কুমারী পুজোয় কি ফল লাভ হয়
কুমারী পুজোর প্রচলন মহাভারতীয় যুগ থেকে শুরু করে আজও ভারতের নানা প্রান্তের মঠমন্দিরে, এমনকি কামাখ্যা ও নেপালেও এই পুজো হয়ে আসছে মহাসমারোহে।
মহাভারতীয় যুগ। আনুমানিক ৪৪৫০ বছর আগের কথা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে দুর্যোধনের সৈন্য যুদ্ধের জন্য সমরাঙ্গনে উপস্থিত হয়েছে দেখে যুদ্ধবিজয়ের উদ্দেশ্যে শ্রীকৃষ্ণ রথে বসে ভদ্রকালীর বন্দনার উপদেশ দিলেন অর্জুনকে। মহাবাহু অর্জুন যুদ্ধরথ থেকে নামলেন সমরাঙ্গনে। কৃতাঞ্জলি হয়ে বন্দনা করলেন,
“সিদ্ধসেনানি! আর্য্যে! মন্দরবাসিনি! কুমারি! কালি! কাপালি! কপিলে! কৃষ্ণপিঙ্গলে! আপনাকে নমস্কার করি।।
ভদ্রকালি! আপনাকে নমস্কার, মহাকালি! আপনাকে নমস্কার, চণ্ডি! চণ্ডে! তারিণি! বরবর্ণিনি! আপনাকে নমস্কার।।”
(মহাভারতম্, ভীষ্মপর্ব, ত্রয়োবিংশোহধ্যায়ঃ, পৃষ্ঠা – ১৮৫)
মহাভারতে অর্জুনের ভদ্রকালীর বন্দনার কথা যেমন আছে, তেমনই উল্লেখ আছে অর্জুনের কুমারী পুজোর কথা। সুতরাং কুমারী পুজোর প্রচলন মহাভারতীয় যুগ থেকে শুরু করে আজও ভারতের নানা প্রান্তের মঠমন্দিরে, এমনকি কামাখ্যা ও নেপালেও এই পুজো হয়ে আসছে মহাসমারোহে। এদেশে মন্দির নির্মাণ করে দেবী পার্বতীকে কুমারী মূর্তিতে পুজোর প্রচলন সম্ভবত দক্ষিণ ভারতে কন্যাকুমারীতে। কিভাবে এবং কেমন করে এর শুরু?
পুরাণ, ইতিহাস, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর শিল্পের ডালিভরা কন্যাকুমারী। ভারতের পর্যটন মানচিত্রে দক্ষিণের শেষ প্রান্তভূমি। কাশী শিবের বাসগৃহ, শক্তির আবাসস্থল কন্যাকুমারী। তিন সাগরের মহামিলন ঘটেছে এখানে। পূর্বে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে আরব সাগর, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর-অতলান্ত এই সাগর ত্রয়ীর তরঙ্গ সর্বদাই ধুয়ে দিচ্ছে সাগরতটে পরাশক্তি দেবী কন্যাকুমারীর চরণযুগল। সুদূর মহীশূর থেকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালাও এসে স্নান সেরেছে কন্যাকুমারীর সাগরজলে।
এমনই একটি সৌন্দর্যে মোড়া ক্ষেত্রেই একসময় পার্বতী আবির্ভূত হয়েছিলেন কুমারী মূর্তিতে। পুরাণের কাল। কঠোর কঠিন তপস্যায় প্রীত ব্রহ্মার বরে ত্রিলোক জয় করলেন বার্ণাসুর। আক্রমণ করলেন দেবলোক। শরণাগত দেবকুলের হয়ে বিষ্ণুর পরামর্শে যজ্ঞ করলেন দেবরাজ ইন্দ্র। যজ্ঞাগ্নি থেকে জন্ম হল এক কন্যার। অজেয় বার্ণাসুরকে বধ করার শক্তি রয়েছে এই কুমারী কন্যার। এ কথা জানিয়ে দিলেন ভগবান শ্রীবিষ্ণু।
জন্মের পর কুমারী কন্যা চলে গেলেন দক্ষিণের সাগরতীরে। নীলকণ্ঠ মহাদেবকে স্বামীরূপে পাওয়ার উদ্দেশ্যে বসলেন তপস্যায়। আকুল আকুতিতে সাড়া দিলেন মহাদেব।
