Mythology

তর্পণ ও পিণ্ডদান কেন করা হয়

সীতা কুণ্ড নামক স্থানটিতে পিণ্ডদান করেছিলেন মা জানকী। হাত বাড়িয়ে সেই পিণ্ড গ্রহণ করেছিলেন রাজা দশরথ। সাক্ষী ছিল অক্ষয়বট, বহমান ফল্গুনদী, গোমাতা, পুরোহিত তথা ব্রাহ্মণ এবং তুলসী।

ভারতীয় তীর্থগুলির মধ্যে একমাত্র গয়া পারলৌকিক ক্রিয়াভূমি। স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক উভয় মৃত্যুর পরে আত্মার সদগতির জন্য গয়ায় পিণ্ডদান এক মহৎ ও পরম কল্যাণ কর্ম। যেকোনও রকম অপঘাত মৃত্যুর পর অতৃপ্ত আত্মার প্রভাবে নানান ধরণের অমঙ্গল জনক ঘটনা ঘটে থাকে সংসারজীবনে। যেমন সমস্ত শুভ কাজে বাধা, কারণে অকারণে সাংসারিক ও মানসিক অশান্তি, পারিবারিক স্বাস্থ্যহানি, নানান ধরণের ভৌতিক ও অশরীরী অত্যাচার ইত্যাদিতে জীবন অনেক ক্ষেত্রে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে গয়াতে পিণ্ডদানমাত্রই আত্মার তৎক্ষণাৎ মুক্তি ও অতিষ্ঠকর জীবনযন্ত্রণার হাত থেকে পলকমাত্র রক্ষা পাওয়া যায়।

যাদের উদ্দ্যেশ্যে পিণ্ডদান করলে পিণ্ডদাতা ও তার পরিবারের অশেষ কল্যাণ ও অতৃপ্ত আত্মার মুক্তি হয় সেই বিষয়গুলির উপর আলোকপাত করছি –


১। নিজ কুলে যার মৃত্যুর পর আত্মা গতিলাভ করতে পারেনি। ২। মাতামহ কুলে মৃত্যু হয়ে যাদের গতি হয়নি। ৩। বন্ধুবর্গকুলে মৃত্যু হয়ে যাদের গতি হয়নি। ৪। যাদের দাঁত ওঠার পূর্বে মৃত্যু হয়েছে অথবা যাদের গর্ভমাসে মৃত্যু হয়েছে ৫। যারা আগুনে দগ্ধ হয়ে যারা গেছে কিংবা মৃত্যুর পর যাদের অগ্নিসংস্কার হয়নি কিংবা যারা বজ্রাঘাতে অথবা চোর ডাকাত কিংবা আততায়ীর দ্বারা নিহত হয়েছে। ৬। যারা বনে দাবাগ্নিতে কিংবা কোনও পণু কর্তৃক নিহত হয়েছে। সর্পাঘাতে, গলায় দড়ি, বিষপান, বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে, অস্ত্রাঘাতে মারা গেছে কিংবা আত্মহত্যা করেছে ৭। যারা অরণ্যে, পথমধ্যে, যুদ্ধস্থলে, ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় পীড়িত হয়ে, জলে ডুবে, অথবা যারা ভুত প্রেত পিশাচ হয়েছে। ৮। কালের নিয়মে রৌরব অন্ধতমিশ্র নামক নরকে যারা গমন করেছে। ৯। মৃত্যুর পর প্রেতলোকে গিয়ে যারা অসহ্য যন্ত্রণা পাচ্ছে ১০। যমের শাসনাধীন হয়ে যারা অজস্র যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে। ১১। নরকে অবস্থান করে যারা যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে ১২। যারা পশুযোনি, পক্ষীযোনি সরীসৃপাদি যোনি প্রাপ্ত হয়েছে। ১৩। বৃক্ষ থেকে যাদের জন্ম। ১৪। যারা নিজ নিজ কর্মফলে শত সহস্র নানা যোনিতে জন্য গ্রহণ করছে কিন্তু দুর্লভ মনুষ্যজাতিতে জন্মলাভ করতে পারছে না। ১৫। স্বর্গে, অন্তরীক্ষে, পৃথিবীতে নিজের পিতৃগণ বা বান্ধবগণের মধ্যে যে কেউ অবস্থান করছে, যার বা যাদের অগ্নিসংস্কার হয়নি। ১৬। যারা (পিণ্ডদানকারীর) এজন্মে বন্ধু বান্ধব, অন্যান্য জন্মে বন্ধু বান্ধব ছিলেন। ১৭। পিতৃবংশে মাতৃবংশে, গুরুবংশে, শ্বশুর বংশে যে কেউ মারা গেছে এবং যাদের পিণ্ডলোপ হয়েছে, যারা স্ত্রী পুত্রাদি বিবর্জিত, যাদের ক্রিয়াকর্ম লোপ পেয়েছে, যারা জন্ম থেকেই অন্ধ, যারা পঙ্গু, যারা বিরুপ অঙ্গহীন এবং গর্ভস্রাবে যারা বিনষ্ট হয়েছে, এমন কি যাদের জানা নেই তাদের উদ্দ্যেশ্যে ১৮। ব্রহ্মা থেকে শুরু করে নিজ পিতৃবংশে যারা পিণ্ডদানকারীর দাস ভৃত্য, আশ্রিত ও সেবক তথা মিত্র, মিত্র পশু এবং যারা দৃশ্য বা অদৃশ্য থেকে পিণ্ডদানকারীর উপকার করেছে, জন্ম জন্মান্তরে পিণ্ডদানকারীর সঙ্গে যাদের সঙ্গ হয়েছিল তাদের উদ্দ্যেশ্যে পিণ্ডদান করা যেতে পারে।

