কেউ রথ টানলেন না রথযাত্রায়, একাকী ভগবান পড়ে রইলেন রথে
রথযাত্রার ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরলই বটে। ক্ষোভে হোক বা দুঃখ অভিমানেই হোক, কেউই সে বার রথ টানলেন না রথযাত্রায়।
সেকালেরই কথা। এলিজা ফে ইংল্যান্ড থেকে নৌকায় এলেন কলকাতায়। সময় লাগল বারো মাস আঠারো দিন। বন্ধুকে প্রথম চিঠি লিখলেন ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের ২২ মে। সমুদ্র পথে আসার সময় দূর থেকে দেখা এমনই পুরুষোত্তমক্ষেত্র আর পুরুষোত্তম প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন,
“…..নৌকাও বেশ বেগে চলতে থাকল ঢেউয়ের মাথার উপর দিয়ে এবং দূর থেকে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল পুরীর জগন্নাথের মন্দির। তিনটি বড় বড় পিরামিডের মতন অট্টালিকা ও হিন্দুদের বিখ্যাত দেবালয়।
মন্দিরের ভিতরে জগন্নাথের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত, এবং তাঁর পূজার্চনার জন্য বিরাট পুরোহিতবাহিনী নিযুক্ত। শুনেছি, বছরের কোনো নির্দিষ্ট দিনে মূর্তিগুলিকে মন্দিরের বাইরে আনা হয় এবং বিশাল রথের উপর বসিয়ে হাজার লোক তার দড়ি ধরে টানতে থাকে। ভক্তবৃন্দ ঈশ্বরপ্রেমে উদভ্রান্ত হয়ে জগন্নাথের রথের চাকার তলায় প্রণিপাত হয়ে আত্মোৎসর্গ করে। তাদের বিশ্বাস দেবতার উদ্দেশ্যে এইভাবে জীবন দান করলে সশরীরে স্বর্গবাসের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়ে যায়।”
বিখ্যাত পর্যটক তাভেরনিয়ে তাঁর পর্যটন জীবনে ১৬৪০ সালে ঢাকা হয়ে একসময় এলেন নীলাচলে। করুণাঘন আনন্দময় শ্রীজগন্নাথবিগ্রহ দর্শন করলেন মন্দিরে। দেবতার রূপ বর্ণনায় জানালেন –
“মূল মণ্ডপের বেদীর ওপর থাকা প্রধান বিগ্রহটির দু চোখ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দু খণ্ড হীরে বসিয়ে। কোমরের কাছটিতে শোভা পাচ্ছে গলা থেকে ঝোলানো একটি পেনডেনট বা পদক। সেটিতে খোচিত থাকা হীরেগুলির মধ্যে যেটি সবার চেয়ে ছোট সেটিও প্রায় ৪০ ক্যারাট ওজনের। বাহুতে তার বাহুবন্ধ। কতক মুক্তোর, কতক চুনির।
বিগ্রহটি ঘাড় থেকে নিচু পর্যন্ত ঢাকা থাকে বেদীর ওপর থেকে ঝোলানো একটি মনোহর দর্শন আবরণী দিয়ে। উৎসবাদির রকমফের অনুযায়ী কখনো এটি সোনার কখনো বা রূপার কিংখাব দিয়ে তৈরি।…..
