Mythology

হিন্দু জীবনে মহাকুম্ভের মাহাত্ম্য

একই সঙ্গে চলছে অগণিত কুম্ভের স্নানযাত্রী। শতচ্ছিন্ন আঁচলের দেশওয়ালি থেকে শুরু করে মাটিতে পা না ফেলা মানুষ – কে নেই এই প্রয়াগের স্নানযাত্রার মিছিলে!

“প্রয়াগ – বৎসর ২ নানা দেশ হইতে যাত্রিকেরা প্রয়াগ তীর্থে মাঘ মাসে গমন করে সে সময় এখন গত হইয়াছে। অন্য ২ বৎসর হইতে এই বৎসরে প্রয়াগে অল্প লোক তীর্থ করিতে গিয়াছিল এবং পূর্ব্ব ২ বৎসর অপেক্ষায় এই বৎসরে সেখানে গঙ্গা যমুনা সঙ্গমে অল্প লোক প্রাণত্যাগ করিয়াছে।”…(২৬ ফেব্রুয়ারী ১৮২০, সমাচার দর্পণ)।

“সংপ্রতিকার হরিদ্বারের মেলা। [আমারদের নিজ পত্রপ্রেরকের স্থানে প্রাপ্ত এই সম্বাদ]।


…..পূর্ব্ব ২ বৎসরের কুম্ভমেলাতে গোস্বামী ও উদাসীনেরদের যুদ্ধে এবং লোকের চাপাচাপিতে যেমন লোক মারা পড়ে এ বৎসরে তেমন নয়। ইহাতে গবর্ণমেন্টের অত্যন্ত প্রশংসা হইয়াছে যেহেতুক শ্রীলশ্রীযুক্ত লার্ড উলিয়ম বেন্টীঙ্ক সাহেব সেই স্থানের ঘাট অতিপ্রশস্ত করিয়া একটা পাকা রাস্তা করিয়া দেন এবং শ্রীযুক্ত মাজিস্ত্রেট সাহেব অতিসুবিবেচনাপূর্ব্বক শাত্রবাচারি ঐ গোস্বামী প্রভৃতির অস্ত্রশস্ত্র সকল কাড়িয়া লইলেন এবং তাঁহারদের দল রাস্তার মধ্যে কিম্বা ঘাটে না মিশিতে পারে এমত অনেক উদ্যোগ করিয়াছিলেন। এই বৎসরে চুরীও অনেক হয় নাই। অনুমান হয় সাত স্থানে অগ্নি লাগে….। ঐ অগ্নি… যাত্রিকের খড়ুয়া ঘর সকলে ও ব্যবসায়িদের দোকান ঘরে লাগিল এবং তিন দিবস পর্যন্তও নির্ব্বাণ হইল না। কথিত আছে যে তৎসময়ে ১২৫০০০ টাকার জিনিস দগ্ধ হয়।”…(৯মে ১৮৩২, সমাচার দর্পণ)। (সংবাদপত্রে সেকালের কথা)

Kumbh Mela
কুম্ভমেলা উপলক্ষে প্রয়াগরাজে তৈরি হয়েছে অস্থায়ী তাঁবু

না, এবারের কুম্ভমেলায় প্রয়াগের গঙ্গা যমুনা সঙ্গমে এক জন তীর্থযাত্রীও ডুবে মরেনি, ভেসেও যায়নি। হরিদ্বারের মতো সাধুদের সঙ্গে সাধুদের দাঙ্গা আর অগ্নিকান্ডে একটি দোকান বা তাঁবুও পোড়েনি। তবে স্টেশন এলাহাবাদ থেকে কুম্ভমেলা প্রাঙ্গণ, প্রায় ৭ কি মি পথ মাথায় বোঁচকা বুঁচকি বাক্স প্যাঁটরা বয়ে নিয়ে যেতে তীর্থযাত্রীদের অবস্থা হয়েছে অত্যন্ত শোচনীয়। আরও করুণ অবস্থা চাঁদের। মানুষের ভিড় আর ধুলোয় প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। কাল অমাবস্যা। মৌনী স্নান।


রোটি সবজিতে রাত কাটল তাঁবুতে। উঠলাম সাত সকালে। বেরিয়ে পড়লাম ‘সঙ্গম যানে কা মার্গ’ খুঁজতে। ঠান্ডা খুব কমই বোধ হল। মেলার চারদিকে মানুষের অস্থায়ী আস্তানা। কুয়াশার মতো ধুলোর আস্তরণ। কালো চুল সাদা হতে কারও মিনিট দুয়েকের বেশি লাগছে না।