গয়াসুর ভগবান শ্রীবিষ্ণুর কাছে বর প্রার্থনা করেছিলেন, ‘আমার দেহশিলা স্পর্শমাত্র সুর অসুর, কীটপতঙ্গ, পাপী, ঋষি, মুনি, ভূত প্রেত পিশাচ সবাই পবিত্র হয়ে যেন মুক্তিলাভ করে।’ শ্রীবিষ্ণু তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন। গয়াতে পিণ্ডদান মাত্রই আত্মার মুক্তি ও সদগতি লাভ হয়।


ঋষি সনৎকুমার বলেছিলেন শৌনিকমুনি ও দেবর্ষি নারদকে, ‘গয়াক্ষেত্রে পিতৃপুরুষদের উদ্দ্যেশ্যে যেকোনও দিন পিণ্ডদান করা যেতে পারে। মলমাসে, জন্মনক্ষত্রেও গয়াশ্রাদ্ধ অর্থাৎ পিণ্ডদান হয়ে থাকে। গয়াতে দিনরাত সবসময় শ্রাদ্ধ করতে পারা যায়।’

যার উদ্দ্যেশ্যে পিণ্ডদান কর্ম করা হবে, গয়াতে যাওয়ার আগে বাড়িতে তার ফটো থাকলে সেই ফটোতে নাম ধরে নিমন্ত্রণ জানাতে হবে এইভাবে, ‘আমি গয়াতে তোমায় পিণ্ডদান করে মুক্তি দিতে যাচ্ছি। তুমি সঙ্গে যেও ও পিণ্ডগ্রহণ করে উদ্ধার হও।’

অনেক সময় এরকম হয়েছে, সমস্ত নিয়মকানুন বিধি পালন করে পিণ্ডদান কার্য সুসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও আত্মা উদ্ধার হয়নি। তার উৎপাত হয়েই চলেছে। পরে আত্মার ভরের মাধ্যমে জানা গেছে, নিমন্ত্রণ করেনি বলে আত্মা গয়াতে গিয়ে পিণ্ডগ্রহণ করেনি। সুতরাং পরলোকগত আত্মাকে নিমন্ত্রণ না করে পিণ্ডদান করলে গয়ায় যাওয়া অনেক ক্ষেত্রে বৃথা হতে পারে।