মূর্তিটি যেহেতু পূর্ণাঙ্গ নয় তাই তার হাত দুটি বানিয়ে নিয়েছে তারা যাকে আমরা বলি সেই ‘Pearl by the ounce’ বা ‘Seed Pearl’ ক্ষুদে ক্ষুদে মুক্তা দিয়ে। পা দুটির বেলা তা আবরণীতে ঢাকা থাকে বলে কারো চোখে পড়ে না। আসলে, দু হাত ও মুখটি ছাড়া দেহের কোন অংশই অনাবৃত নয় তার। তয়ের করা হয়েছে সেটিকে চন্দন কাঠ দিয়ে।
….(কেশব রাঈ–এ) মূর্তিটিকে প্রতিদিন মাখানো হয় সুগন্ধি তেল। ফলে বনে গেছে তার রঙ কুঁচকুঁচে কালো। তার ডানদিকটিতে রয়েছে বোন সোতোরা (সুভাদ্রা)–র মূর্তি। বাঁয়ে ভাই বলবদেব (বলভদ্র)–এর মূর্তি। দুটিই দাঁড়ানো ভঙ্গিমার এবং বেশভূষায় সাজানো। আর, প্রসিদ্ধ এই বিগ্রহটির সমুখ ভাগে, কিছুটা বাঁদিকে ঘেঁষে দেখা যাবে তার পত্নীর মূর্তিটিকে। নাম তার কেমুই (সম্ভবতঃ কামিনী বা রুক্মিণী)। নিরেট সোনার তৈরী এ মূর্তিটিও দাঁড়ানো ভঙ্গিমা। অন্য তিনটি মূর্তিই চন্দন কাঠের।”
জগন্নাথ দেবকে পর্যটক তাভেরনিয়ে যখন দেখেছিলেন তার অনেক আগের কথা। রাজা কপিলেশ্বরদেব তার রাজত্বকালে পঞ্চমবর্ষের ১৪ ডিসেম্বর ১৪৬৬ সালে জগন্নাথদেবের পাদপদ্মে দান করেছিলেন হীরা মকরত মুক্তাদি খচিত নানান রত্নালঙ্কার। সম্ভবত রাজার দেওয়া অলঙ্কারগুলিই পরবর্তীকালে তাভেরনিয়ে দেখেছিলেন শ্রীজগন্নাথ–অঙ্গে।
সেকালে, যখন রেলপথ ছিল না তখন পুরীতে জগন্নাথদর্শন ও রথযাত্রা দেখতে আসা ভারতের বিভিন্ন দেশীয় স্ত্রী ও পুরুষযাত্রীদের বিচিত্র বেশভূষা ও যানবাহনের ভারী সুন্দর একটি চিত্র হান্টার সাহেব তুলে ধরেছেন (Hunter’s Orrissa Vol.I.P.156) এইভাবে –
“পশ্চিমাঞ্চলের ‘জনানা’বাহী গরুর গাড়িগুলি ছিল একেবারে ঘেরা টোপে ঢাকা–যানবাহন সংলগ্ন বলীবর্দ্দগুলি তেজস্বী ও বৃহদাকারের, বাঙ্গালা দেশের ‘বলদ’গুলি অপেক্ষা ক্ষুদ্র, গাড়ির ‘ছই’য়ে অনেকগুলি ছিদ্র – থার ফাঁক দিয়া কুতূহলী রমনীদিগের কৃষ্ণতার চক্ষু প্রায়ই দৃষ্টি পথে পতিত হয়। কোথাও কলিকাতার অর্থশালী শ্রেষ্ঠী চলিয়াছেন সপরিবারে পাল্কী হাঁকাইয়া, আর কোথাও দিল্লী অঞ্চলের পাজামা-পরা কুলনারী টাটুর উপর চড়িয়া চলিয়াছেন আর স্বামী বেচারী নিরীহ ভদ্রলোকটির মত লাঠিহাতে পাশে পাশে হাঁটিয়া চলিয়াছে, রাজরাজাড়া তীর্থযাত্রী হইলে হস্তী উষ্ট্র অশ্ব লোক লস্করের অন্ত থাকিত না। দিনের বেলা দলবদ্ধ হইয়া পথ অতিক্রম করিয়া রাত্রিতে সকলেই ‘চটী’তে বিশ্রামলাভের চেষ্টা করিত।”
তবে রথ যাত্রার সময়, রথ উৎসবের আগে এবং পরে মর্তবৈকুণ্ঠে পৌঁছানো ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না। অমানুষিক পথক্লেশ সহ্য করে পুরুষোত্তমে আসতেন অসংখ্য ভক্তপ্রাণ তীর্থযাত্রী। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে ময়মনসিংহের জমিদার পুত্র ভ্রমণপিয়াসী লেখক ধরণীকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী তার ‘ভারত ভ্রমণ’ গ্রন্থে লিখেছেন –