Kumbh Mela
সাধুমহন্তদের সুসজ্জিত অস্ত্র রাখা

কোন পথে যাব সঙ্গমে? পুলিস পথ দেখাল আঙুল উঁচিয়ে। চলছি তো চলছি। অনন্তকালের পথ যেন! শেষই হতে চায় না। আমার মতো একই সঙ্গে চলছে অগণিত কুম্ভের স্নানযাত্রী। শতচ্ছিন্ন আঁচলের দেশওয়ালি থেকে শুরু করে মাটিতে পা না ফেলা মানুষ – কে নেই এই প্রয়াগের স্নানযাত্রার মিছিলে! সন্তানের পিঠে বৃদ্ধা মা, লাঠি সম্বলরাও ভেসে চলেছে অমৃতস্রোতের টানে। চেহারায় বোঝা যায়, এঁরা বিদ্যুতের আলো দেখেনি গাঁয়ে, এদের বাঁচিয়ে রেখেছে পুকুর নয় তো কুয়ো।

এঁকেবেঁকে এদিক সেদিক করতে করতে এসে দাঁড়ালাম একটা জায়গায়। দাঁড়াল অগুনতি মাথা। রাস্তা শেষ। দাঁড়িয়ে আছে পুলিস। ‘সঙ্গম যানে কা মার্গ’ ? মুচকি হেসে দেখিয়ে দিল আর একটা রাস্তা। এরই মধ্যে সময় নষ্ট হল ঘণ্টা খানেক। পরে জেনেছি কুম্ভমেলায় পুলিসের প্রধান কাজই ছিল তীর্থযাত্রীদের ভুল পথ দেখানো, যাতে তাড়াতাড়ি সঙ্গম ঘাটে না পৌছতে পারে। ভিড় যেন এক জায়গায় না থমকে দাঁড়ায়।

Kumbh Mela
প্রয়াগরাজে কুম্ভস্নানের পথে মহন্তরা

এবার আর পুলিসের কথা শুনে নয়, জনস্রোতে গা ভাসিয়ে দিলাম। দেখা যাক কোথায় গিয়ে পড়ি। এক সময়ে নজরে এল তীর চিহ্ন দিয়ে লেখা বোর্ড, ‘সঙ্গম যানে কা মার্গ।’ গতি বেড়ে গেল। বাড়ালে কী হবে? আগের লোক আগে না বাড়লে এগোই কেমন করে? খানিক আগে চলছিলাম হাজার হাজার যাত্রীদের সঙ্গে। এবার ভাসিয়ে নিয়ে গেল লক্ষ লক্ষ মানুষ। কারও থেমে থাকার উপায় নেই।

পথ চলতি এক দেহাতি বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ মাঈ, আপ কঁহাসে? ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর এল ছাপড়া জেলার কোনও এক গ্রাম থেকে, যে গ্রামের নাম উচ্চারণের কারণে বুঝতেই পারলাম না। পথের পাশে শাল আর বাঁশের বেড়া। তার পাশে কেউ বালিতে কম্বল পেতে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিয়েছে, কেউবা স্টোভ জ্বেলে করা ধুলোয় ভরা রুটি চিবাচ্ছে পরম তৃপ্তিতে। কেউ বা পথের ধুলোয় বসে খানিক বিশ্রাম নিচ্ছে। পথের শেষ যে কোথায়। কোনও আঁচই পাওয়ার উপায় নেই। জিজ্ঞাসা করেও লাভ নেই। যার কাছে জানতে চাইব, সে যেখানে আমিও তো সেখানেই।