গয়াতে যে কোনও ব্যক্তি, তার নিজের বংশের কেউ না হলেও, অন্য যেকোনও লোকের নাম গোত্র নিয়ে গিয়ে গয়াতে পিণ্ডদান করলে সেই ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়।

গয়াতে যেকোনও পরলৌকিক ও পিণ্ডদানের কাজ হয় ফল্গুনদীর জল দিয়ে। গঙ্গাজল দিয়ে পিণ্ডদানের কাজ হয় না। গয়াতে পিতৃপুরুষের মুক্তির মুখ্যতীর্থ হল ফল্গু।

পুত্র পিণ্ডদানের উদ্দেশে গয়ায় যাওয়ায় ও ফল্গু স্পর্শমাত্র পিতৃপুরুষ স্বর্গলোকে যায়। গয়ায় শ্রাদ্ধ করতে দেখলে পিতৃপুরুষরা যে লোকেই অবস্থান করুন না কেন, তৎক্ষণাৎ গয়ায় পৌঁছে যান।

বহুকাল ধরে প্রচলিত একটি ধারণা বা মত চলে আসছে, মেয়েরা কোনও পারলৌকিক কর্মের অধিকারী নয়। এ ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত। সধবা বিধবা কুমারী প্রতিটি নারীই সমস্ত রকম পারলৌকিক ক্রিয়াদিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করতে পারে। এতে ক্রিয়াদিতে অংশ গ্রহণকারীর যেমন অশেষ কল্যাণ হয় তেমনই কল্যাণ হয় পরলোকগত আত্মার। বিভিন্ন শাস্ত্রে এই নিষিদ্ধতার কথা আমার নজরে আজও পড়েনি। আমার ভ্রমণজীবনে অসংখ্য সাধু সঙ্গকালীন তাঁদের মুখ থেকেও এমন নিষিদ্ধতার কথা কখনও শুনিনি। একটা ছোট্ট জিজ্ঞাসা? কোনও পরিবারে বাবা মায়ের একটি মাত্র সন্তান সেটি কন্যা। কোনও কারণবশত সেই পরিবারে পিতার অস্বাভাবিক মৃত্যু হন। এখন তার আত্মার সদগতির জন্য পিণ্ডদান করবে কি পাড়ার লোক? রাজা দশরথের উদ্দ্যেশে জানকীর পিণ্ডদানের কথা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে।

কোনও ব্যক্তি, যার কেউ নেই অথবা কেউ যদি আত্ম পিণ্ডদান করতে চায় তাও শাস্ত্রমতে ব্যবস্থা আছে এবং এ কাজ সুসম্পন্ন করা যায় গয়াতে। এরজন্য থাকতে হবে ২১ দিন। প্রথমে গয়ায় গিয়ে নিজের নামে একটি কুশপুতুল তৈরি করে পরে তার মুখাগ্নি করে দাহকার্য সম্পন্ন করতে হয়। তারপর পারিবারিক প্রথা ও আচারমাফিক অশৌচ পালনের পর শ্রাদ্ধাদির কাজ সম্পন্ন করতে হবে। তারপর ২১ দিনের মাথায় আত্মাপিণ্ড দান করতে পারবে। আত্মপিণ্ডদানকারী যে ফল লাভ করে তা বিস্ময়কর। পিণ্ডদানের পরবরতীকালে দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে যে কোনও ধরণের অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে তার তো প্রেতযোনি লাভ হবেই না, তার আশ্রয় হয় বিষ্ণুলোকে।

হিন্দুর পরম পবিত্র তীর্থগুলির মধ্যে অন্যতম গয়া। মহাভারতীয় যুগের মগধরাজ্য আজকের দক্ষিণবিহার। এর উপর দিকে প্রবাহিত ‘মহানদী’ তথা বর্তমানের ফল্গুতীরে গয়া বা গয়শীর্য। এর উত্তরে রামশিলা পর্বত, দক্ষিণে ব্রহ্মযোনি পর্বত।

