কয়েক লক্ষ টাকার শাড়ি থেকে হাজার বছরের স্থাপত্য, কোথায় গেলে দেখবেন সবকিছু
এমন পাখি যার ছবি তোলার জন্য বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়। হাজার হাজার পায়ের ছাপ গাধাদের। হাজার বছর পুরনো সূর্যমন্দির। কয়েক লক্ষ টাকার শাড়ি দেখার সুযোগ।
এমন বেশ কিছু জায়গা আছে যেখানে নিজেরা যাওয়া যায় কারও সাহায্য ছাড়াই, ঘোরাও যায় সুন্দর ভাবে, যেমন হরিদ্বার পুরী দার্জিলিং দিঘার মতো এমন অনেক জায়গা। কিন্তু কিছু জায়গা আছে যেখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গেলে অনেক হ্যাপা। যেমন টিকিট কাটা, হোটেল বুকিং করা, বনবিভাগ থেকে লিখিত অনুমতি নেওয়া, সেখানে ঘুরে দেখার জন্য গাড়ি বুকিং করা ইত্যাদি। এসবের ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে এবারে কয়েকটি বিশেষ জায়গা ঘুরলাম কলকাতার একটি বিখ্যাত ভ্রমণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
গুজরাটের উত্তর-পশ্চিমে কচ্ছ একটি জেলা। সুদূর অতীতে ভুজ ছিল জাদেজা রাজাদের সামন্ত রাজ্য এই দ্বীপভূমি কচ্ছের রাজধানী। এসময় আরবসাগরের অংশ ছিল ৫০০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বিচিত্র ক্ষুদ্র অঞ্চল রণ। এর দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক খোলা। উত্তর ও পূর্ব অংশে রয়েছে রণ নামে অগভীর জলের নোনা খাড়ি। গুজরাটের বৃহত্তম জেলা কচ্ছে এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে মরুভূমি ও সাগরবেলার। প্রাকৃতিক কারণে কচ্ছ উপসাগর সুন্দরভাবে বিচ্ছিন্ন করেছে উপদ্বীপ কাথিয়াবাড় থেকে ভুজকে। এর উত্তরে ধূধূ করছে বিস্তীর্ণ মরু অঞ্চল, তার উত্তরে পাকিস্তান। থর মরুভূমির অংশ হচ্ছে কচ্ছ।
‘রান’ শব্দের অর্থ হল লবণাক্ত জলাভূমি। বর্ষাকালে জলে ডুবে থাকা ক্ষুদ্র রান শীতকাল থেকে গ্রীষ্মের পূর্ব পর্যন্ত বাতাসে নুন, মাটির স্তরেও নুনের প্রলেপ। চাষবাসের অযোগ্য ৫০০০ বর্গ কিমি জুড়ে কচ্ছের উত্তরে রানের নুন ফাটা মাটির উপর বিরল প্রাণি বন্য গাধার বাস। চরম রুক্ষ ফাটা ফাটা এই অঞ্চলে প্রায় চোখের বাইরে বাবলা কাঁটার ঝোপ আর কিছু রুক্ষ ঘাস জমি। এখানে রুক্ষ অঞ্চলই এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ভারতে বুনো গাধার দল দেখা যায় দুটো জায়গায়। কচ্ছ এলাকায় মেলে খর-এ (Khur) আর লাদাখে মেলে কিয়াং-এ (Kiang)। গাইডের কথায়, বর্তমানে কচ্ছের এই এলাকায় ৫০০০ হাজার গাধার বাস।
ওয়াইল্ড অ্যাস স্যাঞ্চুয়ারিতে বন্য গাধা দেখতে চলেছি হুড খোলা জিপে। মাইলের পর মাইল জিপ ছুটছে নুন-ঢাকা ফাটাফাটা ধূসর ঊষর ভূমির উপর দিয়ে। বহুদূর থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাধাদের দেখা যায়। গাড়ি যত এগোয় ওরা ততই পালাতে থাকে। একসময় গাড়ি দাঁড়ায়। ধীর পায়ে এগিয়ে যাই। ছবি তুলি। আসাটা সার্থক হল।