এদিকে বিবাহে বাধ সাধতে তৈরি হলেন দেবর্ষি নারদ। বিবাহ হলে কুমারী যদি না থাকেন দেবী তবে বার্ণাসুর নিধন হবে কীভাবে? দেবর্ষির মন্ত্রণায় কুমারীকন্যা মহাদেবের কাছে চাইলেন তিনটি দুর্লভ বস্তু। চক্ষুহীন নারকেল, শিরাহীন তাম্বূল আর গ্রন্থিহীন ইক্ষু। একই সঙ্গে শর্ত আরোপ করলেন, রাত্রিকালেই বিবাহ করতে হবে। সূর্যোদয় হলে তিনি অরক্ষণীয় হয়ে থাকবেন।
অসাধ্য সাধন করে যথাসময় কন্যার প্রার্থিত বস্তুগুলি সংগ্রহ করলেন মহাদেব। বিবাহের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট দিনে যাত্রা করলেন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে। কন্যাকুমারী থেকে অল্প দূরত্বেই শুচিন্দ্রম। দেবর্ষি নারদ বিভ্রান্ত করলেন মহাদেবকে। মহাদেবের চলার পথে গভীর রাতেই ডাকলেন মোরগের ডাক। বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে গেলেন মহাদেব শুচিন্দ্রমে। ভাবলেন ভোর হয়ে গিয়েছে। আর অগ্রসর হলেন না। মহাদেব রয়ে গেলেন শুচিন্দ্রমে।
এদিকে দেবী কুমারীর আকুল প্রতীক্ষার অবসান হল সূর্যোদয়ে। সাগরের ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেল বিবাহের সমস্ত উপচার। নারদের ইচ্ছা পূরণ হল বিষ্ণুর করুণায়। যথাসময়ে বার্ণাসুরকে বধ করলেন দেবী কুমারী। দেবী বার্ণাসুরের অন্তিম প্রার্থনায় তাঁর দেহরক্ষার স্থানটিকে বাণতীর্থ নামে প্রচারিত করলেন তিনলোকে। সে তীর্থ আজও আছে এখানকার সাগরতীরে। এ সব কথা ও কাহিনি স্কন্দপুরাণের অন্তর্গত কুমারিকাখণ্ডের। এ কথাই দেবীর আবির্ভাব কথা।
দক্ষিণভারতের আর সব সুবিশাল মন্দিরের মতো নয়, কন্যাকুমারী মন্দির একেবারেই অনাড়ম্বর। প্রবেশদ্বারটি বেশ বড়। কাঠের দরজা পেরিয়ে একটু এগোলেই অনেকটা জায়গাজুড়ে হল ঘর। এর নাম নবরাত্রিমণ্ডপম্। এখানে পুরুষদের খালি গা হতে হয়। উন্মুক্ত গায়েই দেবীর দর্শন করার বিধি। এটা পেরোলেই দ্বিতীয় দালান। এখানে স্থাপিত বিগ্রহ কালভৈরবের, রয়েছে মন্দিরের ধ্বজস্তম্ভ।
এবার এসে দাঁড়ালাম গর্ভমন্দিরের সামনে। অসংখ্য ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে প্রদীপদানিতে। প্রদীপের আলোয় আলোময় গর্ভমন্দির। দুটি অংশে বিভক্ত মন্দির। দ্বিতীয় অংশের বেদি অলংকৃত দেবী কুমারীকন্যার বিগ্রহের। মাঝারি আকারের দাঁড়ানো বিগ্রহ। নাকে দেশোয়ালিদের মতো নথ। হীরের নথ যেন জ্বলন্ত আগুনের স্ফুলিঙ্গ। জপের মালা ডানহাতে। উরুর উপরে বাম করতল। দেবীমূর্তিতে বয়েসের ছাপ নেই। বালিকা মূর্তি। দাঁড়িয়ে আছেন পদ্মের উপরে। ধূসর পাথরের (গ্রানাইট) বিগ্রহ। সুনীল টানাটানা চোখ। মোহিনী রূপ। মাথায় বহু মূল্যের রত্নখচিত মুকুট। দেখতে অনেকটা টোপরের মতো। প্রদীপের আলো সম্বল করেই গর্ভমন্দির।