প্রাচীন এই তীর্থের উৎপত্তি প্রসঙ্গে বিভিন্ন পুরাণ বলেছে নানান কথা। এখন বায়ুপুরাণের কথা। পিতা ত্রিপুরাসুর ও মাতা প্রভাবতীর পুত্র গয়। অসুরকুলে জন্ম। একসময় গয় কঠোর তপস্যার নিরত হলেন কোলাহল পর্বতে। কেটে গেল সহস্র বছর। তপস্যায় প্রীত হলেন ভগবান বিষ্ণু। শঙ্কিত হলেন দেবকুল। দুর্লভ বর যদি কিছু চেয়ে বসে। কারণ দেবতাদের হাতেই নিহত হয়েছে তাঁরই পিতা ত্রিপুরাসুর। অসুরকুল সব সময়েই যে প্রতিশোধপরায়ণ।

অনন্যোপায় দেবতারা গেলেন বিষ্ণুর কাছে। সমস্ত বিষয় অবগত হয়ে ব্রহ্মা, মহাদেব এবং অন্যান্য দেবতাদের নিয়ে বিষ্ণু সদবলবলে উপস্থিত হলেন গয়াসুরের কাছে। এবার প্রীত বিষ্ণু বর প্রার্থনা করতে বললেন। গয়াসুর চাইলেন, তাঁকে স্পর্শ ও দান করে প্রাণীকুল যেন বৈকুণ্ঠে যেতে সমর্থ হয়। গয়াসুরের প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন নারায়ণ।

এর পরের কথা। নারায়ণ একটি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে নির্দেশ দিলেন ব্রহ্মাকে। তবে এই যজ্ঞে প্রয়োজন একটি পবিত্র দেহ। নারায়ণের বরে পবিত্র গয়াসুরের দেহ। এ কথা জেনে ব্রহ্মা গেলেন গয়াসুরের কাছে। দেহটি চাইলেন যজ্ঞের প্রয়োজনে। সানন্দে নিজদেহ দান করলেন গয়াসুর জগতের কল্যাণের জন্য। এবার যোগবলে দেহ বিস্তার করলেন গয়। কোলাহল পর্বত-এর নৈবর্তভাগে মাথা, যাজপুরে নাভিদেশ আর শ্রীক্ষেত্রে চন্দ্রভাগায় রাখলেন চরণ। পাষাণে রূপান্তরিত হল দেহ। এসময় তাঁর দুটি ইচ্ছা পুরণ করলেন নারায়ণ। এক, বুকের উপরে রাখলেন শ্রীচরণ। দুই, গয়াসুরের বক্ষস্থিত চরণপদ্মে আত্মার উদ্দ্যেশ্যে তর্পণ ও পিণ্ডদান করলে আত্মার অক্ষয় স্বর্গলাভ হবে।

বিষ্ণুভক্ত অসুর গয়াসুরের নামানুসারেই নাম হয়েছে স্থানের নাম। এক সময় ধর্মনিষ্ঠ গয় এক বৃহৎ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। গয়ের যজ্ঞ ফলে একটি বটবৃক্ষ চিরজীবী হয়, যা আজও অক্ষয়বট নামে প্রসিদ্ধ।

গরুড়পুরাণে পিতামহ ব্রহ্মা বলেছেন বিশালবুদ্ধি ব্যাসদেবকে, ‘ফল্গুতীর্থে স্নান করে গদাধর দেবতাকে দর্শন করলে সুকৃতিকামনাকারী মানুষের কোন কামনা না পূর্ণ হয়? তার আগের একুশ পুরুষ ব্রহ্মলোকে যায়। পৃথিবীতে যেসব মহাতীর্থ আছে তাদের মধ্যে গয়াতীর্থই প্রধান। কিন্তু ফল্গুতীর্থ সর্বপ্রধান।’ …গয়ায় জনার্দন পিতা রূপে বিরাজ করেন। …গয়াক্ষেত্র পাঁচ ক্রোপ ব্যাপী। এরমধ্যে এক ক্রোশ ব্যাপী গয়াশির। ওই শিরে পিণ্ডদিলে পিতৃলোকের চিরগতি লাভ হয়।’…