“পূর্বে স্থলপথে পুরী যাইবার যে কত ছিল তাহা এখন বৃদ্ধ নর- নারীগণ নিজ নিজ অভিজ্ঞতা দ্বারা ব্যক্ত করিয়া থাকেন। তখন একদিকে উপযুক্ত পরিমাণ খাদ্যদ্রব্যাদির অভাবে ও বিশ্রামের স্থানাভাবে অনেকেই অনেক সময়ই উন্মুক্ত গগন-ছায় বিটপ তলে আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইত।…সে সময় নির্ম্মল পানীয় জলের অভাবে প্রায়ই বহুযাত্রী ওলাউঠা প্রভৃতি দুশ্চিকিৎস্য রোগে প্রাণ হারাইত। কেহ রোগাক্রান্ত হইলেই তাহার সহযাত্রীগণ কর্ত্তৃক জীবিতাবস্থায়ই পরিত্যক্ত হইয়া মাংস–লোলুপ হিংস্র শৃগাল কুক্কুর প্রভৃতির দ্বারা ভক্ষিত হইয়া দারুণ নির্য্যাতনের মধ্যে ভীষণ শোচনীয় অবস্থায় প্রাণ – পরিত্যাগ করিত। সে সমুদয় শোচনীয় কাহিনী বর্ত্তমান সময়ে কল্পনা করিতেও শরীর শিহরিয়া ওঠে।”
সেকালের শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথ দর্শনে গেলে কর দিতে হত যাত্রীদের। ১৮০৫ সালে সেই কর তুলে দেওয়া হল। চার্লস বলার পুরীতে এলেন ১৮০৯ সালে। তিনি জানিয়েছেন তীর্থকর তুলে দেওয়ার পর নিতান্ত দরিদ্র ব্যক্তিও আসতেন জগন্নাথ দর্শনে। তখন অসংখ্য মানুষই প্রাণ ত্যাগ করতেন অন্নের অভাবে। নিঃস্ব যাত্রীদের দুরাবস্থের জন্য পথের দৃশ্য বড়ই ভীষণ হয়ে উঠত। রাজপথের কিছু কিছু জায়গা পূর্ণ হয়ে উঠত বিক্ষিপ্ত নরকঙ্কালে।
আবার নীলাচলে পৌঁছেও অনেকের কষ্টের অবধি থাকত না। স্থানাভাবে অনেকেই আশ্রয় নিত পথের ধারে, সমুদ্রসৈকতে। রথের মরশুমে বর্ষায় কাদার মধ্যে পড়ে থাকত অসংখ্য তীর্থযাত্রী। ১৮৩৮ সালে জগন্নাথক্ষেত্রে এসেছিলেন কলকাতার লর্ড বিশপ। যাত্রীদের এমন দুর্গতি দেখে তিনি লিখছেন, “আমি ‘মৃত্যুর উপত্যকা’ ( valley of death ) দর্শন করিয়াছি, এই বিভীষিকার বর্ণনা করা যায় না।”
প্রতি বছর, বছরের পর বছর, শত শত বছর ধরে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় আষাঢ়মাসে পূষ্যানক্ষত্রযুক্ত শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে। চলে দ্বিতীয়া থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত। ভারতের নানা প্রান্ত থেকে জাতিধর্মনির্বিশেষে সমাগম হয় নানাবর্ণের মানুষের। সাম্যের এক অপূর্ব মহামিলনে সব একাকার হয়ে যায় প্রাদেশিকতার গণ্ডি ভেঙ্গে। আজ থেকে দুশো বছর আগে প্রায় প্রতি বছর কমপক্ষে বারো লক্ষ লোকের সমাগমের কথা জানিয়েছেন শ্রীরামপুরের বিখ্যাত পাদরি ডাক্তার কেরী সাহেব।
তখন লর্ড কর্নওয়ালিস ও স্যর শোরের (১৭৮৯ – ৯৮) আমলে। পাহারার ব্যবস্থা থাকত রথযাত্রায়। এই প্রসঙ্গে একটা ছোট্ট সংবাদ ছিল এইরকম –
“জগন্নাথের রথে সিপাহীর বন্দোবস্ত”
প্রত্যেক সেনাদল হইতে একজন জমাদার ও ২০ জন করিয়া সিপাহী লইয়া একটি দল সংগঠিত হইবে। এই জমাদার ও সিপাহি হিন্দু ব্রাহ্মণ হওয়া চাই কারণ তাহাদিগকে পুরীধামে জগন্নাথ রথ – যাত্রার সময় পাহারা দিতে হইবে। তাহারা দুই তিনদিনের জগন্নাথক্ষেত্রে থাকিয়া যাত্রীদের সম্বন্ধে সুব্যবস্থা করিবে।” (Extract from D.O daed 26/12/1792)
আনুমানিক ১৫১০ সালে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব নিদারুণ পথকষ্ট সহ্য করে এলেন নীলাচলে। তিনি যতদিন ছিলেন শ্রীক্ষেত্রে ততদিনই –
