Kolkata

অভিযোগ ধরে ধরে হাসপাতালগুলোকে তুলোধোনা করলেন মুখ্যমন্ত্রী

চিকিৎসা পরিষেবা, ইট-কাঠ বিক্রির ব্যবসা নয়। এটা একটা সেবা। পেট ভরাতে গিয়ে রোগীকে ভুল বোঝাবেননা। রোগীর টাকা না থাকলেও প্রয়োজনে চিকিৎসা দিন। পাশে থাকুন। এদিন টাউন হলে রাজ্যের বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিং হোমের কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে বৈঠকে এদিন এভাবেই তাঁদের সতর্ক করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বেসরকারি হাসপাতালের পরিষেবা থেকে অস্বাভাবিক বিলের বোঝা, সবকিছু নিয়ে এদিন ক্ষোভ উগরে দেন মুখ্যমন্ত্রী। অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে যে রোগীদের ঘটিবাটি বিক্রি করিয়ে দিচ্ছে হাসপাতালগুলি, তাও এদিন কোনও রাখঢাক না করেই বলেন তিনি। ক্লাসে ছাত্ররা দিনের পর দিন পড়া না করলে যেভাবে তাদের এক এক করে দাঁড় করিয়ে একজন শিক্ষক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন, আর না পারলে শাস্তি দেন, অনেকটা সেই ধাঁচেই এদিন এক এক করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষদের তুলোধোনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। রোগীদের বিভিন্ন দামী পরীক্ষা করতে দেওয়ার জন্য বা অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসার পরামর্শের বিনিময়ে চিকিৎসকদের কমিশন ব্যবস্থা চালু নিয়েও এদিন মুখ্যমন্ত্রীর কড়া মন্তব্যের মুখে পড়তে হয় হাসপাতালগুলিকে। এক এক করে হাসপাতালের কর্তৃপক্ষকে দাঁড় করিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সামনে এনে রীতিমত তাদের চাপে ফেলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। বোঝাই যাচ্ছিল মুখ্যমন্ত্রী এদিন হোম ওয়ার্ক করেই বসেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আমতা আমতা করতে দেখা গেছে মুখ্যমন্ত্রীর রোষের মুখে। অপ্রয়োজনেই যে রোগীদের অনেক সময়ে আইসিইউ বা ভেন্টিলেশনে নিয়ে যাওয়া হয় তাও এদিন বুঝিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সাধারণ জ্বরজারি হলেও তাকে ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়া বলে রোগীদের ভয় দেখানো হয়, অযথা রক্তপরীক্ষা করিয়ে অনেকক্ষেত্রে রোগীদের প্লেটলেট কম বলে ভয় পাওয়ানো হচ্ছে। এসব বন্ধ করতে হবে বলেও এদিন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। অ্যাপোলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে মুখ্যমন্ত্রী পরিস্কার জানান, তারা শহরের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিল করে। কেন করা হচ্ছে এমন বিল? এই প্রশ্নের জবাবে অ্যাপোলোর দাবি, তারা সব প্রোটোকল মেনে চলে। আর সেই প্রোটোকল মেনে চলতে গিয়েই বিলের অঙ্ক বাড়াতে হয় তাদের। সব শুনে বিল নিয়ে তাদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন মুখ্যমন্ত্রী। মেডিকা হাসপাতালকে তো এদিন সকলের সামনে অপ্রস্তুতে ফেলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। সরাসরি জিজ্ঞেস করেন, তারা কিডনি পাচার বন্ধ করেছে কিনা? রুবি হাসপাতালকেও অসম্ভব বিল করা নিয়ে একহাত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আগামী দিনে বিল যাতে কিছু কম হয় সেদিকে তাঁরা নজর রাখবেন বলে আশ্বাস দেন রুবি কর্তৃপক্ষ। সেইসঙ্গে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী তাদের সাফ জানিয়েছেন, রুবির কোনও মেডিক্যাল রেকর্ডও পাওয়া যাচ্ছেনা কেন? রুবি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁরা আগামী দিনে ই-রেকর্ড ও ই-প্রেসক্রিপশন চালু করার চেষ্টা করছে। কেপিসি হাসপাতালকে হাসপাতাল গড়ার জন্য জমি দিয়েছে রাজ্য সরকারই। সেখানে এক অভিনেত্রীর দেহ আটকে মোটা অঙ্কের বিল মেটানোর চাপ নিয়ে সম্প্রতি হৈচৈ হয়েছিল। সেই