অজস্র মহাত্মাকথার পর ব্রহ্ম ব্যসদেবকে বললেন, ‘মানুষ গয়াতীর্থে পিণ্ডদান করলে যেরকম পুণ্য হয় তা আমি একশো কোটি বছরেও সেসব পুণ্যকথা বলে শেষ করতে পারব না।’

গয়াক্ষেত্রে দীর্ঘ এক ক্রোশ ব্যাপী গয়াশিরে পিণ্ড দিলে পিতৃলোকের চিরগতি লাভ হয়। ফল্গুতীর্থে পিতৃলোকের পিণ্ডদান করলে পরমগতি লাভ হয়। যে গয়াতীর্থে যায়, সে তৎক্ষণাৎ মুক্ত হয় পিতৃঋণ থেকে। ভগবান শ্রীবিষ্ণু তথা জনার্দন পিতারূপে বিরাজ করেন এখানে।

ফল্গুতীর্থে স্নান করে গদাধর (বিষ্ণুর পাদপদ্ম) দর্শন করলে মানুষ পূর্বের দশ পুরুষ ও পরের দশপুরুষ এবং স্বয়ং এই একুশ পুরুষকে ত্রাণ করতে পারে।

ফল্গুতীর্থই পিতৃপুরুষদের আত্মার মুক্তির মুখ্যতীর্থ। প্রথমে ফল্গুনদীতে নারায়ণ ও দেবতাদের উদ্দেশ্যে জলদানের (তর্পণ) পর পরলোকগত পিতৃপুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে তর্পণ করা হয়।

শ্রীবিষ্ণু পাদপদ্ম মন্দিরের ঠিক সামনে ফল্গুনদীর অপর পারে একটি মন্দিরের ভিতরে আছে একটি কালো পাথরের হাত। পরম্পরাগত কথা, এই হাতটি অযোধ্যার রাজা দশরথের। শ্রীরাম, লক্ষ্মণ ও জানকী বন গমনের পর রাজা দশরথের মৃত্যু হয়। এক সময় গয়াধামে এসে সীতা কুণ্ড নামক এই স্থানটিতে পিণ্ডদান করেছিলেন মা জানকী। হাত বাড়িয়ে সেই পিণ্ড গ্রহণ করেছিলেন রাজা দশরথ। সাক্ষী ছিল অক্ষয়বট, বহমান ফল্গুনদী, গোমাতা, পুরোহিত তথা ব্রাহ্মণ এবং তুলসী। পিণ্ডদান কার্যটি ঘটেছিল রামচন্দ্র ও লক্ষ্মণের অসাক্ষাতে। পরে একমাত্র অক্ষয়বট ছাড়া সকলেই মিথ্যা সাক্ষী দিয়েছিল। এজন্য স্বয়ং নারায়ায়ণের ডানপায়ের আঙুল থেকে উৎপত্তি পবিত্র নদী ফল্গুকে জানকী শাপ দিয়েছিলেন ‘অন্তঃসলিলা হও’ বলে। অক্ষয় হবার বর দিয়েছিলেন অক্ষয়বটকে তার সত্যবাদিতার জন্য।

গয়ায় প্রেতশিলা নামে যে তিনলোকে বিখ্যাত তীর্থ তা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে তিন জায়গায় বিরাজমান। প্রভাস, প্রেতকুণ্ড ও গয়াসুরের মাথা- এই তিনটি স্থানেই মহাতীর্থ প্রেতশিলা আছে। ধর্ম স্বয়ং নিজের মাহাত্ম্য প্রকাশের জন্য এইসব দেবময় শিলা ধারণ করে রয়েছেন। মানুষের মধ্যে যারা মৃত্যুর পর প্রেত হয়ে আছেন, তাদের উদ্ধারের জন্য পিণ্ড দিতে হয় প্রেতশিলায়।