মন্দিরের চারপাশ ঘিরেই মন্দির পরিক্রমার পথ। বাঁ দিক থেকে প্রথমে পড়ে গণেশের, পরে মন্দিরচত্বর ছেড়ে মন্দিরপ্রাঙ্গণের পিছনের একটি কক্ষে নারায়ণের একটি সুদর্শন বিগ্রহ।
আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে সাগরতীরে এখানে বসেই দেবীদর্শনে ভাবাবেশে চোখের জলে বুক ভাসিয়েছিলেন শচীনন্দন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য।
কন্যাকুমারী মন্দির থেকে মিনিট তিনেকের পথ স্টিমার ঘাট। স্টিমারে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এসে গেলাম ‘বিবেকানন্দ রক’-এ। বিবেকানন্দের স্মারক মন্দিরটি ‘শ্রীপদপরই’ নামে পাহাড় তথা শিলাখণ্ডের উপরেই স্থাপিত, যেটি আজ বিবেকানন্দ রক নামে প্রসিদ্ধ। তিন একর ভূখণ্ডবিশিষ্ট বিবেকানন্দ রকটি সমুদ্রদ্বারা বিচ্ছিন্ন। সমুদ্রতল থেকে ৫৫ ফুট উপরে।
অল্প কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভাঙলেই পাথরে বাঁধানো অনেকটা এলাকা জুড়ে চতুর। দুটি ভাগে বিভক্ত এটি। একটি শ্রীপদ মণ্ডপ, অপরটি হল ঘর সমন্বিত সভা মণ্ডপ ও ধ্যান মণ্ডপ। নাটমন্দিরমুক্ত শ্রীপদ মণ্ডপ। শ্বেতপাথরের মন্দির। চারপাশ লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। ভিতরে দেখছি একটি বড় পাথরখণ্ডের উপরে কাচের ঢাকনা দেওয়া। এর নীচে পাথরের উপরে দেবীর পদচিহ্ন। কথিত আছে, পুরাণের মহাদেবকে স্বামীরূপে লাভ করার জন্য দেবী কুমারীকন্যা তপস্যা করেছিলেন এখানে। শ্রীপদ মণ্ডপটি নির্মিত চোল স্থাপত্যশৈলীতে।
শুচিন্দ্রমের মন্দিরক্ষেত্রে রয়েছে কুমারী কন্যার একটি মন্দির। কন্যাকুমারীতে দেবী কুমারীকন্যা মহাদেবকে স্বামীরূপে লাভ করার আশায় তপস্যারত ছিলেন। কৈলাসে বসে দেবীর এই তপস্যার কথা জানতে পারেন মহাদেব। বিবাহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন কন্যাকুমারীর পথে। কিন্তু দেবর্ষি নারদের চক্রান্তে শুচিন্দ্রমেই গতি রুদ্ধ হয় মহাদেবের। মাইল আষ্টেক পথ শুচিন্দ্রম থেকে কন্যাকুমারী। সেখানে আর পৌঁছন হল না। শুচিন্দ্রমেই রয়ে গেলেন মহাদেব। মহাদেবের সঙ্গে পার্বতী কুমারীর মিলন না হওয়ার তিনি তপস্যারত হলেন কন্যাকুমারীতে। তাই এখানে অভিমানিনী কুমারী কন্যা মন্দিরে দাঁড়িয়ে আছেন পিছন ফিরে।
স্বত্ত্বঃ, রজঃ, তমঃ – এই তিন গুণভেদে পুজো সুসম্পন্ন হয় তিন রকমভাবে। সাত্ত্বিক পুজোর প্রধান উপকরণ নিরামিষ। জপ যজ্ঞ থাকে একই সঙ্গে। রাজসিক পুজোর উপকরণ আমিষ। পুজোয় থাকে পশু বা পাখি বলির ব্যবস্থা। জপ যজ্ঞ হোম ও মন্ত্রের কোনও ব্যবস্থা নেই তামসিক পুজোয়। এই পুজোর প্রধান উপকরণ হল মদ ও মাংস।