স্নানযাত্রীদের মিছিল চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। মুহুর্তে জনস্রোত ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল বাঁশের বেড়ার ধার ঘেঁষে। পুলিস পথ আটকেছে। আসছে কোনও এক আখড়ার সাধুদের বিশাল শোভাযাত্রা। দাঁড়িয়ে পড়লাম বেড়ার ধারে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে অশ্বারোহী পুলিস। আরও এগিয়ে এল। দেখছি জুনা আখড়ার দিগম্বর সাধুরা বাদ্য বাজাচ্ছে। শিঙে ফুঁকছে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তলোয়ার নিয়ে কৃত্রিম লড়াই-এর খেলায় মেতেছে সাধুরা। অসংখ্য সাধুর শোভাযাত্রার শেষে রূপোর সিংহাসনে রূপোর ছাতা মাথায় ধীরে ধীরে ত্রিবেণী সঙ্গমের পথে এগিয়ে চলল মহামণ্ডলেশ্বরের গাড়ি। সারা গায়ে ভস্ম মাখা, গলায় গাঁদা ফুলের মালা দিগম্বর সাধু, রঙবেরঙের পতাকা হাতে, এ এক অপূর্ব সৌন্দর্যে ভরা সাধু মিছিল। চলমান শোভাযাত্রা থেকে আকাশ বাতাস ভেদ করে জয়ধ্বনি উঠছে, গুরু মহারাজ কি – জয়। তীর্থরাজ প্রয়াগজি কি – জয়। এই জয়ধ্বনিতে সাধু কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছে লক্ষ লক্ষ ভক্তপ্রাণ তীর্থযাত্রী।

শোভাযাত্রা থেমে নেই। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর শেষ হল। হাজার হাজার তীর্থযাত্রী এবার বেড়া টপকে ঢুকে পড়ল ভিতরে। পায়ের ধুলো নিয়ে মহানন্দে মাখছে গায়ে মাথায়, কেউবা মুঠোয় করে রাখছে ব্যাগে। দেশে ফিরে দেবে হয়তো আত্মীয়পরিজনদের মাথায়। সাধন-জ্যোতি মাখানো পদধূলি যে! সঙ্গীদের নিয়ে বেড়া টপকে চললাম ‘সঙ্গম মার্গ’ ধরে। মাঝে মধ্যে ধুলোর ঝড়ে চলা প্রায় দায় হয়ে উঠেছে। এক সময় এসে দাঁড়ালাম স্নানের ঘাটে। দেখছি, এক পাশে রূপোর সিংহাসন জলে নামিয়ে সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের আরাধ্য দেবতার পরে পুজো হল গঙ্গা যমুনা সরস্বতী এবং প্রয়াগরাজের। এবার সন্ন্যাসীরা প্রাণভরে সেরে নিলেন অমৃতকুম্ভের স্নান। আবার আকাশ বাতাস অনুরণিত হল, বোল গঙ্গা মাঈয়া কি – জয়…..

Kumbh Mela
প্রয়াগরাজে অগণিত পুণ্যার্থী

সাধুদের পাশেই স্নান করছে গৃহীরা। যতদূর চোখ যায় শুধু দেখছি লক্ষ লক্ষ মাথা। এ মাথা শুধু জলে ডুবছে আর উঠছে। এই নামা ওঠার কোনও বিরাম নেই। স্নানের ঘাট ঘিরে রয়েছে ভারত সেবাশ্রম সংঘের স্বেচ্ছাসেবক, নৌকায় পুলিস, সাঁতারু। এদের লক্ষ্য কাউকেই জলে ডুবে মরতে দেবে না।

সঙ্গম ঘাটে ধনী দরিদ্র জাতপাত এমন কি কোনও পদেরও বিচার নেই। প্রাণ ভরে কেউ দিচ্ছে তিন বা সাত ডুব। ব্যস, তারপর উঠে আসছে ঘাট ছেড়ে। একটা অদ্ভুত বিষয় নজর এড়াল না। চেহারায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের, বয়েসের কোনও বিচার নেই, যুবক- যুবতী, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, দেশোয়ালি খুব অভাবী নারীপুরুষও সম্মোহিতের মতো খানিক সময়ের জন্য হয়ে যাচ্ছে দেহ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। লজ্জা বলে দেহের যে একটা বস্তু আছে, কি পুরুষ কি নারীর তা খেয়ালই নেই। গুরু বা আরাধ্য কোনও দেবদেবীর জন্য ওই সময় মন নিবেদিত, হয়তো। স্নানের ঘোর কাটতেই লজ্জা নিবারণের কথা আসে মনে। ভগবৎ চিন্তায় মশগুল মন মুহুর্তে হয়ে ওঠে সচকিত।

Kumbh Mela
ভান্ডারার জন্য চলছে প্রস্তুতি

সঙ্গমে স্নান সেরে উঠে আসা গৃহীদের অনেকের কাছে জানতে চাইলাম, সব ফেলে এত কষ্ট করে এলেন, কী পেলেন? কোনও উত্তর দেই। একই প্রশ্ন করেছিলাম ১৯৯৮-এ হরিদ্বারের কুম্ভস্নানে। সেখানেও কোনও উত্তর পাইনি। এমন জিজ্ঞাসার উত্তরে এঁদের কণ্ঠ যে কে রোধ করে তা বুঝে উঠতে পারিনা। তবে একটা জিজ্ঞাসার উত্তর জাতিধর্ম নির্বিশেষে কুম্ভস্নানযাত্রীরা জানিয়েছেন নির্লিপ্ত চিত্তে। ঠিক যে মুহুর্তে ত্রিবেণী সঙ্গমে ডুব দিচ্ছিলেন, সে মুহুর্তে কী চাইছিলেন, কী ভাবছিলেন?

এ প্রশ্ন যাঁদেরই করেছি, প্রত্যেকেরই একই উত্তর, কিছু ভাবিনি, কারও কথা ভাবিনি, সংসারের কারও কথাই মনে ছিল না যখন স্নানের জন্য ডুব দিয়েছি। শুধু মনে মনে বলেছি জয়গুরু জয়গুরু জয়গুরু। ভগবানের নাম স্মরণ ছাড়া আর কিছুই ভাবিনি।

অসংখ্য তীর্থযাত্রীদের জিজ্ঞাসা করে ব্যতিক্রম পেয়েছি হিন্দিভাষী একজন মহিলাকে। তিনি জানালেন, আমার বিয়ের পর পাঁচ বছরের মধ্যে কোনও সন্তান হয়নি। আজ থেকে বারো বছর আগে প্রয়াগের কুম্ভে এসেছিলাম। সে বার স্নানের সময় কামনা করেছিলাম সন্তানের। পরে পর পর দুটি পুত্র সন্তান লাভ হয় আমার। এবার তাদের নিয়েই এসেছি। স্নানের সময় একটাই কামনা করেছি প্রয়াগরাজের কাছে, আমার সন্তানদের ভাল রেখো।

Kumbh Mela
কুম্ভমেলায় ড্রিমগার্ল হেমা মালিনী

সাধু সন্ন্যাসীদের স্নানের পর তাঁদের তীর্থদেবতার কাছে চাওয়ার উত্তরে শুধু পেয়েছি নির্বিকার অমলিন চিত্তের কুঠরি থেকে বেরিয়ে আসা এক গাল হাসি।

বেলা গড়িয়ে স্নানের ঘাটে সময় কেটে গেল অনেকটা। এবার ফিরব তাঁবুতে। হাজার হাজার বছর ধরে উচ্চকোটি মহাপুরুষ ঋষিযোগী সাধুসন্ন্যাসীদের পদধূলিপূত প্রয়াগের ধুলো মাখতে মাখতেই চলেছি। দেখছি, মানুষের আসার বিরাম নেই। অবিরাম জনস্রোত। কালো কালো মাথা মাথা আর মাথা। ভগবানের কী বিস্ময়কর সৃষ্টি! একটা মুখের সঙ্গে আর একটার কোনও মিলই নেই। কত যে ছাঁচ। অনন্ত কোটি।

Kumbh Mela
ধ্যানমগ্ন সাধুবাবা

কী ভাগ্য যারা এসেছে মহাকুম্ভের প্রয়াগে। সুবিশাল বিস্তৃত মেলাপ্রাঙ্গণ জুড়ে কোটি কোটি মানুষের মহামিলন। একসঙ্গে একই ক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া কি কম ভাগ্যের কথা। পুণ্যাত্মার কি অভাব আছে এ দেশে?