প্রেতশিলায় পৌরাণিক বা প্রাচীন নাম প্রেতপর্বত। গয়া থেকে এর দূরত্ব ৭ কিমি। ব্রহ্মকুণ্ড থেকে প্রেতশিলায় পৌঁছতে হয় ৭০০ সিঁড়ি ভেঙ্গে। এখানে একটি ছোট্ট কালীমন্দির ও ব্রহ্মার চরণ আছে। এখানে পিণ্ডদান করা হয় পরলোকগত আত্মাকে ব্রহ্মলোকে পাঠানোর উদ্দেশে। এই প্রসঙ্গে বলি, ‘প্রেতশিলা’ শব্দটা মানুষের কাছে আতঙ্ক ও ভীতিসূচক। এটি ক্ষেত্রের নাম। কোনও ভয়ভীতির প্রশ্নই নেই। শতশত মেয়েরা নির্ভয়ে গিয়ে থাকে প্রেতশিলায়।

আরও একটি বিষয়, অনেক ক্ষেত্রে পরলোকগত অতৃপ্ত আত্মা নানা ভাবে মানুষের জীবনে অত্যাচার করে জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে। প্রেতশিলায় স্থাপিত কালী মন্দিরে সেই মৃতব্যক্তির ফটো রেখে আসলে নিমেষে বন্ধ হয়ে যায় তার অত্যাচার। এ ঘটনা একেবারে পরীক্ষিত সত্য।

এখানে একটা জরুরী কথা বলি, বদরী নারায়ণে নারদশিলা, পুরীতে জগন্নাথ মন্দিরের সিঁড়িতে, এমন ভারতের বহু জায়গায় বলা হয় যেখানে আত্মার উদ্দেশ্যে পিণ্ড দিলে আত্মা মুক্তিলাভ করে। অন্য কোথাও পিণ্ড না দিলেও চলে। আমার অসংখ্য দেখার অভিজ্ঞতায় বলি, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যে কোনও তীর্থে রাম শ্যাম যদু মধু শিলায় পিণ্ড দিলে কিছু হবে না। গয়াতে পিণ্ডদানে আত্মার মুক্তিলাভ নিশ্চিত শুধু নয়, অনন্ত সুনিশ্চিত।

এই কাজে সহায়তাকারী এখানকার পাণ্ডাদের ধার্মী অর্থাৎ প্রোতর বলে। মৃত আত্মার উদ্দেশ্যে প্রথম পিণ্ড দিতে হয় প্রেতশিলায়। তারপর রামশিলায়। প্রেতশিলা থেকে রামশিলা ৭ কিমি তবে প্রেতশিলায় পিণ্ড না দিলে আত্মার কিছুতেই মুক্তি হবে না।

প্রেতশিলা- প্রেতশিলা পাহাড়ে আসতে হয় ফল্গুতীর্থে তর্পণের পর। এখানে পাহাড়ের নীচে ব্রহ্মকুণ্ডনামে একটি পুষ্করিণী আছে। এর চার পাশের ঘাট বাঁধান। এখানে প্রথমে স্নান ও তর্পণ করে তৃপ্ত ও অতৃপ্ত পরলোকগত আত্মাদের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করা হয়। এখানে পিণ্ডদান করলে মৃত আত্মা প্রেতযোনি থেকে উদ্ধার হয় অর্থাৎ স্বর্গের পথে এক ধাপ এগোয়।