কুমারী পুজো মূলত সাত্ত্বিক পুজোর অঙ্গবিশেষ। এক থেকে ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত অবিবাহিতা কন্যা এবং ঋতুমতী না হওয়া কুমারীই প্রধানত এই পুজোর যোগ্য।
কুমারী পুজোয় বিভিন্ন বয়েসের কন্যাকে পুজো করা হয় বিভিন্ন নামে। এই পুজো দুর্গাসপ্তমী অষ্টমী ও নবমী তিথিতে কুমারী বালিকাকে পুজো করা হয় দেবী জ্ঞানে।
তান্ত্রিক মতবাদের প্রতিফলন বলে সমস্ত শক্তিপীঠেই কুমারী পুজো করা হয়। তবে দেবীতীর্থ কামাখ্যাতে তীর্থযাত্রীরা প্রতিদিনই কুমারী পুজো করে থাকেন। বৃহদ্ধর্ম পুরাণের কথায়, দেবী অম্বিকা কুমারী কন্যারুপে আবির্ভূত হয়েছিলেন দেবতাদের সামনে, নির্দেশ দিয়েছিলেন বেলগাছে দেবীর বোধন করতে। দেবীকে কুমারী নামে অভিহিত করা হয়েছে তৈত্তিরীয় আরণ্যকে। একমাত্র কন্যাকুমারীর মন্দিরে দেবীনামের ঐতিহ্য বহন করছে কুমারী প্রতিমার পুজো করে।
কুমারী পুজোর সময় বয়সানুসারে কুমারীর নামকরণের নানারীতি প্রচলিত আছে। যেমন, এক বছরের কন্যা সন্ধ্যা, দু-বছরের সরস্বতী, তিন বছরে বর্ষা বা ত্রিধামূর্তি, চার বছরে কালিকা, পাঁচ বছরে সুভগা, ছ-বছরে উমা, সাত বছরে মালিনী, আট বছরে কুঞ্জিকা মতান্তরে কুবিজবন, ন-বছরে কালসন্দর্ভা মতান্তরে কালসন্ধ্যা, দশ বছরে অপরাজিতা, এগারো-বছরে রুদ্রাণী, বারো বছরে ভৈরবী, তেরো বছরে মহালক্ষ্মী, চোদ্দবছরে পাঠ-নায়িকা, পনেরোয় ক্ষেত্রজ্ঞা, ষোলো বছরে কুমারী অভিহিত হয় অম্বিকা নামে। ঋতুমতী না হওয়া পর্যন্ত এই নামে পূজিত হবে কুমারী কন্যা।
কুমারী পুজো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে তন্ত্রশাস্ত্রে। দুর্গার রূপ ধরে নিয়েই পুজো করা হয় কুমারীকে। কুমারীকে স্নান করিয়ে পরানো হয় নতুন বস্ত্র, নানা আভরণ। সাজানো হয় ফুলের মালা ও মুকুট দিয়ে। পায়ে আলতা পরিয়ে কপালে দেয়া হয় কুমকুমের টিপ। কুমারীকে রাখা হয় অভুক্ত অবস্থায়। আসনে এমনভাবে বসানো হয় যাতে তার কোনও কষ্ট না হয়ে আনন্দলাভ করে। এবার অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সামনে বসিয়ে কুমারীকে পুজো করা হয় দেবীজ্ঞানে। এ পুজো হয় নিজ অধিকার ও সামর্থ্য অনুসারে বিধি ও রীতি মেনে।
অন্তরে ভরপুর বিশ্বাস ও ভক্তিই হল কুমারী পুজোর প্রধান ও একমাত্র উপকরণ। নানান উপকরণ দিয়ে পুজোর পর ভোজন করানো হয় কুমারীকে। পরে দক্ষিণা দেয়া হয় তিনবার প্রদক্ষিণ করে। নিবেদিত উপকরণ প্রসাদ হিসাবে বিতরণ করা সকলের মধ্যে। তন্ত্রের কথা, সারা বিশ্বভুবনকে খাওয়ানো হয় একটি কুমারী কন্যাকে খাওয়ালে।