“মহাপ্রভু কহে, – শুন সর্ব্ব বৈষ্ণব গণ।
সমুদ্র স্নান করি’ চূড়া দর্শন।।”
প্রতিদিন মহাপ্রভু সমুদ্রে স্নান করতেন রূপ, সনাতন হরিদাস, স্বরূপ প্রমুখ পার্ষদদের সঙ্গে, তার পরেই দর্শন করতেন শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের চূড়া, চক্র। নিত্য এই কর্মের মতোই তিনি তাঁর ভক্ত শিষ্যদের প্রায় সকলকেই বলতেন রথযাত্রা মহোৎসব দর্শন করতে। নিজেও রথযাত্রায় উদ্দণ্ড নৃত্যকীর্তন করতেন সাতটি সংকীর্তন সম্প্রদায় রচনা করে। ভক্তগণের সঙ্গে নাচতে নাচতে চলতেন রথের আগে আগে, আর স্বয়ং মহারাজ প্রতাপরুদ্র রথের পথ পরিস্কার করতেন সোনার ঝাঁটা দিয়ে। কথিত আছে, রথযাত্রা কালে মহাপ্রভু কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর হয়ে এই শ্লোকটি আবৃত্তি করতে করতে চলতেন রথের আগে আগে –
“ যঃ কৌমারহরঃ স এব হি বরস্তা এব চৈত্রক্ষপাস্তে
চোন্মীলিতমালতিসুরভয়ঃ প্রৌঢ়াঃ কদম্বানিলাঃ।
সা চৈবাসি, তথাপি তত্র সুরত – ব্যাপারলীলাবিধৌ
রেবারোধসি বেতসীতরুতলে চেতঃ সমুৎকণ্ঠতে।।”
(যিনি কৌমারে আমার মনোহরণ করেছিলেন, তিনি এখন আমার প্রণয়ী, আজি সেই চৈত্ররাত্রি, বায়ু, মালতী ও কদম্ব সৌরভে পূর্ব্বের ন্যায় আকুল, আমিও পূর্ব্বেরই ন্যায় রহিয়াছি, তথাপি নর্ম্মদা (রেবা) তটে বেতসীতরুতলে যৌবনের সেই সুখপ্রসঙ্গের জন্য মন উৎকণ্ঠীত হইয়া ওঠে।) শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, পৃষ্ঠা ১৭০ ‘বসুমতী সংস্করণ।
একবার রথযাত্রায় ‘কৃষ্ণসেবা লাভ হইল না’ সুতরাং ‘এই প্রাণপতঙ্গ ধারণ করা বৃথা’ – এই আর্তি ও দৈন্যে বিভাবিত হয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যের অন্তরঙ্গ পার্ষদ সনাতন গোস্বামী। কৃষ্ণবিরহে রথের চাকায় প্রাণ বিসর্জন দিতে চেয়েছিলেন তিনি।
সেকালে রথের চাকার নীচে পড়ে প্রাণ দেওয়ার ব্যাপারটা দেখা যেত একশ্রেণির ধর্ম্মোন্মত্ত নরনারীদের মধ্যে। ১৮০৯ সালে চার্লস বুলার পুরীতে দেখেছেন একজনকে স্বেচ্ছায় রথের চাকায় পেষিত হয়ে আত্মবিসর্জন দিতে।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সহকারী পরিদর্শক ছিলেন ডাঃ ক্লডিয়স বুকানন। তিনিও এসেছিলেন পুরীতে। দেখেছিলেন রথযাত্রাকালে দুজনকে চাকার নীচে পড়ে প্রাণত্যাগ করতে।
ডাঃ বুকানন ১৮১৩ সালের মে ও জুন মাসে দুটি চিঠি লেখেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকবর্গের কাছে। তাতে জগন্নাথ – প্রসঙ্গ ছাড়াও রথযাত্রায় অশ্লীলতার কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। একজন পুরোহিত ও একজন বালককে রথযাত্রাকালে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গী, হাতে ধরা দণ্ডের সাহায্য নানা জুগুপ্সিত ভঙ্গী এবং রথের উপরে দাঁড়িয়ে জনৈক পুরোহিতকে অশ্লীল গান করতে দেখেছিলেন ডাঃ বুকানন।
