মকরসংক্রান্তি কি, কেন পালন করা হয়, পালনে কী লাভ হয়
উত্তুরে হাওয়ার দাপটে থরহরিকম্প বাংলার মানুষ। সামনেই মকরসংক্রান্তি। সংক্রান্তির দিন পার না হওয়া পর্যন্ত নাকি ঠান্ডা আমেজ লেগে থাকবে গায়ে, এমনটাই বিশ্বাস অধিকাংশ মানুষের। কেন এই বিশ্বাস?
উত্তুরে হাওয়ার দাপটে থরহরিকম্প বাংলার মানুষ। সামনেই মকরসংক্রান্তি। সংক্রান্তির দিন পার না হওয়া পর্যন্ত নাকি ঠান্ডা আমেজ লেগে থাকবে গায়ে, এমনটাই বিশ্বাস অধিকাংশ মানুষের। কেন এই বিশ্বাস? মকরসংক্রান্তির অর্থের মধ্যেই রয়েছে তার ব্যাখ্যা। ‘সংক্রান্তি’ শব্দটিকে ভাঙলে দাঁড়ায় ‘সং + ক্রান্তি’। ‘সং’ অর্থাৎ বিভিন্ন রূপে সাজা। ‘ক্রান্তি’ অর্থাৎ গমন বা স্থানান্তর। যার সম্পূর্ণ অর্থ করলে দাঁড়ায়, ভিন্ন রূপে সেজে এক স্থান থেকে অন্যত্র গমন।
আগামী ১৪ জানুয়ারি শেষ হচ্ছে বাংলা পৌষ মাসের মেয়াদ। এর সাথেই শেষ হতে চলেছে প্রকৃতির রুক্ষতা শুষ্কতা। এরপরেই বঙ্গাব্দ ১৪২৪-এর মাঘ মাসের শুরু। রাশিবিজ্ঞানীদের মতে, এই ক্ষণটি সেই বিশেষ মুহুর্ত যখন সূর্য নব রূপে ‘ধনু’ রাশি ত্যাগ করে প্রবেশ করেন ‘মকর’ রাশিতে। শুরু হয় সূর্যের ‘উত্তরায়ণ’। সূর্যের আলো পেয়ে প্রাণ ফিরে পায় রুক্ষ পৃথিবী। এই উপলক্ষে পৌষ মাসের শেষ দিনটি পালিত হয় ‘মকরসংক্রান্তি’ বা ‘পৌষ সংক্রান্তি’ বা ‘পিঠে সংক্রান্তি’ হিসেবে। কিন্তু সূর্য তো স্থির নক্ষত্র। তার আবার উত্তর দিকে গমন কিভাবে সম্ভব? এর ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় বিজ্ঞানে।
২৩ সেপ্টেম্বর দিনটি বিজ্ঞানে ‘জলবিষুব’ নামে চিহ্নিত। এই তারিখ থেকে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে অর্থাৎ আমাদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে সূর্যের। আর ধীরে ধীরে সূর্যের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে দক্ষিণ গোলার্ধ। কর্কটক্রান্তি রেখার সীমানা পেরিয়ে সূর্য ঢলে পড়তে থাকে মকরক্রান্তি রেখার দিকে। এই মহাজাগতিক ঘটনাকেই বলা হয় সূর্যের ‘দক্ষিণায়ন’। যে জন্য আস্তে আস্তে শরতের পর থেকেই ভোর রাতে ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজের পরশ পান আপামর বঙ্গবাসী। পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জায়গায় অনেক সময় পৌষ থেকে শুরু হয় শৈত্যপ্রবাহ। সূর্যের প্রখর তাপ না থাকায় গরমের হাত থেকে মেলে মুক্তি। অন্যদিকে দক্ষিণের মহাদেশ অস্ট্রেলিয়া তখন পোড়ে আগুনে গরমে।
এদিকে পৌষ মাসের শেষ দিন আসা মানে এককথায় বঙ্গ জীবনে উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রারম্ভিক বাৎসরিক পদক্ষেপের সূচনা। পৃথিবীর উত্তর ভাগ ক্রমশ ঢলে পড়তে থাকি সূর্যের দিকে। বড় হতে থাকে দিন, আর ছোট হতে থাকে রাত। ‘মকরক্রান্তি’ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সেই মুহুর্তের সূচনালগ্নই ‘মকরসংক্রান্তি’। বিজ্ঞানের ভাষায় সূর্যের ‘উত্তরায়ণ’।
‘মকরসংক্রান্তি’-র পৌরাণিক ব্যাখ্যাও যথেষ্ট চমকে দেওয়ার মত। সূর্য নাকি এই লগ্নে তাঁর ছেলে মকর অধিপতি শনির বাড়ি যাত্রা শুরু করেছিলেন। তাই এই দিনটিকে বাবা-ছেলের সম্পর্কের মিলনের দিন হিসেবে পালন করা হয়। আবার মহাভারতে ভীষ্মের শরশয্যার সঙ্গে মকরসংক্রান্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের গল্প পেয়েছে আলাদা মাত্রা। প্রিয় প্রপৌত্র অর্জুনের অগুন্তি শরে কুরুক্ষেত্রের ভূমিতে শরশয্যা হয়েছিল ভীষ্মের। ভীষ্ম পিতা শান্তনুর থেকে পেয়েছিলেন স্বেচ্ছামৃত্যুর বর। তাই শরশয্যায় শুয়েও তিনি সহ্য করে গিয়েছিলেন মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা। কারণ, সেইসময় চলছিল সূর্যের দক্ষিণায়ন। দেবলোকে দক্ষিণায়নকে তুলনা করা হয় রাতের সঙ্গে। রাতের বেলা সবাই যেমন ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘুমোন, তেমনই ওই সময় দেবতারাও স্বর্গদ্বার বন্ধ করে ৬ মাস টানা বিশ্রাম নেন। ওইসময় যদি ভীষ্ম স্বেচ্ছা মৃত্যু বরণ করতেন, তাহলে তাঁকে স্বর্গের দরজায় দাঁড়িয়ে দেবতাদের ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করতে হত। তাছাড়া কথিত আছে সূর্যের দক্ষিণায়নে দেহত্যাগ মানে প্রাণের পুনর্জন্ম। আর উত্তরায়ণে মৃত্যু মানে পৃথিবী থেকে চিরমুক্তি।
তাই মর্ত্যে থেকে শরশয্যার যন্ত্রণা সহ্য করা অনেক ভালো বলেই মনে হল ভীষ্মের কাছে। সেইসঙ্গে উপরি পাওনা কৃষ্ণের মধুর বচন। এই ভেবে ভীষ্ম অপেক্ষা করতে লাগলেন সূর্যের উত্তরায়ণের জন্য। অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মকরসংক্রান্তির পুণ্যক্ষণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন পিতামহ ভীষ্ম। অন্যদিকে সূর্যের উত্তরায়ণের শুরু মাত্রই খুলে গেল স্বর্গের দ্বার। ঘুম ভাঙল দেবতাদের। তাঁদের তুষ্ট করতে মর্ত্যলোকে শুরু হয়ে গেল যজ্ঞ, উপাদেয় মিষ্টান্ন সহযোগে পুজোপাঠ। অন্যদিকে ভীষ্মের মহাপ্রয়াণকে স্মরণে রেখে মর্ত্যবাসীর কাছে ‘কর্কট সংক্রান্তি’-র চেয়ে অধিক গ্রহণীয় হয়ে উঠল ‘মকরসংক্রান্তি’।