১৯০১ সালের ১৮ অক্টোবর। প্রথম দুর্গাপুজোয় অষ্টমী তিথিতে বেলুড় মঠে কুমারী পুজোর প্রবর্তন করেন স্বামী বিবেকানন্দ। এ পুজো নিষ্পন্ন করা হয়েছিল স্মৃতিশাস্ত্রকার রঘুনন্দন প্রণীত তত্ত্ব অনুসারে। সেবারেই পুজো সংকল্প হয় শ্রী শ্রী সারদা মায়ের নামে। পশুবলির ব্যবস্থা করা হলেও কোনও কারণে তা হয়নি।
মহামায়া দেবী কামাখ্যা সদাসর্বদা কুমারীরূপে বিরাজ করেন মহাতীর্থ কামাখ্যায়। ভারতের নানা প্রান্ত থেকে তীর্থযাত্রীরা এখানে আসেন, কৃতকৃতার্থ হন দেবীজ্ঞানে কুমারী পুজো করে। চিরাগত কথা, সমস্ত দেবদেবী পুজোর ফল লাভ হয় কামাখ্যায় কুমারী পুজো করলে। এছাড়াও পুত্রলাভ, ধন ও ভূমিলাভ, বিদ্যালাভ, মনের আকাঙ্ক্ষিত সমস্ত বিষয়ই লাভ হয় কুমারী পুজো।
যোগিনীতন্ত্রের সপ্তদশ পটলের কথায়,
‘সর্ব্ববিদ্যাস্বরূপা হি কুমারী নাত্র সংশয়ঃ
একা হি পূজিতা বালা সর্ব্বং হি পূজিতং ভবেৎ।’
‘কুমারী সর্ববিদ্যাস্বরূপা সন্দেহ নেই। একটি কুমারী পুজো করলে সমস্ত দেবদেবীর পুজো করা হয়।’
শাক্তদের মধ্যে শক্তি উপাসনার ক্ষেত্রে বিশেষ করে তান্ত্রিকরা দেবী পুজোয় আলাদাভাবে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকেন কুমারী পুজোকে। শতশত বছর ধরে অতীতে প্রতিটা শক্তিপীঠে নবরাত্রিতে কুমারী পুজোর প্রথা প্রচলিত ছিল, যা আজও আছে। এই পুজোর ভুরি ভুরি প্রশংসায় পঞ্চমুখ কুবিজকা তন্ত্র, যোগিনীতন্ত্র, কালীতন্ত্র, রুদ্রযামল ও বৃহল্লীল তন্ত্র।
কালীতন্ত্রের কথায়, বিশেষ বিশেষ তিথি, পূজানুষ্ঠান ও দুর্গা নবমী তিথিতে কুমারী পুজো করা উচিত। বস্ত্র, অলঙ্কার ও ভোজনে প্রসন্ন কুমারী সিদ্ধিদান করে। কুমারী পুজো একটি বড় তপস্যা। এই পুজোয় ফল পাওয়া যায় কোটি গুণ। পরিপূর্ণ শুভ ফল পেতে কুমারী পুজো করাই প্রশস্ত।
কুমারী কন্যা সাক্ষাৎ দেবী বলে বর্ণিত আছে কালীতন্ত্রে। কুমারীর চরণ ধুয়ে কেশর কিংবা চন্দন দিয়ে তিলকস্বরূপ করে ভক্তিপূর্বক পুজো করলে অসুর, বিরুদ্ধ গ্রহ, ভূতপিশাচ, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস এবং সমস্ত দেবদেবী, ভৈরবগণ, ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বর, এঁরা সকলেই অত্যন্ত প্রীত ও প্রসন্ন হন পূজকের প্রতি।
বিধিপূর্বক পূজিত কুমারী নাশ করে বিঘ্ন, ভয় ও শত্রু। রোগ আরোগ্য হয়। শান্ত ও প্রসন্ন হয়ে বিরুদ্ধ ও রুষ্ট গ্রহাদি শুভ ফল দান করে। মানুষ সম্মান, ভূমি, লক্ষ্মী, বিদ্যালাভ করে মহাতেজ প্রাপ্তি হয়। মহাভয়, অপ্রত্যাশিত দৈব উৎপাত, দুঃস্বপ্ন, অপমৃত্যু তথা মানুষের সমস্ত দুঃখদায়ক সময় দূর হয় কুমারী পুজোর ফলে।
সর্বত্র ও সমস্ত শক্তিপীঠে কুমারী পুজোর ফল অশেষ। যেকোনও জাতির কুমারী পুজো করায় বাধা নেই। তন্ত্রের কথায়, কুমারী পুজোয় জাতিভেদ বিচার করা উচিত নয়। মানুষ নরকগামী হয় জাতিভেদ করলে।