অক্ষয়বট-প্রথমে ফল্গুতীর্থ ও পরে প্রেতশিলায় পিণ্ডদান কার্যের পর উক্ত দুটি জায়গায় যে কাজ করা হয় তার সাক্ষী রাখার জন্য আসতে হয় অক্ষয়বটে। শ্রীবিষ্ণু এবং ব্রহ্মযোনির মাঝামাঝি জায়গায় অক্ষয়বটের অবস্থান। এখানে শেষ পিণ্ডদান করতে হয় রুক্মিণী কুণ্ডে। পরে অক্ষয়বটবৃক্ষের তলায় যারা পিণ্ডদান ও গয়ান্দ্রাদধ করতে এসেছে তাদের পাণ্ডারা সফল দেয় অর্থাৎ ‘তোমার গয়াযাত্রা সফল হোক’ এই বলে। প্রবাদ আছে, এই অক্ষয়বটবৃক্ষ এখানেই অবস্থান করছে ত্রেতাযুগ থেকে।

গয়াতীর্থের মাহাত্ম্য কথায় মহাভারতে পুলস্ত্য বলেছেন, ‘সেখানে ‘অক্ষয়বট’ নামে ত্রিভুবনবিখ্যাত একটি বটবৃক্ষ আছে, মুনিরা বলেন, তাহার তলে পিতৃলোক উদ্দেশ্যে দান করিলে তাহার ফল অক্ষয় হয়। তত্রত্য মহানদীতে (মহাভারতীয় যুগের মহানদীই আজকের ফল্গু) স্নান করিয়া পিতৃগণ ও দেবগণের তর্পণ করিবে, তাহাতে অক্ষয় স্বর্গলাভ করিবে এবং কুল উদ্ধার করিতে পারিবে।’

আনুমানিক ৪৪৫০ বছর আগের কথা। মহাভারতীয় যুগ। স্বয়ং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বাস করেছিলেন গয়াতীর্থে। তাঁর কাছে গিয়েছিলেন অগস্ত্যমুনি। গয়াতে অক্ষয়বটে পাণ্ডবেরা চতুর্মাস্যব্রত ও ঋষিযজ্ঞ করে তৃপ্তি সাধন করেছিলেন দেবতাদের। দেবতাদেরই যজ্ঞস্থান যে অক্ষয়বটের কাছে কর্মমাত্রেই অক্ষয় হয়, সেখানে স্থিরচিত্তে উপবাস করেছিলেন রাজা যুধিষ্ঠিরসহ ভ্রাতারা।

অক্ষয়বটে শেষ পিণ্ডদানের পর আত্মার মুক্তির উদ্দেশ্যে আসতে হয় ভগবান শ্রী বিষ্ণু পাদপদ্ম মন্দিরে। এখানে নারায়ণের পাদপদ্মে পিণ্ডদান করা হয় আত্মার বৈকুণ্ঠলাভের উদ্দেশ্যে অর্থাৎ মুক্তিলাভের জন্য।

শ্রীবিষ্ণুর মন্দিরটি ১৭৬৬ সালে নির্মাণ করেন ইন্দোরের মহারাণি অহল্যাবাঈ। গয়াসুরের শিলায়িত বুকের উপরে বিষ্ণুর চরণচিহ্নটি দৈর্ঘ্যে ১৩ ইঞ্চি। আঙুলগুলি উত্তরমুখী। এই চিহ্নের চার পাশে এক ফুট উঁচু পাথরের আলসে দেয়া মন্দিরটি অবস্থিত ফল্গু ও মধুশ্রবা নদীর ধারে।

পিণ্ডদানের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ কাজটি চলতে থাকে পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে। ফলে এতটুকুও মাথাব্যথা করতে হয় না পিণ্ডদানকারী গয়াযাত্রীর।

রামায়নী যুগ থেকে সুপ্রাচীন গয়াতীর্থ আজও বিরাজমান আপন মহিমায় নিজেকে মহিমান্বিত করে। সেই জন্যেই তো অগ্নিপুরাণ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গয়াধামে গিয়ে হব্য, ধন ও শ্রাদ্ধ দ্বারা পুজোপাঠ করে তার শতকূল নরক হতে স্বর্গে এবং স্বর্গ থেকে প্রতিষ্ঠিত হয় পরমপদে।’