এবার ধরণীকান্ত লাহিড়ী চৌধুরীর কথায়। “রথের সময় দৈনিক সহস্র সহস্র যাত্রী এখানে আসিয়া থাকে, প্রতি বছর যে কত লোক অকালে নানাবিধ ব্যাধিতে মৃত্যু মুখে পতিত হয় তাহার সংখ্যা নাই।, অনেক দুর্ব্বল ব্যক্তি রথের তলে পড়িয়া বা লোকের ভিড়ে পদদলিত হইয়া কালকবলে নিপতিত হইয়া থাকে, গভর্মেন্টের চেষ্টায় ও শাসনগুণে ইহা বহু পরিমাণে দূর হইলেও সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয় নাই।”
একশো বছর আগে জগন্নাথদেবকে কিভাবে রথ তোলা হত সেই প্রসঙ্গে লাহিড়ী চৌধুরী তার গ্রন্থে জানিয়েছেন,
“রথযাত্রার সময়ে দৈতাপতিগণ শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের মূর্ত্তি বহন করিয়া রথে আনিয়া স্থাপন করে। জগন্নাথ ও বলরামের কোমরে রেশমের দড়িই বাধিয়া ঝুলাইয়া লইয়া যাওয়া হয় এবং সুভদ্রা ও সুদর্শনকে মাথায় তুলিয়া আনিয়া থাকে, সুদর্শন জগন্নাথদেবের রথেই রক্ষিত হয়, এ সময়ে মহাপ্রভুকে রাজশৃঙ্গার বেশ ও স্বর্ণের হস্ত পদাদিদ্বারা সুশোভিত করা হয়। চিরপ্রচলিত প্রথানুযায়ী এসময়ে পুরীর রাজা রাজবেশে সুসজ্জিত হইয়া রথের সম্মুখে আগমন করেন এবং মুক্তাখচিত সম্নার্জ্জনী দ্বারা পথ পরিস্কার করিয়া দেন ও শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের পূজা করিয়া সর্ব্বাগ্রে রথের দড়ি ধরিয়া টানেন, এসময়ে ৪২০০ শত কুলিতে রাজার সহিত রথে দড়ি ধরিয়া টানে এবং যাত্রীগণ ও পাণ্ডাগণ সহায়তা করে, পূর্ব্বে হাতিতে টানিত। এসময়ে অগণিত মনুষ্যমুণ্ড ও যাত্রীগণের কল-কোলাহলে শ্রবণ বধির হইয়া যায়, কারণ রথেতে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবকে দর্শন করতে পারিলে আর তাহার পুনর্জ্জন্ম হয় না। সেই দিবসই গুণ্ডিচার বাড়িতে রথ যাইবার কথা, কিন্তু তাহা হইতে পারে না, সেখানে যাইতে প্রায় চারি দিবস লাগে।”
ভারতের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন দুশো বছরেরও বেশি সময় ধরে কঠোর বেদান্তি শিবকল্প মহাপুরুষ নাঙ্গাবাবা ওরফে তোতাপুরীজি। শ্রীক্ষেত্রেও কাটিয়েছেন বহু বছর। তিনিও একবার রথ উৎসব দেখেছিলেন এমার মাঠে বসে। তাঁর চোখে রথযাত্রার চিত্রটি ছিল এইরকম –
“কেমন রথযাত্রা দর্শন করলেন?” জনৈক ভক্তের জিজ্ঞাসার উত্তরে তার ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন এমনটা,
“মস্ত তামাসা দেখলাম। কি পাণ্ডা, কি সেবকরা, কি পুলিশ দোকানদারেরা খালি যাত্রীদের কাছে ফাঁকি দিয়ে পয়সা কড়ি নিচ্ছে, কোথাও কোথাও জুলুমও করছে। আর সব কীর্তনের দল সম্প্রদায়গত ঈর্ষা বিদ্বেষ দেখাছে। কে কত লাফাতে পারে, নাচতে পারে, তাই দিয়ে লোকের ভক্তি আকর্ষণ করছে। জুতো পায়ে দিয়ে অনেকে রথ টানছে, পুলিশ কনস্টেবলেরা তো বটেই। তুমি কি রোজ মন্দিরে যাও।”
একবার নীলাচলে ঘটল এক অভাবনীয় কাণ্ড। রথযাত্রার ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরলই বটে। ক্ষোভে হোক বা দুঃখ অভিমানেই হোক, কেউই সে বার রথ টানলেন না রথযাত্রায়। নিঃসঙ্গ একাকী ভগবান পড়ে রইলেন রথে, ভক্ত নেই। এমন অঘটন সমাচার প্রকাশিত হয়েছিল ‘সমাচার দর্পণ’ – এ ১৮২১ সালের ২৮ জুলাই, ১৪ শ্রাবণ ১২২৮ –