ভাবনায় ধাক্কা খেল। পুলিস পথ আটকেছে। আসছে মহামিছিল। দাঁড়িয়ে গেলাম বাঁধা বেড়ার ধারে। দেখছি গেরুয়ার স্রোত। রোদে সব ঝলমল ঝলমল করছে। এ শোভাযাত্রায় প্রথমে চলছে বাদ্য, পরে ঘোড়া আর উটের উপরে সাধু, তারপরে পদযাত্রায় সাধু, এর পরে গাড়িতে। এই মিছিলের মাথা গুনেও শেষ করা যাবে না। মিছিলেরও যেন আর শেষ নেই। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কেটে গেল প্রায় ঘণ্টা খানেক। এবার শোভাযাত্রা শেষ। আবার আসবে। আবার আটকে যেতে হবে। টুক করে বেড়ার ফাঁক গলে ধরলাম তাঁবুর পথ।

Kumbh Mela
প্রয়াগরাজে স্নানরত কোটি কোটি পুণ্যার্থী

কুম্ভমেলা প্রাঙ্গণে দোকানপাট বলতে যা, তেমন কিছু নেই। আছে যা তার মধ্যে নামাবলী, আবির শুকনো নারকেল আর পুজো দেওয়ার নানা উপকরণ। চায়ের দোকানও আছে, সংখ্যায় কম। খাবারের দোকান খুবই অল্প তবে খাওয়ার অভাব নেই। কেউ না কেউ, কোথাও খিচুড়ি, কোথাও রুটি সবজি বিতরিত হচ্ছে বিনামূল্যে। আনন্দের সঙ্গে তা গ্রহণ করছে সাধুসন্ন্যাসী আর গৃহী তীর্থযাত্রীরা। এ দেখায় চোখের তৃপ্তির যেন সীমা পরিসীমা নেই!

ফিরে এলাম তাঁবুতে। সাত সকালে বেরিয়ে কুম্ভস্নান সেরে ফিরতে সময় লাগল সাত ঘণ্টা। খাওয়া সেরে খানিক বিশ্রাম। সন্ধ্যা লাগো লাগো। হালকা হাওয়ায় শীতের আমেজ আছে তবে ঠান্ডার চোখ রাঙানি নেই। যে দিকে তাকাই আলোয় আলোময়। বিভিন্ন আশ্রম মিশনের অস্থায়ী তাঁবু থেকে মাইকে ভেসে আসছে অধ্যাত্মসংগীত। নানা ভাষায়। তীর্থযাত্রীরা হেঁটে চলছে। অবিরত। একই সঙ্গে সেই সব সাধু সন্ন্যাসীরা, যাঁরা ‘রমতা’, থাকা খাওয়ার ঠিক নেই, নেই মাথার উপরে এতটুকু ছাউনি।

Kumbh Mela
সাধুদের মিছিল

পথে চলছি ধীরে ধীরে। জোরে চলার উপায় নেই। বালি যে, পা বসে যায়। সকালটা কেটেছে স্নান পর্বে। এ বেলাটা কাটাব আখড়ার সাধু দর্শনে। মেলায় উত্তরপ্রদেশ সরকার দুটো ভাগ করেছে। শংকরাচার্যের দশনামী সম্প্রদায়, যেমন মহানির্বাণী, নিরঞ্জনী, জুনা আখড়া – এঁদের তাঁবু আর থাকার ব্যবস্থা আলাদা একটা এলাকা জুড়ে। বাকি সমস্ত আশ্রম মিশনের তাঁবু অন্য এলাকায়। ফলে আখড়া খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় না।

আমার তাঁবু থেকে মিনিট কুড়ি হেঁটে এসে গেলাম একেবারে সাধুসন্ন্যাসীদের জমজমাট এলাকায়। প্রথমেই ঢুকে পড়লাম সঙ্গীদের নিয়ে মহানির্বাণী আখড়ায়। ভিতরে পথ চলার দু-পাশে ছাউনি। তাতে সারি দিয়ে আসন পাতা। প্রত্যেক সাধুর আসন আলাদা। কোনওটায় সাধুমহারাজ বসে আছেন চোখ বুজে ধ্যানাসনে ভস্মমাখা, কোথাও সাধুমহারাজ ধর্মকথা বলছেন গৃহীভক্তদের, কেউবা ধুনি জ্বালিয়ে আহুতি দিচ্ছেন যজ্ঞ বা হোমকুণ্ডে। মহাকুম্ভে এমনটাই যেন দস্তুর। হরিদ্বারের মেলায় যেমনটি দেখেছি, এখানেও তেমন। এই চিত্রের কোথাও ব্যতিক্রম নেই এতটুকুও।

