সাড়ে ৭ হাজার ফুট উচ্চতায় অতিপবিত্র এক সরোবর, এর জলে স্নান করা নিষেধ
জিপ যত উপরে উঠছে ততই বাড়ছে পথের নির্জনতা, বাড়ছে বনের গভীরতা। এ পথ কখনও পাহাড়ি ধসে ভয়ঙ্কর, কখনও সুন্দর আনন্দময়।
এখানে আগেও এসেছি। তাই এ পথ আমার পরিচিত। পথিক তখনই অকৃতজ্ঞ, যখন ঘুরে আসা পথের কথা ভুলে যায়। সেবার উত্তরকাশীতে থাকা হয়নি। যমুনোত্রী থেকে সোজা উত্তরকাশী। বাস থেকে নেমে একটু বিশ্রাম, একটু চা জলপান। তারপর একে একে গঙ্গোত্রী-গোমুখ-কেদার-বদরী করে শেষে ঘরে ফেরা।
উত্তরকাশীতে উঠেছি কালীকমলী বাবার ধর্মশালায়। আশ্রম, ধর্মশালাই আমার পছন্দ। গঙ্গার চরণ ছুঁয়ে ধর্মশালা। এবার উত্তরকাশীতে থাকা একদিনের জন্য। নভেম্বর মাস। হালকা শীতের সকাল। পরিচ্ছন্ন সুনীল আকাশ। মেঘের কোনও জটলা নেই। ফিসফিসে হাওয়া বইছে। আগের দিন বলা ছিল। সাতসকালেই জিপ এসে হাজির। ড্রাইভার ‘কাম’ জিপের মালিক কেন্দ্র সিং চৌহান।
ঝলমলে আকাশ নিয়েই বেরিয়েছি সকাল আটটায়। পাহাড় মানেই চড়াই-উতরাই। কখনও সামনে খানিক উঠছে, কখনও নামছে, আবার কখনও চলছে প্রায় সমতলের মতো পথে। পাহাড়ি পথ মানুষের জীবনপথেরই মতো। এখন চলছে ধরাসু যাওয়ার পথ ধরে। গঙ্গা আমাদের সঙ্গিনী। জিপ যত উপরে উঠছে ততই বাড়ছে পথের নির্জনতা, বাড়ছে বনের গভীরতা। কখনও কখনও চোখে পড়ছে পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা এক-আধটা ঝর্ণা। ক্লান্ত ঝর্ণার ক্লান্তি অপনোদন হয়েছে পাহাড়ি খাদে বয়ে যাওয়া ছিপছিপে সুন্দরী স্নিগ্ধ নদীর অধর চুম্বনে। এ পথ কখনও পাহাড়ি ধসে ভয়ঙ্কর, কখনও সুন্দর আনন্দময়। পথে কোথাও থামেনি। একটানা চলে জিপ এসে থামল চৌরঙ্গী খাল। এরই মধ্যে পেরিয়ে এসেছি ২৯ কিমি। এখনকার উচ্চতা ৭৬২০ ফুট। জিপ যেখানে দাঁড়াল তার সামনেই একটা মন্দির। এটি চৌরঙ্গীনাথের মন্দির। এর চারদিক পাঁচিলে ঘেরা। চারচালা টিনের ছাউনি। মন্দিরের বিপরীতেই সরকারি বিশ্রামগৃহ।
কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলাম মন্দিরে। দেখছি, বেদিতে স্থাপিত সাদা পাথরের মূর্তিটি হরপার্বতীর, সঙ্গে আরও দুটি মূর্তি। প্রাচীনত্বের কারণে, এ দুটির স্বরূপ বোঝা গেল না। মন্দির আর দেববিগ্রহ উভয়েই অনাড়ম্বর।
এখান থেকেই নচিকেতা তালের যাত্রাপথের শুরু। খানিকটা এগতেই পথ ভাগ হয়ে বাঁদিকে নেমে গিয়েছে সমান উতরাই আর ডানদিকের পথটা ক্রমশ চড়াই। এ পথটাই ধরলাম।
শুরু করলাম হাঁটা। সঙ্গী হলেন সুদর্শন ড্রাইভার চৌহান। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই এগতে লাগলাম। হালকা শীতের রোদ। আকাশটা ঝরঝরে শরতের। বর্ষা নেই, তাই আকাশ গোমড়ামুখো নয়। প্রকৃতির মেজাজটাই এখন আলাদা। পাশেই পাহাড়ি খাদ। কখনও পথের ধারে লতাগুল্ম আর হাজার রং-বাহারি ফুল, কত নাম নাজানা গাছ, কখনও চির পাইনের গভীর ঘন বন। নির্জন, একেবারেই নির্জন। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই সবুজ আর সবুজ।
সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসলাম। বুক ভরে শ্বাস নিলাম টান টান হয়ে। এমনটা নেওয়া হয় না কলকাতায়। নির্মল বাতাস। বেলা বেড়েছে। হালকা শীতের আকাশ হয়ে উঠল আরও ঝলমলে। এবার তাকালাম সামনের দিকে। এ পাহাড়ে রুক্ষতা নেই। হাজার হাজার ঘনঘোর সবুজ চির পাইনে ঢাকা ক্রমোচ্চ পাহাড়ি ঢাল। এর গাঢ় সবুজ, দেখলে মনে হয় কালো। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে দূরে বান্দরপুচ্ছ পর্বতশৃঙ্গের সারি। শৃঙ্গগুলি সৃষ্টি করেছে এক অনির্বচনীয় স্বর্গীয় পরিবেশ, বরফ, বরফ আর বরফ। অনন্ত বরফ জমা পর্বত। কিছুতেই চোখ ফেরানো যায় না। চোখের সামনেই যেন তুষার রাজ্য। হালকা কুয়াশার আবরণ যেন লজ্জাবতী প্রকৃতরানির মাথায় ঘোমটা। ধ্যান-গম্ভীর হিমগিরির মৌনশান্তি যেন এখনে আত্মসমাহিত করে তোলে। একের পর এক পর্বতশৃঙ্গ। পক্বকেশ অশীতিপর বৃদ্ধের মাথা যেন। যত এগোচ্ছি ততই মনটা ভরে উঠছে এক অপূর্ব মাদকতায়। হালকা ঠান্ডা হাওয়ায় পাহাড়ি গাছের গন্ধ মেশানো। চারদিকে অনন্ত সবুজের ছড়াছড়ি। সূর্যের আলো গাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে এসে পড়েছে ছায়াঘেরা ঝরা পাতায় ঢাকা পথে। সূর্য নির্বিবাদে নির্মেঘে আলো-আঁধারির লুকোচুরির খেলা খেলে চলেছে সরলবর্গীয় শ্যামলা এই বনের পাহাড়ি পথের আঁকে-বাঁকে। গাছের স্নিগ্ধ ছায়াভরা পথ সমানে উঠে গিয়েছে আঁধারি ছায়া মেখে।
পাহাড়ে প্রকৃতির বিচিত্র কারিগরি দেখতে দেখতে এসে পৌঁছলাম খানিক উতরাইয়ে দেড় কিমি। এলাম নচিকেতা তাল। চৌরঙ্গী খাল থেকে হাঁটাপথে তিন কিমি। সময় লাগল এক ঘণ্টা।
একটু লম্বাকৃতি ডিমের মতো লেক। জল টলটল করছে। তপস্যারত প্রাচীন ঋষিদের মতোই শান্ত ধীর-স্থির এই নচিকেতা তালের জলরাশি। সঙ্গী ড্রাইভার চৌহানের কথায়, ‘আমি আগেও অনেকবার এসেছি। দেখেছি, বছরের কোনও সময়েই এই লেকের জলের হ্রাস-বৃদ্ধি নেই। বর্ষাকালেও এখানকার মতো জলের বৃদ্ধি নেই। এ জল অধ্যাত্মিকভাবে বড় পবিত্র বলে মানা হয়। তাই লেকের জলে স্নান করা নিষেধ। উদ্দালক ঋষির পুত্র নচিকেতা (মতান্তরে বাজশ্রবার পুত্র) এই লেকের সৃষ্টি করেন। বহু শত বছর তপস্যারত ছিলেন এখানে। তাই তাঁর নামানুসারেই লেকের নাম নচিকেতা তাল।’
গাঢ় নীল জলে নানা আকারে অজস্র মাছের বাহারি নাচ দেখার মতো। লেকের চারদিকে ঘিরে বিশাল চিরের সারি। ছায়া পড়েছে জলে। এরই পাড়ে ছোট্ট একটা মন্দির। এটির নির্মাতা উত্তরকাশীর বনবিভাগ। মন্দিরে স্থাপিত সাদা পাথরের বিগ্রহটি হরপার্বতীর। সঙ্গে আছে একটি কালো পাথরের শিবমূর্তি। সাদামাটা মন্দির। মন্দির প্রাঙ্গণেই পোঁতা ত্রিশূলের পাশে রয়েছে একটি হোমকুণ্ড। অনন্তের মৌন ইতিহাস যেন এখানেই লেখা আছে, হিমালয় গহনে প্রশান্ত নিভৃত এই নচিকেতা তালে, ছোট্ট হরপার্বতী মন্দিরে।