“জগন্নাথক্ষেত্র।। – জগন্নাথক্ষেত্রে পূর্ব্ব বৎসর যাত্রিক লোক অতিন্যূন লোক হইয়াছিল। এবং দুর্ভিক্ষ ও ওলাওঠা রোগের দ্বারা সেখানকার লোক বিধ্বস্ত হইয়াছে এই বৎসর সেখানকার কোন লোক জগন্নাথদেবের রথ টানে নাই ও সেখানকার ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা অন্য উপায় দ্বারা রথযাত্রা সমাপ্ত করিয়াছেন।”
পরম পূজ্যপাদ আচার্য শঙ্কর, ভক্ত কবীর, শংকরদেব, মহাযোগী গম্ভীরনাথ থেকে শুরু করে শত শত বছর ধরে অগণিত উচ্চকোটি সাধক মহাপুরুষের চরণধূলিতে পূত হয়েছে পুরুষোত্তমক্ষেত্রের প্রতিটি ধূলিকণা, আকাশ বাতাস অনুরণিত হয়েছে তাদেরই কণ্ঠে প্রভু জগন্নাথের নামগানে।
কেন্দুবিল্বের জয়দেবও এসেছিলেন শ্রীক্ষেত্রে। তখন বাংলার রাজা লক্ষণ সেনের আমল। তিনি সিংহাসনে বসেন ১১১৯ খ্রিস্টাব্দে। রাজার সমসাময়িক ছিলেন জয়দেব। সেই সময় ৪৯ জন বৈরাগী প্রতিদিন কবির লেখা ‘গীত গোবিন্দ’ এর সঙ্গীতাদি করতেন জগন্নাথমন্দিরে। কথিত আছে, কবি জীবনের শেষ কয়েক বছর পুরুষোত্তমধামেই অতিবাহিত করেন জয়দেব।
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের সমকালীন মহাপুরুষ ছিলেন ধর্মগুরু নানক। ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করতে করতে একসময় তিনিও এসেছিলেন পুরীধামে। একদিন শ্রীমন্দিরে আরতির সময় ভাবাবিষ্ট শরণাগত নানককে একদল পাণ্ডা তিরস্কার করলে দেবতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভাই, আমার প্রেমময় জগন্নাথ কি শুধু এখানেই? তিনি কি শুধু দারুমূর্তিতেই বিরাজ করছেন? তিনি যে সারা বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে আপন মহিমায় রয়েছেন সদাই দীপ্যমান।”
শ্রীচৈতন্যদেব জগন্নাথদর্শন করার সময় হারিয়ে ফেলতেন বাহ্যজ্ঞান। জনৈক ভক্তের এ বিষয় উত্থাপনের উত্তরে একসময় দেব জগন্নাথ প্রসঙ্গে নাঙ্গাবাবা সহাস্যে বলেছিলেন, ‘কি বুঝেছ মহাপ্রভুকে? হাতির বাইরের দাঁত দেখে কি বুঝবে? দারু নির্মিত শ্রীবিগ্রহ দর্শন করে অন্তরে তিনি ব্রহ্মদর্শন করতেন। ব্রহ্মই সব হয়েছেন। এ সবই উঁচু কথা।”
নীলাচলে থাকাকালীন কোনও এক বিশেষ পুণ্যতিথি যোগে শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে এসেছিলেন ভারত বরেণ্য মহাপুরুষ প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। শ্রীবিগ্রহ দর্শন করা মাত্রই অলৌকিক দিব্যভাবের স্ফুরণ ঘটেছিল তাঁর অন্তরে। ভাবাবিষ্ট কৃষ্ণনামরস প্রেমিক প্রভুপাদ বলেছিলেন, “দ্যাখো, সাধারণ মানুষ এই বিগ্রহকে বলে, জগন্নাথ- বলরাম- সুভদ্রা। আসলে এঁরা দারুব্রহ্মের অখণ্ড রূপ। সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মই দারুরূপে ত্রিমূর্তিতে প্রকটীত হয়েছেন। এঁদের দেখলে ব্রহ্মদর্শন হয়।”
নানা ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে নিবেদিতপ্রাণ পুণ্যপিয়াসীদের মন-রশির টানে আনন্দময় পুরুষোত্তমের রথ শত শত বছর ধরে আজও চলেছে অবিচল অব্যাহত গতিতে, চলবে অনাগত মুক্ত ভবিষ্যতেও।