জাগতিক সমস্ত দুঃখ দারিদ্র ও শত্রুনাশ এবং শক্তিপ্রাপ্তির জন্য কুমারী পুজো সর্বোত্তম। কুমারী পুজোর ফলে অপ্রাপ্ত কামনাও পূরণ করেন দেবতারা। আর্থিক অবস্থা অনুসারে এক বা একাধিক কুমারী পুজো করা যায়। তবে এক কন্যা পুজোয় যে ফল, একাধিক কুমারী পুজোয় ফলের কোনও তারতম্য নেই।
তন্ত্রশাস্ত্রে বলা হয়েছে, কুমারী পুজো করলে স্বয়ং ভগবতী প্রসন্ন হন। যেখানে কুমারী পুজো হয়, সেখানেই ভগবতীর নিবাস। কুমারীকে ভোজন করালে দেবী কুমারীরূপে অবতীর্ণ ও আনন্দিত হন। সেইজন্য কুমারী কন্যাকে মান্য করা হয় ভগবতীরূপে। যে কন্যারূপী দেবীকে পুজোর শেষে নৈবেদ্য ও ভোজনে তৃপ্ত করে, সে ত্রিলোক তৃপ্ত করে।
মহাতীর্থ কামাখ্যার মতো ভারতের প্রায় সমস্ত দেবীতীর্থে নবরাত্রির যজ্ঞের পর কন্যা পুজোর প্রথা প্রচলিত আছে আজও। এ থেকে বাদ যায়নি জম্মুতে বৈষ্ণবী দেবী, হিমাচল প্রদেশে জ্বালামুখী, বজ্রেশ্বরী, চিন্তাপূর্ণি এবং নয়না দেবী। ছোট ছোট কুমারী কন্যাদের এই সব তীর্থগুলিতে পুজো সুসম্পন্ন করা হয় শাস্ত্র সম্মত ভাবে। ১৯৮৫ সালে জ্বালামুখীতে এক ধনবান পরিবারের সাড়ম্বর কুমারী পুজো দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল অপ্রত্যাশিত ভাবে, মুগ্ধ হয়েছিলাম পুজো দেখে।
স্থাপত্যশিল্পের ঢল নেমেছে ভকতপুরে। স্থপতির নিপুণ হাতের এমন বিস্ময়কর কাজের কথা কি করে বোঝাই, শিল্প কোথায় এবং কতদূর পৌঁছেছে। মানুষের সৃষ্টি শিল্প আর প্রকৃতির অবদানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, কোনওটায় কম যায় না নেপাল। বেরিয়ে এলাম দরবার স্কোয়ার থেকে। স্থানীয় একটি দোকানে জিজ্ঞাসা করতেই দেখিয়ে দিল কুমারী মন্দির। দরবার স্কোয়ারের কাছে। সামান্য একটু পথ। হেঁটেই পৌঁছে গেলাম মন্দিরে। অন্যান্য মন্দিরের মতোই কারুমণ্ডিত। কোনও পার্থক্য নেই কাঠমান্ডুর অন্য মন্দির আর কুমারী মন্দিরে।
নেপালে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে কুমারী পুজো। বিশেষ করে কাঠমান্ডুতে যে মন্দিরে প্রধান দরজার মুখেই একজন দ্বাররক্ষী বসে আছে গ্যাঁট হয়ে। কুমারীকে দেবী হিসাবেই বিশ্বাস শ্রদ্ধা আর পুজো করা হয়। কুমারীকে এখানে বলা হয় গুরুমা। বসেন মন্দিরের দোতলায়।
গুরুর দর্শনপ্রার্থী হওয়ায় প্রথমেই দ্বাররক্ষী জানতে চাইলেন, আমি হিন্দু কি না? বেশ বড় করে ‘হ্যাঁ’ সূচক ঘাড় নেড়ে দিলাম। খুব খুশি হলেন দ্বাররক্ষী। কোনও বিধর্মীকেই উঠতে দেওয়া হয় না উপরে। দ্বাররক্ষী জানালেন, তারা দর্শনপ্রার্থী হলে গুরুমা দোতলা থেকে দর্শন দেন জানলার কাছে দাঁড়িয়ে।