এখানকার জমি ফাটাফাটা হলেও এর সৌন্দর্যই অসাধারণ। এর উপরে হাজার হাজার পায়ের ছাপ গাধাদের। এ ছাপগুলি পড়ে বর্ষাকালে। কচ্ছের পূর্বতম অংশে লিটল রান সারা পৃথিবীতে প্রসিদ্ধিলাভ করেছে বিরল প্রজাতির বুনো গাধার অভয়ারণ্য হিসাবে। বাবলা জাতীয় উদ্ভিদ আর ঘাসগুল্মের আশ্রয়ে বুনো গাধা ছাড়াও নীলগাই, কৃষ্ণসার, চিঙ্কারা, মরু শিয়ালদেরও বাস এই ভূমিতে। কানঠুটি গগনবেড় সারস ও ঈগলের যথেষ্ট ওড়াউড়ি থাকলেও আমার নজরে পড়েনি। তবে নজরে পড়ল নীলগাই ও সাইবেরিয়ান ক্রেন। এগুলি জিপে চলতে চলতেই দেখিয়ে দিলেন গাইড কাম ড্রাইভার মুন্নাভাই। হঠাৎ জিপটা থামিয়ে একরকম হাত থেকে ছোঁ মেরে ক্যামেরাটা নিলেন। সামনে ফটাফট একটা পাখির ছবি তুললেন। পাখিটা এরপর উড়ে গেল। ড্রাইভার খুশিতে অস্থির হয়ে বললেন, সাব, আপনার ট্যুরের সমস্ত খরচাই উঠে গেল। এই পাখির নাম ম্যাকুইন বাস্টার্ড। এর ছবি তোলার জন্য অনেক ক্যামেরাম্যান বহুদিন ধরে অপেক্ষা করেও এর দেখা পায় না। ডিসেম্বর মাস থেকে এদের দেখা যায় এখানে। মার্চে ফিরে যায় পাকিস্তানে।
প্রায় আড়াই ঘণ্টার এই Wild Ass Sanctuary-তে চোখ ও মনের আরাম হল। হোটেলে ফেরার পথে একটা লবণ তৈরির কারখানায় ঢুঁ মেরে প্রায় সন্ধ্যায় ফিরে এলাম হোটেলে।
এবার চলুন মোধেরা যাই। ভারতে তিনটি বিখ্যাত প্রাচীন সূর্য মন্দির আছে। কোণার্কের সূর্যমন্দির, জম্মুতে মার্তণ্ড মন্দির, তৃতীয়টি গুজরাতে শিল্প সুষমামণ্ডিত মোধেরার সূর্য মন্দির। আমেদাবাদ থেকে মন্দিরটি ১০০ কিমি দূরে অবস্থিত। মেহসানা থেকেও বাসে আসা যায় ২৬ কিমি।
চারদিক পাঁচিলে ঘেরা পার্কের মতো একটা সাজানো বাগানের পরিবেশ। ভারী সুন্দর। সামান্য হাঁটা পথ। ডান পাশে একটা প্রশস্ত কুণ্ড রেখে উঠে এলাম একটু উঁচু পাথরে বাঁধানো সূর্যমন্দির অঙ্গনে। কুণ্ড সভামণ্ডপ আর প্রাসাদ নিয়েই চোখ জুড়োনো মন্দির। মন্দিরের পিছন দিয়ে কুলকুল ভাবে বয়ে চলেছে ক্ষীণ স্রোতা পুষ্পবতী। চালুক্য রীতি মতান্তরে ইরানি শৈলীতে নির্মিত মন্দির। নির্মাণকাল ১০১৬-১৭ সাল। নির্মাণ করেছিলেন প্রথম রাজা সোলাঙ্কি। একথা জানা যায় এখানে পাওয়া একটি শিলালেখ থেকে। সূর্যবংশীয় রাজা ছিলেন ভীমদেব। কুলদেবতা হিসাবে তিনি পুজো করতেন সূর্যদেবকে। একসময় তিনি আরাধ্য দেবতার কথা ভাবেন, নির্মাণ করান মন্দির।
ঘুরে ঘুরে দেখছি ভিতরে বাইরে অসম্ভব সুন্দর অলঙ্করণ। মোধেরার এই মন্দিরটি সেই সময়ের শিল্পকলার এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এই মন্দিরের বৈশিষ্ট্য হল সম্পূর্ণ মন্দিরের বিভিন্ন অংশ জোড়া লাগানোর সময় কোথাও চুন ইত্যাদির ব্যবহার করা হয়নি। মন্দিরটি ভীমদেব নির্মাণ করান তিনভাগে। প্রথমভাগ গর্ভগৃহ, দ্বিতীয় সভামণ্ডপ, তৃতীয় সূর্যকুণ্ড। মন্দিরেরে গর্ভগৃহ ৫১ ফুট ৯ ইঞ্চি