প্রসঙ্গ টেনে মুখ্যমন্ত্রীর জিজ্ঞাসা, দেহ আটকে রেখে টাকা চাইছেন আপনারা? উত্তরে সন্ত্রস্ত কর্তৃপক্ষ আত্মপক্ষ সমর্থনে জানান ঘটনাটি ঘটলেও তারপর থেকে তাঁরা সতর্ক। আর এমন ঘটনা ঘটেনি। হাসপাতালটির পরিচ্ছন্নতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বারবার। সে প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর জিজ্ঞাসার উত্তরে মুখ্যমন্ত্রীকেই হাসপাতাল পরিদর্শনে আসার নিমন্ত্রণ দিয়েছেন কেপিসি কর্তৃপক্ষ। তাঁদের দাবি এখন তাঁদের হাসপাতাল সম্পূর্ণ পরিচ্ছন্ন। এমনকি তাঁদের দাবি, রোগীর আর্থিক সঙ্গতি বুঝে প্রয়োজনে বিল কমিয়েও দেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথ টেগোর এক প্যাকেজ দিচ্ছে আর এক বিল করছে বলে অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নজর দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। শহরের আর এক নামী বেসরকারি হাসপাতাল বেলভিউ। যেখানে একসময় মুখ্যমন্ত্রী নিজেই ভর্তি ছিলেন বেশ কিছুদিন। সেখানকার চিকিৎসা পরিষেবা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে বলে এদিন সরাসরি অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী। অথচ বিলের বেলায় মোটা অঙ্কের টাকা রোগীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে। অস্বীকার করেননি বেলভিউ কর্তৃপক্ষও। তাঁদের দাবি অনেক নার্স চলে যাওয়ায় তাদের পরিষেবা কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। বিল কমানো নিয়েও তাঁরা আলোচনা করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন বেলভিউ কর্তৃপক্ষ। পাল্টা মুখ্যমন্ত্রী জানান, হাসপাতালের নার্স চলে গেছে কী যায়নি তা দেখা সরকারের দায়িত্ব নয়। বরং নার্সদের মাইনে বাড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। সিএমআরআইয়ে সাম্প্রতিক ভাঙচুরকে কেন্দ্র করেই রাজ্যের বেসরকারি চিকিৎসা পরিষেবার বিষয়টি নিয়ে নড়ে চড়ে বসেছে রাজ্য সরকার। এদিনের মিটিংয়েরও উৎস সেই ভাঙচুরই। এদিন মুখ্যমন্ত্রী সাফ জানান, সিএমআরআইতে ভাঙচুর কখনই ঠিক হয়নি। কিন্তু সিএমআরআই-ও অস্বাভাবিক বিল করছে। কর্তৃপক্ষের আশ্বাস তাঁরা বিল কমানোর সবরকম চেষ্টা ভবিষ্যতে করবেন। তবে কিছুটা হলেও মুখ্যমন্ত্রীর বকাবকির হাত থেকে রেহাই পেয়েছে রামকৃষ্ণ সারদা মিশন, মাড়ওয়ারি রিলিফ সোসাইটি বা ইন্সটিটিউট অফ নিউরো সায়েন্সের মত হাসপাতালগুলি। অস্বাভাবিক বিল না করে চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে এদের দাবি শুনেও কোনও মন্তব্য করেননি মুখ্যমন্ত্রী। তবে নিউরো সায়েন্সকে আরও কম খরচে ভাল পরিষেবা দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তা করলে আগামী দিনে তাদের দিকও সরকার ভেবে দেখবে বলে আশ্বস্ত করেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী এদিন রোগীদের সঙ্গে আরও বেশি মানবিক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে হাসপাতালগুলিকে জানান, এবার থেকে তাদের যাবতীয় কাজের ওপর নজর রাখবে একটি মনিটরিং কমিশন। যেখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, সাধারণ মানুষ ও হেলথ রেগুলেটরি কমিশনের প্রতিনিধিরা থাকবেন। কমিশনের রিপোর্ট প্রতি মাসে তাঁর কাছে পাঠাতে হবে। সেই রিপোর্ট নিজে পরীক্ষা করে দেখবেন তিনি। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি স্বাস্থ্যমন্ত্রীও। ফলে তিনি যে রাজ্যের স্বাস্থ্য নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলির বেপরোয়া ব্যবসা মেনে নেবেন না তা এদিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন ৩০টি নার্সিংহোমের লাইসেন্স বাতিল ও ৭০ নার্সিংহোমকে শোকজ করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর।

 



Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button