চললাম দ্বাররক্ষীর সঙ্গে। সোজা নিয়ে গেলেন দোতলায়। দেখলাম ঘরের দাওয়ায় উঁচু পিঁড়ি পাতা আছে একটা। এটিই কুমারীদেবীর আসন। দ্বাররক্ষী ডাকতেই বাইরে বেরিয়ে এলেন গুরুমা। ছিলেন ঘরের ভিতরে। আসনে বসলেন পদ্মাসন করে। পরনের শাড়িটা টকটকে লাল। দুচোখে টানা দিয়ে কাজল পরা। নিখুঁত কাজলের টান চোখের কোনায় গিয়ে উঠে গিয়েছে একটু উপরে। তাই চোখ দুটো বেশ বড়বড় দেখায়। ‘দুধে আলতা রঙ’ কথাটা শোনা যায়, শব্দগুলি দেখা যায় পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনের কলমে। কিন্তু চোখে দেখা যায় খুব কমই। এই কুমারী দেবীকে দেখলে তবেই বোঝা যায় দুধে আলতা রঙ কাকে বলে। টানটান করে ঝুটি বাঁধা চুল ঠিক মাথার মাঝখানে। বাউলেরা যেমন বাঁধে। দোহারা চেহারা। একেবারে পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিখুঁত। বয়েস আন্দাজ নয় কি দশ হবে। একটু বেশি হলেও হতে পারে তবে এখনও রজঃস্বলা হয়নি এটা নিশ্চিত। ওটা হলে আর গুরুমার পদে থাকতে পারবে না, এটাই নিয়ম। নেপালিদের মধ্যে একটি মেয়ের চেপটা মুখের গড়নের উপর যতদূর সুন্দরী কল্পনা করা যায়, কুমারীদেবী রূপে ততটাই।
প্রণাম করলাম। নিয়ম মাফিক কিছু প্রণামী দিতে হয়, দিলাম। কোনও কথা হল না। মিনিট তিনেক বসলাম। তারপর নেমে এলাম দ্বাররক্ষীর সঙ্গে।
কাঠমান্ডুর প্রধান পুরোহিত নির্বাচন করেন কুমারী পুজোর কুমারী। কুমারী পুজোকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই উৎসব হয় এখানে, আষাঢ় শ্রাবণে। উৎসবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বেরোয় কুমারীদেবীকে নিয়ে। কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠানটি ইন্দ্রযাত্রা নামে প্রসিদ্ধ। দ্বাররক্ষীর মুখেই শুনলাম, নেপালের রাজা এখানে এসে প্রণাম করেন কুমারীদেবীকে।
কুমারীদেবী যাঁরা হন, তাঁরা অল্প বয়সেই রাজার মতো সম্মান লাভ করেন। এঁদের নামে জমি এবং প্রচুর অর্থ দিয়ে থাকেন রাজা, যাতে মৃত্যু পর্যন্ত না কষ্ট পেতে হয়। দেবীপদে কুমারী থাকে প্রধানত বছরদশেক। তারপর নেপালের নিয়ম ও সংস্কারে এঁরা বাঁধা পড়ে। বিবাহ করতে পারেন না কখনও। সারাজীবনই থাকতে হয় কুমারী। বিবাহের অধিকার থেকে এঁরা বঞ্চিত হন। পুরুষের অনাঘ্রাতই থেকে যায় কুমারীদেবী। নিঃসঙ্গ জীবন চলে একেবারে মৃত্যু পর্যন্ত।
অসংখ্য কুমারীদেবী আছেন আজও, যাঁরা জনসংযোগ থেকে দূরে দুঃসহ গ্লানিময় জীবন যাপন করছেন। কুমারীপদে অবসরপ্রাপ্ত বিভিন্ন বয়েসের এইসব কুমারীদেবীদের বাসস্থানও আলাদা। কোনও সম্পর্ক নেই বাইরের জগতের সঙ্গে। কুমারী মন্দিরের দোতলায় এঁদের অনেকেই বাস করেন এখনও। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে মন্দির থেকে বেরিয়ে আসার সময়, দুঃসহ পরিবারের বাপমায়েরা অনেকক্ষেত্রে নিজেদের সাংসারিক স্বার্থসিদ্ধি আর আর্থিক দৈন্যমোচনের জন্য অবোধ নাবালিকা কন্যার এমন জীবন কামনা করেন।