এইভাবে একের পর এক আচার্য শংকরের দশনামী সম্প্রদায়ের আখড়ায় সাধুদর্শন করতে করতে এসে দাঁড়ালাম জুনা আখড়ার দোরগোড়ায়। এখানে সব দিগম্বর নাগা সন্ন্যাসীদের অবস্থান। ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে আছে পুলিস। জানিয়ে দিল কোনও ভাবেই যেন সাধুদের বিরক্ত না করি। ওরা যদি কোনও কারণে মারধর করে তাহলে পুলিসের কিছু করার নেই।

Kumbh Mela
শ্রী পঞ্চদশনামী আবাহন আখড়ার তাঁবু

পূর্ব – কুম্ভের অভিজ্ঞতায় দেখেছি পুলিসের এই বক্তব্য মোটেই ঠিক নয়। শত শত সাধুদর্শন এবং অনুমতি নিয়ে তাঁদের ছবি তুলেছি, কেউই বিরক্ত তো হননি বরং হাতটা তুলেছেন আশীর্বাদের মুদ্রায়।

ধীরে ধীরে ঢুকে পড়লাম ভিতর। মাঝে পথ। দুপাশে বাঁধা ছাউনির মধ্যে একের পর এক জ্বলছে হোমকুণ্ড। কোথাও সাধুরা দু-চারজন, কোথাও একা বসে আছেন দিগম্বর হয়ে। সারা গায়ে ভস্মমাখা। প্রায় সকলেই জটাজুটধারী। সাধুদর্শন, প্রণাম আর প্রয়োজনের দু-চার কথা বলে ছবি তুলতে তুলতে এসে দাঁড়ালাম উর্ধবাহু এক কঠোরতপা সন্ন্যাসীর সামনে। সন্ন্যাসী শিষ্য আর দু-চারজন বিদেশীভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে বসে আছেন আপন আসনে। আধশোয়া হয়ে টানা ৩৭ বছর ধরে উপরে তুলে থাকা ডান হাতটা প্রায় শুকিয়ে সরু হয়ে গিয়েছে। হাত আর আঙুলগুলো এখন অকর্মণ্য। গৈরিক বসন পরিহিত সাধুবাবার উজ্জ্বল প্রসন্ন মুখমণ্ডল। বেশ খানিকটা সময় কাটল এখানে।

পায়ে পায়ে বেরিয়ে এলাম আখড়া থেকে। টুকটুক করে এবার ঢুকলাম আনন্দ আখড়ায়। এখানেও একটার পর একটা জ্বলছে ধুনি। পাশেই বসে ভস্মমাখা সন্ন্যাসী। খানিকটা এগোতে নজরে এল একজন সন্ন্যাসী। গেরুয়া রঙে ঢাকা দেহ। মাথায় পাগড়ি। কঠোর তপস্বী এই সন্ন্যাসী এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন একটানা ২৭ বছর ধরে। দিগম্বর নয়। মৌনী। চোখ দুটো ফালা ফালা।

একটা পটলের দুটো ফালি যেন। সুদর্শন। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। মিষ্টি হাসিতে ভরা মুখখানা। ঠিক ঠিক সাধুর যেমনটা হাওয়া উচিত ঠিক তেমনই।

পাশে দাঁড়ানো এই সাধুবাবার সেবকশিষ্য জানালেন আনন্দ আখড়ার ফরারি সাধু ইনি। দেহ বাঙালির। বাঁশের বাঁধা একটা মাচার মতো। তাতে ভর দিয়ে এক পায়ে দাঁড়ানো এই সাধুবাবার নিত্য পরিচর্যা করেন এই সেবকশিষ্য। কী উদ্দেশ্যে এই কঠোর তপস্যা? এ জিজ্ঞাসার উত্তরে মুখ খুললেন না সেবক।