লম্বা, চওড়ায় ২৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। বিশাল হলঘর ও গৃহ সম্বলিত এই মন্দিরের কারুকার্য দেখার মতো। উপরের ছাদ গম্বুজাকৃতি। মন্দিরের দেওয়ালে খোদিত অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গজনীর সুলতান মামুদের হাতে। মন্দিরটি এমন জ্যামিতিক ছকে নির্মিত যে, সূর্যের বিষুব রেখায় অবস্থানকালে উদিত সূর্যের কিরণ সরাসরি এসে পড়ত সূর্য বিগ্রহের উপরে। গর্ভগৃহে সূর্যদেবের প্রাচীন বিগ্রহ আজ আর নেই।
দেখতে দেখতে চলছি আর কারুভরা মূর্তিগুলি দেখে বিস্ময়ে অবাক হচ্ছি। সেকালের মূর্তিগুলি না থাকলেও প্রাসাদের কুলুঙ্গিতে রয়েছে ১২টি সূর্যদেবের মূর্তি। মন্দিরের বহির্ভাগও কারুমণ্ডিত। মন্দিরে সভামণ্ডপে স্তম্ভ রয়েছে ৫২টি। বছরের ৫২ সপ্তাহের জন্য নিবেদিত ৫২টি স্তম্ভে খোদাই করা বিগ্রহগুলিতে আছে রামায়ণ মহাভারত ও কৃষ্ণলীলার নানান গাথা। নানান ভঙ্গিমায় দেবদেবী নরনারী ও জীবজন্তুর সঙ্গে রয়েছে কোণার্কের মতো মূর্তি। রয়েছে মিথুন মূর্তি, সুন্দর ও নিখুঁত। প্রধান প্রবেশপথের ডানপাশে প্রসবরতা একটি নারীমূর্তিও কম আকর্ষণীয় নয়। আবু পাহাড়ে দিলওয়ারা এবং কোণার্কের সূর্য মন্দিরের কারুকলার সঙ্গে কিছু কিছু জায়গায় সাদৃশ্য আছে। স্থাপত্যকলার এক অপূর্ব নিদর্শন মোধেরা সূর্যমন্দিরের কার্নিশ, স্তম্ভ, খিলান, পিরামিডধর্মী ছাদ ইত্যাদি।
মোধেরার প্রধান আকর্ষণ সূর্যকুণ্ড বা রামকুণ্ড। সভামণ্ডপের আগে আয়তকার বিশাল এই জলাশয়ের চারদিকে রয়েছে কারুকার্যখচিত সিঁড়ি। সঙ্গে আছে গণেশ বিষ্ণু শিব ও শীতলাদেবীর মন্দির। এছাড়াও কুণ্ডটি শোভিত ১০৮টি ক্ষুদে মন্দিরে। এক কথায় অপূর্ব, নয়নাভিরাম মোধেরা সূর্যমন্দির ও কুণ্ড। একডালি আনন্দ ও মানসিক তৃপ্তি নিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাসের বিস্ময়কর শিল্পসম্ভার নিয়ে এইভাবে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী এই মন্দির। প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক এখানে আসেন শুধু শ্রদ্ধা নয়, ইতিহাসের অনন্য সুন্দর শিল্প ও কীর্তির সাক্ষী হতে।
এশিয় সিংহদের স্বাধীনভাবে খোশমেজাজে চলাফেরার একমাত্র জঙ্গল গুজরাটের গির অরণ্য। এর আসল নাম শাসন গির। পৃথিবীতে মাত্র দুটো জায়গা আছে যেখানে সিংহরা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায় কারও তোয়াক্কা না করে। সেটি আফ্রিকায় আর ভারতের গির অরণ্যে।
অতীত কথা, একসময় যথেচ্ছ সিংহ শিকারের ফলে সিংহের সংখ্যাটা এসে পৌঁছল একেবারে তলানিতে। তখন এই গির অরণ্য ছিল জুনাগড়ের নবাব পরিবারের শিকারক্ষেত্র। ১৯০০ সালের কথা। গির অরণ্যকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল বলে ঘোষণা করলেন নবাব স্যার মুহাম্মদ রসুল খাঞ্জি বাবি। এর অনেক অ-নে-ক পরের কথা। ভারত সরকার জাতীয় উদ্যান বলে ঘোষণা করল ১৯৬৫ সালে। গির অরণ্য সোমনাথের উত্তর-পূর্ব দিকে ৪৩ কিমি দূরে।