কূর্মপুরাণে বলা হয়েছে, ‘গয়াতীর্থে যাওয়ায় সুযোগ পেয়েও যে বা যারা সেখানে যায় না, সেই ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে দুঃখ করতে থাকে পিতৃলোক।’

এছাড়াও গয়াতীর্থের মাহাত্ম্য কীর্তন করা হয়েছে স্কন্দপুরাণের আবন্ত্যখণ্ডে- ‘সনৎকুমার বলিলেন, হে ব্যাসদেব। … আদিগয়া, বুদ্ধগয়া, বিষ্ণু পদী, গয়াকোষ্ঠ, গদাধরপদ, ষোড়শী বেদিকা, অক্ষয়বট, প্রেতমুক্তিরী শিলা, অচ্ছোদা নদী, পিতৃগণের উত্তর আশ্রম এবং দেব, দানব, যক্ষ, কিন্নর, রাক্ষস ও পন্নগগনের উত্তম আশ্রম, এই সকল স্থান স্নান দানাদিক্রিয়া ও বিধিবৎ দেয় শ্রাদ্ধ তত্তৎ তীর্থের উপযুক্ত ফল প্রদান করিয়া থাকে। গয়ায় পিতৃরূপে স্বয়ং জনার্দন অবস্থিত।’…

যেসব পরিবারে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় যেমন অশরীরী ও অলৌকিক এবং নানান ধরণের ভৌতিককাণ্ডে আতঙ্কিত, তারা গয়াক্ষেত্রে ফল্গুতটে, প্রেতশিলায়, অক্ষয়বট ও শ্রী বিষ্ণু পাদপদ্মে পিণ্ডদান করতে পারেন।

ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচিত অনেকেই যারা অত্যন্ত উপকৃত হয়েছেন যাঁর কাছে গিয়ে তাঁর ঠিকানা – শ্রী গোবিন্দদাস ভট্টাচার্য (বাচ্চু বাবু) পিতা স্বর্গীয় গুরুদাস ভট্টাচার্য (সন্তুবাবু), বামনিঘাট, গয়াধাম, বিহার, পিনকোড ৮২৩০০১ ঠিকানায় অথবা তাঁর ফোন (০৬৩১) ২২২১৯২৭ (বাড়ি) অথবা ০৯৪৩০৬০৮৪২৭ (মোবাইল) এ আগে থেকে যোগাযোগ করে গয়া যেতে পারেন। নির্লোভ সৎ ও সাত্ত্বিক এই ব্রাহ্মণ থাকা খাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করে থাকেন।

ভারত সেবাশ্রম সংঘে থেকেও পিণ্ডদান করতে পারেন। ভারত সেবাশ্রম সংঘ, স্বরাজ্যপুরী রোড, গয়াধাম, বিহার, পিনকোড-৮২৩০০০১ এই ঠিকানায় যোগাযোগ করতে পারেন। ফোন (০৬৩১) ২২২০৫৭৯ / ২২২৬০২১ নম্বরে ফোন করতে পারেন গয়ায়। এই সঙ্ঘের কার্যালয় আছে গয়া স্টেশনে। সেখানে কথা বলতে পারেন এই নম্বরে- (০৬৩১) ২২২০৯২৯। কলকাতায় সঙ্ঘের ঠিকানা-২১১, রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, কলকাতা- ৭০০০১৯। ফোন- (০৩৩) ২৪৪০৫১৭৮।

(‘কৃতজ্ঞতায় আমি যেন কারও কাছে ঋণী না থাকি’- আব্রাহাম লিঙ্কনের এই স্মরণীয় উক্তি স্মরণ করে যাদের কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম- শ্রী গোবিন্দদাস ভট্টাচার্য (গয়ার পুরোহিত), সরমাভারতী, গ্রন্থঋণ- শ্রী শ্রী সদগুরুসঙ্গ শ্রী মৎ কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী, গরুড়পুরাণ, সচিত্র শ্রীগয়া মাহাত্ম্য, মহাভারতম্- হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনূদিত।)

Show Full Article

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button