Durga Pujo

দেবীপক্ষে বেলগাছকে দুর্গারূপে পুজো করা হয়, প্রাচীন এক পুজোর ইতিহাস

প্রতিপদ থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত সাবেকি রীতি মেনে একটি বেলগাছকে দেবী হিসাবে পুজো করা হয়ে থাকে। পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মহাষ্টমীর সন্ধিপুজো।

কলকাতা জুড়ে যে গুটিকয়েক বনেদি বাড়ির পুজো আজও স্বমহিমায় ঝলমল করছে তার একটি নিঃসন্দেহে মতিলাল শীলের পারিবারিক পুজো। কলুটোলার শীল পরিবারের ২০০ বছরের এই পুজোর শুরু করেন সে সময়ের ধনাঢ্য জমিদার তথা বহু সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব মতিলাল শীল। এখনও পরিবারের সকলে একযোগে হাতে হাত মিলিয়ে পারিবারিক পুজোর ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন। এঁরাই এই পুজোর ধারক ও বাহক।

কলুটোলায় মতিলাল শীলের অট্টালিকাসম বাড়িতেই তিনি দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। সেসময়ে বাড়িতে দুর্গাপুজো শুধু পুজো ছিল না, ছিল সমাজের সম্ভ্রান্ত নাগরিক হওয়ার একটি প্রতীক। যাঁদের পরিবারে দুর্গাপুজো হত আমজনতা তাঁকে সমীহের চোখেই দেখতেন।


Mutty Lall Seal

মতিলাল শীলের বাড়ির পুজো তার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। কখনও বন্ধ হয়নি। কখনও বাধা পড়েনি এ পুজোয়। বাড়িতে ঢুকলেই বিশাল ঠাকুর দালান। সামনে দুর্গামণ্ডপ। পুরনো কলকাতার স্মৃতি নিয়ে দালানের চারপাশ ধরে বিশাল অট্টালিকা। পরপর ঘর। বারান্দা। শীল বাড়ির এই পুজো কিন্তু কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজোগুলোর মধ্যে বেশ নামকরা। পুজোর সময়ে যে সমস্ত পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে, তেমন অনেকগুলি পুরস্কার শীল পরিবারের ঝুলিতে রয়েছে। বনেদি বাড়ির পুজো বিভাগে একের পর এক পুরস্কার জিতেছে মতিলাল শীলের বাড়ির পুজো।


Mutty Lall Seal

শীল বাড়ির পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয় উল্টোরথের দিন থেকে। উল্টোরথের দিনে গরানকাঠের কাঠামো পুজো হয়। পুজোর পুরোহিত ও প্রতিমাশিল্পী বংশ পরম্পরায় এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত। এবছর প্রতিমা গড়েছেন অখিল পাল আর পুরোহিত গোপাল বটব্যাল।

Mutty Lall Seal

মতিলাল শীল বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন। পুরনো কলকাতার একজন বিশিষ্ট মানুষও ছিলেন তিনি। একসময়ে তাঁর জমিদারি ছড়ানো ছিল বাগনান, মেদিনীপুর, উত্তর ২৪ পরগনা এবং বাংলাদেশেও।

কলুটোলা স্ট্রিটের শীল বাড়িতে এখন চার শরিকের বসবাস। তবে এঁদের সকলের পদবী মল্লিক। মতিলালের ছোটছেলে কানাইলাল শীল এই বাড়িটি পেয়েছিলেন। কানাইলালের ছেলে গোপাললালের দুই কন্যা হেমকুমারী ও সুকুমারী দাসী। গোপাললাল শীলের কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। ফলে তাঁর ভাগ্নেরা সম্পত্তি পান। তারপর থেকে তাঁরাই পুজো চালিয়ে আসছেন।

Mutty Lall Seal

এখন চার শরিক মেজ, সেজ, নতুন ও ন’। এক একটি বছরে পুজোর দায়িত্ব এক একজন শরিকের। পুজো হয় পরিবারের পরম্পরা, রীতিনীতি মেনে। খরচও দাঁড়ায় লক্ষাধিক টাকা। পুজোর সময়ে এ বাড়ির মহিলাদের সাজেও থাকে বিশেষত্বের ছোঁয়া।

মহালয়ার পর দিন প্রতিপদ। এই পরিবারের রীতি হল ওদিন ঠাকুরের ঘট স্থাপন করা হয়। ঘট স্থাপন করা হয় বোধনঘরে। সেখানেই চলে পুজো। একেবারে ষষ্ঠীর দিন দালানে ওই ঘট আনা হয়। অর্থাৎ দেবী মূর্তির সামনে আসে ঘট। তার আগে মানে প্রতিপদ থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত সাবেকি রীতি মেনে একটি বেলগাছকে দেবী হিসাবে পুজো করা হয়ে থাকে। এসময়ে প্রতিদিন চণ্ডীপাঠও হয়।

শীলদের পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মহাষ্টমীর সন্ধিপুজো। এই পুজোয় একমন আতপ চাল লাগে। পুজোয় চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। এছাড়া, এই পুজোর প্রচলিত আচারের মধ্যে পড়ে অষ্টমীর সকালে আরতির পরে মানত অনুসারে মেয়েদের ধুনো পোড়ান। আর নবমীর দিন রাতে হয় ব্রাহ্মণ বিদায়। আগে বেশ ঘটা করে ব্রাহ্মণ বিদায়ের অনুষ্ঠান হত। বহু ব্রাহ্মণকে বিদায় করা হত। এখন সেই সংখ্যাটা ১০ থেকে ১৫ জন ব্রাহ্মণে এসে ঠেকেছে। বিদায়ী হিসাবে ব্রাহ্মণদের দেওয়া হয় ভোগের প্যাকেট আর নগদ বিদায়ী হিসাবে ৫০টি করে টাকা।

বিসর্জনের ক্ষেত্রেও বিশেষ প্রথা পালন করে আসছে কলুটোলার শীল পরিবার। প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় স্ট্র্যান্ড রোডে মতিলাল শীলের নামাঙ্কিত ঘাটে। এও এই পরিবারের প্রাচীন রীতি। মাকে জলে ফেলার আগে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে পরিবারের তরফে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর চল ছিল। কথিত আছে এই নীলকণ্ঠ পাখি নাকি উড়ে যেত কৈলাসে। সেখানে দেবাদিদেবকে মায়ের ফেরার আগাম খবর দিত। ১৯৯৯ সালে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ান নিষিদ্ধ হওয়ার পর সেই রীতি আর পালিত হয়না।

Mutty Lall Seal

বিসর্জনের পরে ঠাকুরদালানে বসে তিনবার শ্রী শ্রী ওঁ দুর্গা সহায় কথাটি লেখার পরে পুরোহিত শান্তির জল ছেটান। এরপরে প্রথা মেনে চলে সিদ্ধিপান। সেইসঙ্গে বিজয়ার কোলাকুলি, শুভেচ্ছা বিনিময়। শীল বাড়ির পুজোয় পুরনো নিয়মের রদবদল হয়েছে কিছুক্ষেত্রে। ১৯৪৬ সালে কলকাতার দাঙ্গা এক ভয়ংকর ইতিহাস। তার আগে পর্যন্ত কাঁধে করে প্রতিমা পৌঁছত বিসর্জনের ঘাটে। তারপর থেকে সেই নিয়ম উঠে গিয়েছে।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button