Kumbh Mela
সাধুবাবা দাঁড়িয়ে আছেন ২১ বছর ধরে

আনন্দ আখড়ায় একে একে সব সাধুদের দর্শন করে এবার ঢুকে পড়লাম মহানির্বাণী আখড়ায়। শুরু হল তাঁবু পরিক্রমা। অন্যান্য আখড়ার মতো এখানেও সে একই চিত্র। কেউ বসে আছেন ভস্ম মেখে ধুনি জ্বালিয়ে, কেউ জপে তন্ময়, কেউবা আসনের পাশে রাখা বিগ্রহে করে চলেছেন পূজারতি। সাধুদর্শন করতে করতে এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ালাম। মাচার মতো বাঁধা রয়েছে বাঁশ। সাধুবাবা তাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দু-পায়ে। হাতে ময়ূরের পালক দিয়ে তৈরি চামরের মতো। কথা বলেন। মৌনী নন। নিরেট চেহারা। মাথায় পাগড়ির মতো করে বাঁধা গেরুয়া কাপড়। গায়ে জড়ানো কম্বল। অল্প দাড়িতে ভরা মুখের হনু দুটো বেরিয়ে পড়েছে। দুপায়ে দাঁড়িয়ে তাঁর তপস্যা। এইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন ২১ বছর ধরে। জপ তপ ঘুম খাওয়া সব কিছুই দাঁড়িয়ে। জানতে চাইলেও সাধনজীবনের গোপন কথার একটা অক্ষরও প্রকাশ করলেন না।

অনেক সাধু, অনেক অ-নে-ক কথা। ভিখিরি জীবন থেকে এখন মুক্ত হলেও ভিক্ষা করার অভ্যাস আমার আজও যায়নি। সাধুদের কাছে কথা ভিক্ষা করি। পরমানন্দে মন আমার ডগমগ এই প্রয়াগে, ভস্মমাখা সাধুদেখে, প্রয়াগের ধুলো মাখা মানুষ দেখে।

ঝলমলে আলোয় ভরা মেলা। বুঝতেই পারিনি ঘড়ির কাঁটা ঘুরে গিয়েছে অনেকটাই। সাধুদের তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে এলাম পথে। ফিরতে হবে গৃহীদের তাঁবুতে। এ তাঁবুর শক্ত দড়িতে দেহমন যে আমার বাঁধা।

Kumbh Mela
তাঁবুতে বসে গায়ে ভস্মমাখা সাধুবাবা

আমারই চলার পথে দেখছি এক সাধুবাবা চলছেন লাঠিতে ভর দিয়ে। মাথায় জটা। বয়েসের ভারে সামান্য ঝুঁকে চলেছেন। একমাত্র সঙ্গী বোঝাটা রয়েছে কাঁধে। তেলচিটে মারা গেরুয়াটা কতদিন যে জলের ছোঁয়া পায়নি তা কে যানে! বয়েস অনুমান পঁচাত্তর থেকে আশির কাছাকাছি। মাথায় কে যেন এক কৌটা সাদা বার্নিশ ঢেলে দিয়েছে। সঙ্গী এড়িয়ে একটু জোরে হেঁটে ধরলাম সাধুবাবাকে। প্রণাম সেরে ধরলাম সাধুবাবার সঙ্গ। খানিকটা পথ যেতে হবে। খানিক কথা হবে। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলাম, বাবা, মানুষের মুক্তির সহজ পথটা কি আপনার জানা আছে?

থামলেন। প্রসন্ন উজ্জ্বল চোখ দুটো আমার মুখখানায় বুলিয়ে হিন্দিভাষী সাধুবাবা বললেন, হাঁ বেটা, জানা আছে। গাছের ফল ফুল পাতা বাকলের মতোই মানুষের রূপ যৌবন কামনা বাসনা। পাতা ফল ফুল বাকল ঝরলে যেমন গাছ সব মুক্ত হয়, তেমনই মানুষের ওগুলো না ঝরা পর্যন্ত মুক্তি নেই।

খানিকটা নিঃশব্দে চলার পর এল চারমাথা। বাঁ দিকটা দেখিয়ে বললেন, আমি ওদিকে যাব তুই কোন দিক? ইশারায় দেখালাম ডান দিকে। মনে মনে বললাম, সংসারের পথ। দুজনে দাঁড়ালাম। আবার প্রণাম করলাম। শেষ কথাটা বললাম শেষেই, বাবা, জীবনের শেষ প্রান্তে এসেছেন। সারাটা জীবন তো শুধু পথই চললেন। এই চলার পথে ভগবানের বসার জায়গাটা কি কোথাও খুঁজে পেয়েছেন?

Kumbh Mela
রাতের কুম্ভমেলা

এ কথায় এক গাল অপার্থিব হাসিতে ভরে উঠল সাধুবাবার মুখখানা। ডানহাতের লাঠিটা নিলেন বাঁ হাতে। এবার ডান হাতটা আমার পিঠে রেখে বললেন, পেয়েছি বেটা, ভগবানের বৈঠকখানা ভক্তের হৃদয়ে। ছবি – শিবশংকর ভারতী

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button