স্মরণের এই বালুকাবেলায়
পিতার সঙ্গে সন্তানের টান যে কী, হৃদয়ের কোন গোপনতম কোণায় তার বসবাস, তা সামনে বসে দেখলাম সেদিন।
‘তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে…।’ ‘দাদার গলা। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে। গানটা শুনে হঠাৎ চোখের কোণটা খচখচ করে উঠল। কলতলায় হাত-পা ধুতে ধুতে প্রথম অনুভব করলাম বাবা নেই। যাঁর সঙ্গে কোনও দিন শিকড়ের টানটাই বোধ করিনি, তাঁর মৃত্যুটা বুকের ভেতর থেকে একটা কষ্টকে মোচড় দিয়ে বের করে আনল। আজও সেকথা মনে পড়লে গলাটা ধরে আসে। এটাই আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা।’ কথাটা শেষ হল না। কিছুক্ষণের জন্য থামলেন এক সত্তরোর্ধ যুবক! বেশ বুঝলাম চোখের জলটা বাইরের লোকের সামনে বড় কষ্ট করে ধরে রাখতে হচ্ছে মানুষটাকে। কিছুটা সময় দিলাম। পিতার সঙ্গে সন্তানের টান যে কী, হৃদয়ের কোন গোপনতম কোণায় তার বসবাস, তা সামনে বসে দেখলাম সেদিন।
সুধী পাঠকগণ, বলে রাখা ভাল যাঁকে নিয়ে আমাদের এই লেখা, তিনি বাংলা অভিনয় জগতের স্বনামধন্য অভিনেতা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আর শুরুটা যে কাহিনি দিয়ে করলাম সেই মুহুর্তটা তাঁর সাক্ষাৎকারের শেষ প্রান্তে ঘটেছিল। কিন্তু একটা মানুষের জীবনের নানা কথা বলার আগে তাঁর মর্মস্পর্শী দিকটা সকলের কাছে পরিস্কার করে দেওয়াটা আমাদের উচিৎ মনে হল।
পরাণবাবুর শৈশবটা কেটেছে বাংলাদেশের যশোর জেলায়। পিসির কাছে মানুষ। জন্মের পরপরই মাকে হারান। মানুষ হন পিসির কাছে। পিসিকেই মা বলে জানতেন। এদিকে মায়ের মৃত্যুর প্রভাব বাবার ওপর এতটাই পড়েছিল যে তিনি নিজেকে সংসার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন। নিজের মত ঘুরে বেড়াতেন। কদিচ কখনও বাড়ি আসতেন। সময় কাটাতেন। ফলে ছোট থেকেই বাবার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না। দূরত্বটা এতটাই ছিল যে বাবাকে অনেকদিন পর্যন্ত কাকা বলে ডেকেছেন তিনি।
‘ছোটবেলায় খুব দুরন্ত ছিলাম। বাজ পড়া এক নারকেল গাছে চড়ে পাখির বাসা থেকে পাখির ছানা চুরি করে একবার পিসির কাছে প্রচণ্ড বকুনিও খেতে হয়েছিল। বাঁচিয়েছিলেন দিদিমা। দিদিমার দাপট ছিল খুব। সারা গ্রামের লোক তাঁকে সম্মান করতেন। সেই দিদিমাই পাখির ছানার জন্য খাঁচা এনে তাকে বড় করেন।’ পুরনো দিনের কথায় বিভোর এক মানুষ তখন এক টানা বলে চলেছেন নিজের শৈশব থেকে কৈশোরের নানা গল্প। আমিও কোনও কথা না বলে শুধু শুনে চলেছি। কথা বলার ভঙ্গিমায় আরও সুন্দর লাগছিল তাঁর প্রতিটি কাহিনি। ‘আমার নাম ছিল মোহন। কিন্তু সেই নামে আমায় কেউ চেনে না। দিদিমা আমায় পরাণ বলে ডাকতেন। সেই সময়ে গ্রামবাংলায় মানুষ ‘প্রাণ’ কথাটা উচ্চারণ না করে সহজ করে ‘পরাণ’ শব্দটা ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। সেই থেকেই আমি পরাণ হয়ে গেলাম। সত্যি বলতে কি পরে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন কবিতায় বার বার এই পরাণ শব্দটা দেখতে আমার খুব ভাল লাগে’।