১৯৬৯ সালে গির সংরক্ষিত অরণ্যরূপ পেয়েছে ১৫১৬ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে। পরবর্তী সময়ে আয়তন বেড়ে হয়েছে ৫০০০ বর্গ কিমি। তবে এখন কোর এলাকা ১৪৩২ কিমি। ১৯৯৫ সালে ১৫৭ মিটার উঁচুতে সুখে ঘরসংসার পেতে বসেছিল ৩০৪টি সিংহ। তখন চিতা পরিবারের সংখ্যা ছিল ২৬৮টি। ধীরে ধীরে ২০১৫ সালের সিংহসুমারি ইত্যাদিতে সিংহের সুখের সংসারে সদস্য বেড়ে হল ৫২৩-এর মধ্যে ২০৯টি পুরুষ সিংহ, ২১৩টি নাবালক শিশু। এছাড়া বর্তমানে লেপার্ড (জাগুয়ার) ৩১১, হায়েনা ১৩০, স্পটেড হরিণ ৪৩৩৬, সম্বর ৪০০১, নীলগাই ১৯০৯, প্যান্থার, চারশিঙ্গের এন্টিলোপ ৫০৮, চিঙ্কারা ৭৩৭। সিংহের জন্য সুখ্যাত হলেও গির অরণ্যে পরমানন্দে বিচরণ করছে লেপার্ড, নানান প্রজাতির হরিণ, বনবিড়াল, হায়েনা, বানর আর অসংখ্য বিভিন্ন ধরনের পাখি। গির অরণ্য শোভিত আফ্রিকান ও এশিয়ান সিংহে। এই প্রজাতির মধ্যে আফ্রিকান সিংহের তুলনায় একটু বড় এশিয়ান সিংহ। একটা কথা ফাঁকতালে বলে রাখি, সিংহী একসঙ্গে পাঁচটি সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম।
গাড়িতে সাফারির সময় সকাল ৬টা থেকে ৯, ৯টা থেকে বেলা ১২টা আর বিকেল ৩টে থেকে ৬টা পর্যন্ত। গির ঘুরতে অনুমতি পত্র নিতে হয়ে সিংহ সদন ওরিয়েন্টেশন সেন্টারের কাউন্টারে।
হুড খোলা জিপসি গাড়িতে ঘুরলে সঙ্গে গাইড নিলে ভালো। জঙ্গলে কোথায় গেলে সিংহের দেখা পাওয়া যাবে তা এদের নখদর্পণে।
আমরা হুডখোলা জিপসিতে নয়, উঠলাম বনবিভাগের নিজস্ব বাসে। এই বাসগুলি আকারে ছোট। বসার সিট ২৭টা। জঙ্গলের মধ্যে কাদার উপর দিয়ে চলে যাওয়া সাপের দাগের মতো আঁকাবাঁকা পিচের রাস্তা। পথের দু-পাশে গভীর ঘন জঙ্গল নয়, একটু পাতলা। ড্রাইভারের শকুনের চোখ। মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে। কখনও ডানদিকে, কখনও বাঁদিকে সিংহ, নীলগাই, জাগুয়ার, হরিণ, হায়েনা – এমন নানান ধরনের পশু দেখতে দেখতে এগিয়ে চলা। এরা খোশমেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক। ক্যামেরা খোলাই ছিল। ছবি উঠল ফটাফট। এর আগে গুজরাট ঘুরেছি আটবার। কোনওবারই গিরে আসা হয়নি। এই প্রথম আসা। আনন্দ আর আনন্দ নিয়েই হোটেলে ফিরে আসা।
গুজরাটে সোলাঙ্কি রাজাদের আমলে অতীতের রাজধানী অনহিলবাড়া। পাটনে গজনীর সুলতান মামুদের হাতে অনেক মন্দির ও দেবদেবীর বিগ্রহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে মাটির কয়েক শো ফুট নিচে রক্ষা পায় ও অক্ষত থেকে যায় রানি-কি-ভাও স্থাপত্যটি। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে। নামার পথে দুপাশের দেয়ালে অসংখ্য দেবদেবীর নিখুঁত সুন্দর খোদাই করা মূর্তি। অধিকাংশ মূর্তিগুলি নারায়ণভিত্তিক।
