব এমন ভয়ংকর রূপ নেয়নি। টানা দু’দিন অসহ্য গরমে নাজেহাল শহরবাসী মনেপ্রাণে চাইছিলেন একটা ঝড়বৃষ্টি হোক। সেই ঝড় যখন সত্যিই এল তখন বহু মানুষের বাড়িতে বসেই বুক কেঁপেছে। ভয়ে হৃদয় তাঁর অজান্তেই যেন শরীর থেকে বেরিয়ে খাটের তলা বা আলমারির পিছনে জায়গায় নেয়। একেই বোধহয় বলে আতঙ্ক! সাধ করে চাওয়া ঝড় কখন থামবে তারজন্য ইষ্টনাম জপেছেন বহু শহরবাসী।
আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানাচ্ছে, মঙ্গলবার ঝড়ের সর্বাধিক গতি ছিল ৯৮ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। যা ৭টা ৫৫ মিনিট নাগাদ কলকাতার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। ঝড়ের গতিতেই বোঝা যাচ্ছে তাণ্ডবের মাত্রা কেমন ছিল। এদিন বিকেল থেকেই আকাশে মেঘের সঞ্চার হচ্ছিল। সন্ধে নামতেই শুরু হয় মেঘের গর্জন। সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানি। শুধু কলকাতা বলেই নয়, দক্ষিণবঙ্গের বাঁকুড়া, হাওড়া, হুগলি, ২ বর্ধমান, উত্তর ২৪ পরগনা সহ আশপাশের এলাকায় প্রবল ঝড় শুরু হয়। কলকাতার রাস্তায় তখন অফিস ফেরত মানুষের ঢল। রাত পোহালেই অক্ষয় তৃতীয়া। ফলে তার তোড়জোড়ের একটা ভিড়ও ছিল। এর মধ্যেই আচমকা ঝড়ে শুরু হয় লণ্ডভণ্ড অবস্থা। রাস্তায় কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়তে থাকে ধুলো। অগুন্তি গাছ ভেঙে পড়তে থাকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি বা মানুষের ওপরও এদিন গাছ উপড়ে পড়ে। অনেক বাড়ির জানালার কাচ ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। ল্যাম্পপোস্ট ভেঙে আছড়ে পড়ে রাস্তায়। টিনের চাল অনেক জায়গায় উড়ে যায়। বিশালাকায় বিজ্ঞাপনের ফ্লেক্স ছিঁড়ে কুটিকুটি হয়ে যায়। রাস্তায় থাকা মানুষ কার্যত প্রাণভয়ে ছুটে দোকান, গাড়ি বারান্দা বা বাড়ির তলায় মাথা গোঁজেন। ঝড়ের প্রলয় কিছুক্ষণ চলার পরই নামে বৃষ্টি। সঙ্গে ঝড় চলতে থাকে নিজের মত। রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় বাস, গাড়ি, বাইক দাঁড়িয়ে পড়ে। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মত জায়গায় সবদিক থেকে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ১৫ মিনিট ঝড় আর তার সঙ্গে ঝাপসা করা প্রবল বৃষ্টির চোটে কোনও গাড়ি নিজের জায়গা থেকে নড়েনি। এরপর ঝড়ের দাপট কিছুটা কমলে যান চলাচল ফের শুরু হয়।
যান চলাচল শুরু হতেই বোঝা যায় এতক্ষণ যে তাণ্ডব শহরজুড়ে চলেছে তার ফল কি হয়েছে! গোটা শহরটাকে এদিন কার্যত তছনছ করে দেয় বছরের তৃতীয় কালবৈশাখী। বিভিন্ন রাস্তায় গাছ পড়ে যান চলাচল প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে যায়। বিটি রোডের বহু যায়গায় গাছ পড়ে রাস্তার একদিক বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ডিভাইডারের অন্যদিকের দিক দিয়ে যাতায়াত দুটোই চলেছে। যার জেরে মন্থর হয়েছে যান চলাচল। যা টবিন রোডের পরে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। টবিন রোড ও অনন্যা সিনেমা হলের কাছে গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে দীর্ঘক্ষণ শ্যামবাজারমুখী কোনও গাড়ি আসতে পারেনি। চরম হয়রানির শিকার হন মানুষজন।
এদিনের ঝড়ে এখনও পর্যন্ত কলকাতায় ৪ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। অশোকা সিনেমা হলের সামনে একটি গাছ ভেঙে এক পথচারীর ওপর পড়ে। আশঙ্কাজনক অবস্থা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। এছাড়া লেনিন সরণির ওপর বাড়ি ভেঙে পড়ে মৃত্যু হয় ২ জনের। আনন্দপুরেও ১ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। এখনও জেলার ক্ষয়ক্ষতি পরিস্কার নয়। তবে যেটুকু খবর তাতে জেলায় ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভেঙেছে অগুন্তি গাছ। ভেঙেছে বাড়িও। প্রচুর আমের ক্ষতি হয়েছে। গাছ ভরা আমের অনেক আম ঝরে গেছে ঝড়ে।
এদিনের ঝড়বৃষ্টিতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে শিয়ালদহ শাখায় ট্রেন চলাচল। শিয়ালদহ থেকে বনগাঁ, ডানকুনি অথবা মেন লাইন, সর্বত্রই স্তব্ধ ছিল পরিষেবা। ট্রেন ছিল বন্ধ। ফলে হাজার হাজার বাড়ি ফেরত মানুষ স্টেশনে স্টেশনে হাপিত্যেশ করে অপেক্ষা করতে থাকেন। একইভাবে বিপর্যস্ত হাওড়া শাখায় ট্রেন চলাচল। সেখানে আবার বিদ্যুৎ বিপর্যয় পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। বন্ধ হয়ে যায় মেট্রোর আংশিক চলাচলও। দমদমে মেট্রোর লাইনে গাছ পড়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। নোয়াপাড়া থেকে গিরিশ পার্ক পর্যন্ত বন্ধ ছিল মেট্রো চলাচল। সন্ধের পর বিমান চলাচলও বিঘ্নিত হয়।
ঝড়ের পরই রাস্তা থেকে ভেঙে পড়া গাছ বা ল্যাম্পপোস্ট সরানোর কাজে নেমে পড়েন পুরসভার কর্মীরা। মুখ্যমন্ত্রী নিজে গোটা পরিস্থিতির খোঁজখবর নেন। দ্রুত অবস্থা স্বাভাবিক করতে পুরসভাকে তৎপরতার সঙ্গে কাজে নেমে পড়ার নির্দেশ দেন তিনি।