তপোবন ভারতবর্ষের এই আধ্যাত্মিক ভাব, পরম্পরাগত রীতি নীতিতে বিস্ময়কর বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা, সংস্কারগত ধর্মে অনুরাগ, প্রেম ও ভক্তির সঙ্গে ভারতবাসীর রয়েছে এক অচ্ছেদ্য নাড়ির বন্ধন। এ বন্ধন কোনও কালেই ছিন্ন করে ভারতকে জয়, ভারতবাসীকে জয় করা সম্ভব হবে না বুঝেই LORD MACAULAY ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি BRITISH PARLIAMENT-এ বলেছিলেন।
“I have travelled across the length and breadth of India and I have not seen one person, who is a beggar, who is a thief, such wealth I have seen in this country. Such high moral values, people of such caliber, that I donot think we would ever conquer this country. Unless we break the very backbone of this nation, which is spiritual and cultural heritage and therefore I propose that we replace her old and ancient education system, her culture for if the Indians think that all that is foreign and English is good and greater than their own, they will lose their selfesteem, their native culture and they will become what we want them, a truly dominated nation”.
“আমি ভারতের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত যাত্রা করেছি এবং আমি এমন একজনও দেখিনি যে ভিখিরি, যে চোর। এরকম ঐশ্বর্যই আমি ভারতে দেখেছি। এত উচ্চনৈতিক মূল্যবোধ, এত যোগ্যতাসম্পন্ন লোক, কাজেই আমি মনে করি না আমরা কোনও দিন এই দেশ জয় করতে পারব। যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা ওদের জাতির মেরুদণ্ড ভাঙতে পারি, যেটা ওদের আধ্যাত্মিক ও সংস্কৃতির পরম্পরা। সুতরাং আমি মনে করি ওদের এই পুরোনো এবং প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতি বদলে দিতে হবে, যাতে করে ওরা মনে করে যে, সমস্ত বিদেশি এবং ইংরেজিই ভালো এবং নিজেদেরটার চাইতেও বড়, আর তখনই ওরা হারাবে ওদের স্বাভিমান, জাতীয় সংস্কৃতি আর তখন ওরা তাই করবে যা আমরা চাইব এবং তখনই হবে সত্যিকারের dominated nation (অধীনস্থ জাতি)।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার ও তথ্যসূত্রঃ দুর্গাপূজা সেকাল থেকে একাল — বিমল চন্দ্র দত্ত, পুণ্যভূমি কামাখ্যা ও অম্বুবাচী মেলা — শিশির সেনগুপ্ত।