একেবারে নিচে কুয়োর মতো জলাধার। অতীতে একসময় এই স্থাপত্যটি ছিল মাটির নিচে। ভারতের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রচেষ্টায় উদ্ধার হয় নিখুঁত ভাবে। একথা জানিয়েছেন স্থানীয় গাইড। রাজা ভীমদেবের পত্নী পাটনের রানি উদয়মতির অবদান এই ‘রানি-কি-ভাও’। রানি ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক। তাঁরই পছন্দ অনুসারে কুয়োর চারদিকে খচিত হয় অসংখ্য বিষ্ণুমূর্তি।
পাটনের আর একটি বিখ্যাত স্থান পাটোলা হাউস, এটি বর্তমানে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত। পাটনের এক গর্ব পাটোলা রেশমি শাড়ি। এর নাম আজ দিকে দিকে। এক অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় সুতো। রেশমি সুতোর উপর গিট বেঁধে বেঁধে তার উপর চড়ানো হয় ভেষজ রঙ। কোচিনীল (Cochineal) পোকার থেকে লাল, বেদানার খোসা থেকে হলুদ, নীলগাছ থেকে নীল রঙ, এমন নানান ধরনের রঙের সুলুক সন্ধান পাটনের কয়েক হাতেগোনা পরিবারেরই জানা। শুধুমাত্র রং তৈরিই নয়, টানা ও পোড়েনের সুতো রঙে চোবানো হলে তবেই শুরু হয় কাপড় বোনার কাজ। এক একটি কাপড় তৈরি হতে সময় লাগে কমপক্ষে ছয় থেকে সাত মাস। ক্ষেত্র বিশেষে সময় লাগে আরও বেশি। দামও তেমন। এক থেকে দেড় দু লক্ষ টাকা। আজ অর্ডার দিলে তিন চার বছরের আগে উপায় নেই। বর্তমানে লাখ টাকা দামের এই শাড়ি টিকে আছে মাত্র কয়েকজন শিল্পীর সৌজন্যে।
পাটন পাটোলা হেরিটেজ কেন্দ্রটি দেখছি ঘুরে ঘুরে। কিভাবে এই শাড়ি তৈরি হয় তার আদ্যোপান্ত ছবিতে ধরা আছে এই হেরিটেজ কেন্দ্রে। ফিলিপিন্স, নরওয়ে, ইন্দোনেশিয়া, কোথায় নেই এই শিল্প! যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। অনেক অ-নে-ক বছর আগে রবিঠাকুরের স্নেহধন্য শিল্পী নন্দলাল বসুও এসেছিলেন পাটোলা হেরিটেজ কেন্দ্রে। তিনি এই শিল্প দেখে বিস্ময়ে হতবাক ও মুগ্ধ হয়েছিলেন। একটি ঘরে বিভিন্ন পেপার কাটিং শোভা পাচ্ছে বিখ্যাত মানুষদের। তার মধ্যে আছে বাংলার স্বনামধন্য শিল্পী নন্দলাল বসুর বাংলায় লেখা শংসাপত্র। তিনি জানিয়েছেন, দেশের অর্থবান সম্প্রদায়ের কাছে অনুরোধ করেছেন এই শিল্পের প্রতি মনোযোগী হতে যাতে শিল্পটি বেঁচে থাকে।
মন্দির এলাকা অনেকটা এলাকা জুড়ে। তবে মন্দিরটি বিশাল আকারের নয়। গোটা মন্দির চত্বর শ্বেতপাথরে বাঁধানো। মন্দিরটিও তাই। গর্ভমন্দিরের উঁচু আসনে অবস্থান করে আছে সিংহ। দেবী দুর্গার বিগ্রহ আসনে। তবে মুরগির উপরে দেবী সমাসীন। বিগ্রহগুলি দেখতে সত্যিই সুন্দর। গুজরাতে বসবাসকারীদের ধারনা তিন শক্তিপীঠ আছে এখানে। তার অন্যতম একটি মুরগাবালি শক্তিপীঠ। মন্দিরের পূজারি জানিয়েছেন এখানে দেবী দুর্গার ডানহাত পড়েছিল।
৫১ পীঠের যে শাস্ত্রীয় মতামত ও নাম এবং স্থানের উল্লেখ আছে, তার মধ্যে এই মুরগাবালি দেবীর কোনও উল্লেখ নেই। মন্দির ও দেবী প্রসঙ্গ এটুকুই। এখানে বেশি সময় লাগে না।