‘ভৈরব নদীর কাছে আমাদের বাড়ি ছিল। বাড়িতে ছিল বিশাল চণ্ডীমণ্ডপ। সেখানে দুর্গাপুজোর অনেক আগে থেকে শুরু হত ঠাকুর তৈরি। পুজোর খড়ে এক মাটি পড়লে আমাদের গ্রামে ঢাকে কাঠি পড়ার রেওয়াজ ছিল। সে এক আলাদা অনুভূতি। আকাশে বাতাসে পুজোর গন্ধ ভেসে বেড়াত। কাশের দোলা, শিউলির গন্ধ বলে দিত পুজো আসছে। কি আনন্দ যে হত! আমাদের বাড়িতে একমাস আগে থেকেই দরিদ্র নারায়ণ সেবা শুরু হত। আর আমরা কচিকাঁচার দল পুজোর আগে থেকে পেতে শুরু করতাম ‘পার্বণী’, সহজ কথায় পুজোর বাজার খরচা। বাড়ির বড়রা এক আনা, দু আনা, চার আনা করে যে যেমন পারতেন আমাদের দিতেন। আর আমরা ভাইবোনেরা তা জমিয়ে রাখতাম দেশলাইয়ের বাক্সে। আর পুজোর অনেকদিন আগে থেকে মাঝে মধ্যেই বের করে গুনতাম। ওটাই ছিল আমাদের পুজোর হাত খরচ’।
‘পুজোর আগে আসত আমাদের ভাইয়েদের জন্য ইজের আর ফতুয়া। মাঝেমধ্যেই সেসব নতুন জামার গন্ধ শুঁকতাম। পুজোর দিনগুলো তো আনন্দে কাটতোই। আর ছিল বিসর্জন। ভৈরব নদীর পাড়ে বসে বিসর্জন দেখতাম। নদীর পাড়ে সেদিন মেলা বসত। বাবা সেদিন যেখানেই থাকুন না কেন আসতেন। আমাকে আর দাদাকে নিয়ে যেতেন নদীর পাড়ে। নৌকোয় করে ভাসান হত। মাঝ নদীতে গিয়ে দুটো নৌকা দুদিকে সরে যেত, আর ঠাকুর জলে পড়ত। বিসর্জন দেখতে দেখতেই সন্ধে নামত ভৈরব নদীর পাড়ে। মেলার স্টলগুলোয় হ্যারিকেনের আলো উঠত জ্বলে। মনে আছে, মেলায় অনেক মাটির খেলনা বিক্রি হত। আর ছিল খাওয়ার মজা। পদ্মপাতায় জিলিপি বিক্রি হত তখন। জিলিপির রস পদ্মপাতার ওপর পড়ে মুক্তোর মত জ্বলজ্বল করে উঠত’!
‘একবার রথের মেলায় বাবার সঙ্গে যাচ্ছি। দাদাও আছেন। তো বিকেলের দিকে একটা কালভার্টের ওপর বসে খানিকটা জিরিয়ে নিচ্ছি। এমন সময় দাদা বাবাকে একটা গান গাইতে বললেন। বাবা না করলেন না। সেই পড়ন্ত বিকেলের সিঁদুর রাঙা আলোয় বাবা গাইলেন ‘তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে…।’ আজও সেই গান আমার কানে বাজে।’ কথা বলতে বলতে যেন সেই শৈশবের দিন গুলোয় ফিরে গেছেন পরাণবাবু। তাই কোনও প্রশ্নের ঝুঁকি নিলাম না। শুধু শুনে গেলাম। ‘তখন সিটি কলেজে পড়ি। এমন সময় খবর এল বাবা আর নেই। তেমন কিছু মনে হল না। বাবার সঙ্গে নাড়ির টান তো তেমন কোনও দিনই অনুভব করিনি। তাই মৃত্যুটাও ছুঁয়ে গেল না। এর কিছুদিন পর বাবার কাজের দিন খেলে ফিরেছি। সন্ধের মুখ। বাড়িতে দাদা বৌদিরা রয়েছেন। আমি হাত-পা ধুতে কলতলায় গেছি। এমন সময় শুনতে পেলাম দাদাকে কোনও এক বৌদি বললেন একটা গান করতে। দাদার ছিল উদাত্ত কণ্ঠস্বর। খোলা গলায় দাদা গেয়ে উঠলেন বাবার গাওয়া সেই গান, ‘তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে…।’ যাঁর সঙ্গে কোনও দিন শিকড়ের টানটাই অনুভব করিনি, তাঁকে হারানোর কষ্টটা প্রথম বুঝলাম কলতলায় দাঁড়িয়ে। টের পেলাম, বাবা আর নেই। চোখটা খচখচ করে উঠল। বুঝলাম বাবাকে হারানোর কষ্টটা বুকের ভেতর মোচড় দিচ্ছে। চোখটা মুহুর্তে জলে ভিজে গেল’।
এক স্বনামধন্য অভিনেতার সাক্ষাৎকার যখন নিতে এসেছি তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই অভিনয়ের কথা এসে পড়ল। ‘এগারো বছর বয়স থেকেই অভিনয় শুরু। দমদমে নিমাই সরকার নামে এক ব্যক্তি পাড়ার ছেলেপিলেদের নিয়ে বছরে কয়েকটা নাটক করাতেন। সেই দলে আমিও ছিলাম। তখন থেকেই সকলে আমার অভিনয়ের প্রশংসা করতেন। অভিনয় করে সোনার মেডেলও পেয়েছি।’ কৈশোরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সেই পুরনো দিনে ফিরে যাওয়া এক ভারাক্রান্ত মানুষ এবার যেন অনেকটা স্বাভাবিক। সপ্রতিভ! অভিনয় জীবনের শুরুর কথা বলতে গিয়ে একটা কাহিনি বলে ফেললেন পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘ওই এগারো-বারো বছর বয়সে একদিন রাস্তা দিয়ে আসছি। হঠাৎ আমায় কোলে তুলে নিলেন আমার মামার এক বন্ধু। বিশাল চেহারার একটা মানুষ আমার মত রোগা একটা ছেলেকে চেপে ধরেছে। ভয় পেয়ে গেলাম। কাঁদতে শুরু করলাম। দেখি উনিও আমায় আদর করতে করতে কাঁদছেন। আর আগের দিন করা নাটকে অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করছেন।’ জীবনে বহু প্রশংসাই হয়তো পেয়েছেন। কিন্তু সেই প্রশংসা যে তাঁকে কতটা ছুঁয়ে গেছে তা বেশ বুঝলাম পারণবাবুর মুখের দিকে চেয়ে।
‘এরপর স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, অফিসে অনেক নাটক করেছি। সেবার অফিসে ক্লাব থেকে ‘শেষ সংবাদ’ নাটকটা মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। দেখতে এসেছিলেন সে সময়ের নামকরা অভিনেতা অমল কর।’ পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় প্রতিভা অমলবাবুকে আকৃষ্ট করে। তিনিই পরাণবাবুকে তাঁর ‘প্রাচীতীর্থ’ নামে গ্রুপ থিয়েটারে নিয়ে যান। সেখানে ‘সাঁকো’ নাটকে পরাণবাবুর অভিনয় দেখে এক রোগা চেহারার মানুষ এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরেন। কে এই ভদ্রলোক? চিনতে পারেননি নব্য মঞ্চাভিনেতা পরাণবাবু। পরে অমল করের কাছে জেনেছিলেন ওই ব্যক্তি আর কেউ নন, সেসময়ের ডাকসাইটে অভিনেতা হেমাঙ্গ বিশ্বাস!
যদিও এর কিছুদিন পর ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যাওয়ার পর নাটক নিয়ে এতদিনের ভাবনা সম্পূর্ণ বদলে যায়। পরাণবাবুর মতে, এখানে আসার পর বুঝলেন একটা লক্ষ্য নিয়ে নাটক করতে হয়। এরপর রেডিও, টিভিতে ক্রমাগত নাটক, সিরিয়াল শুরু হয়। তবে নাটক যে এখনও তাঁর প্রথম পছন্দ তা বলতে ভোলেননি এই সফল অভিনেতা। তাঁর মতে, ‘নাটক আমার মায়ের মত। ছেলে দেশে, বিদেশে যেখানেই থাকুক না কেন মায়ের জন্য তার মন ছটফট করবেই।’ তবে একথাও স্বীকার করলেন, আজকাল আর্থ সামাজিক কারণে অনেকে সিরিয়ালের দিকে ঝুঁকছেন। এতে নাটক কিছুটা গতি হারাতে পারে। তবে নাটক চিরন্তন। থিয়েটার থামে না, থামতে পারে না। আর থিয়েটার ছাড়া অভিনয় হয়না।
এই বয়সেও একটা মানুষের জীবনে তাঁর শৈশব যে কতটা প্রভাব বিস্তার করে আছে তার ফের টের পেলাম সাক্ষাৎকারের শেষ লগ্নে এসে। নাটক, সিনেমা, অভিনয় নিয়ে এত আলোচনার শেষে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় আবার ফিরে গেলেন তাঁর শৈশবের এক না ভোলা অভিজ্ঞতায়। হয়ত কোনও দিন ভুলতে পারবেনও না। ‘তখন দুপুর বেলা। দাদা কাজ থেকে ফিরে খেতে বসতে যাবেন। এমন সময় এক বৃদ্ধা ভিখারিনী এসে হাজির। দাদার খাওয়া তখনও শুরু হয়নি। দাদা উঠে গিয়ে একটা আসন পেতে বৃদ্ধাকে বসতে বললেন। তারপর রীতিমত দাঁড়িয়ে থেকে ওই বৃদ্ধাকে খাওয়ালেন। আর নিজে রইলেন খালি পেটে।’ সেদিনের সেই শিক্ষা আজও ভোলেননি পরাণবাবু। বললেন, সেদিনের সেই শিক্ষাই তাঁকে অভিনয় জগতে সফল করেছে। জিজ্ঞেস করতেই হল কিভাবে? মুচকি হেসে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘অভিনেতা আহত হতে পারেন, চরিত্র নয়। তাই স্টেজে অভিনেতার পায়ে পেরেক ফুটে যেতে পারে। কিন্তু অভিনয়ে তার প্রভাব পড়তে নেই। এশিক্ষা তো সেদিন দাদার সেই খলি পেটে থেকেও অভুক্ত এক বৃদ্ধাকে খাওয়ানোর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল।’ মনে মনে পরাণবাবুর দর্শনের তারিফ না করে পারলাম না।