মাহেশের রথ আজও মনে করায় বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারানীর কথা
বাঙালির কাছে মাহেশ বিশেষভাবে পরিচিত দুঃখিনী রাধারানী আর তার গাঁথা বনফুলের মালায়। সজল চোখের রাধারানীর কথা আজও ভোলা যায় না মাহেশে গেলে।
‘রাধারানী নামে একটি বালিকা মাহেশে রথ দেখিতে গিয়াছিল। বালিকার বয়স একাদশ পরিপূর্ন হয় নাই। তাহাদিগের অবস্থা পূর্ব্বে ভালো ছিল-বড় মানুষের মেয়ে’।…
‘রাধারানী’ উপন্যাসে মাহেশের রথের কথা লিখেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা আর বাঙালির কাছে মাহেশ বিশেষভাবে পরিচিত হয়েছে দুঃখিনী রাধারানী আর তার গাঁথা বনফুলের মালায়। পুরীর পরেই শ্রীচৈতন্য ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পদধূলীপূত দ্বিতীয় বৃহত্তম ও প্রাচীন রথোৎসব হয় শ্রীরামপুরের এই মাহেশেই।
তবে যে রথ ও মেলা দেখার দুর্নিবার আকর্ষণে লক্ষ লক্ষ মানুষ মাহেশে ছুটে যান দূর-দূরান্ত থেকে, সেই মেলায় প্রথম রথটি কে নির্মাণ করে দিয়েছিলেন তা আজও অজ্ঞাত। রথের পরিবর্তন হয়েছে বেশ কয়েকবার। কোনও এক সময় এক ভক্তপ্রাণ মোদক থাকতেন বৈদ্যবাটিতে। তার অবদানে নির্মিত রথটি অকর্মণ্য হল এক সময়। শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম পার্ষদ কলকাতার শ্যামবাজার নিবাসী বলরাম বসু। তার পিতামহ ছিলেন কৃষ্ণরাম বসু। তিনি একটি সুদৃশ্য উচ্চ কাঠের রথ করিয়ে দেন ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে। কালের নিয়মে এটি নষ্ট হয়ে যায়। কৃষ্ণরাম বসুর পুত্র গুরুপ্রসাদ বসু। তিনি আবার রথটি নির্মান করে দিলেন ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে। এবার রথটি অগ্নিদগ্ধ হল। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় একটি নতুন রথ নির্মান করিয়ে দিলেন কালাচাঁদ বসু। এক সময় ওই রথটিতে জনৈক ব্যাক্তি মারা যান গলায় দড়ি দিয়ে। ফলে অপবিত্র জ্ঞানে পরিত্যক্ত হল সেটি। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে আবার একটি রথ তৈরি করিয়ে দিলেন বিশ্বম্ভর বসু। এমনই কপাল জগন্নাথের, সেটিও একদিন অগ্নিদাহে ভস্মীভূত হল। এরপর আর কাঠের নয়, তৈরি হল লোহার রথ। যেটি আজ টানা হয়। এটি নির্মিত হয় ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে। দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসুর অর্থে রথটি তৈরি করে দেয় মার্টিন বার্ন কোম্পানি।
আজ থেকে ২০১ বছর আগের কথা। মাহেশের রথে বিপত্তির খবর জানিয়ে ১১ জুলাই ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে (২৮শে আষাঢ় ১২২৫ বঙ্গাব্দে) ‘সমাচার দর্পন’ লিখল,
“রবিবার রথযাত্রা হইল তাহাতে মাহেশের রথ অতি বড়, এত বড় রথ এতদ্দেশে নাই লোকযাত্রাও অতি বড় হয় এই রূপ প্রতি বৎসর রথ চলিতেছে কিন্তু এ বৎসরে রথ চলন স্থানে নতূন রাস্তা হওনে অধিক মৃত্তিকা উঠিয়াছে এবং অতিশয় বৃষ্টিপ্রযুক্ত কর্দম হইয়াছে তাহাতে রথ কত দূর আসিয়া রথের চক্র কর্দম মগ্ন হইলে কোন প্রকারেও লোকেরা উঠাইতে পারিল না শেষে লোকযাত্রা ভঙ্গ হইল ইহাতে রথ চলিল না। তাহাতে লোকেরা আপন আপন বুদ্ধি মত নানা প্রকার কহিতে লাগিল কেহ কেহ অধিকারী অশুচি তাহারা স্পর্শ করিয়াছে। কেহ কেহ ঠাকুরের প্রতিবর্ষ সোনার হাত আসিত এ বৎসর রুপার হাত আসিয়াছে। আর কেহ কহিল যে উড়িষ্যাতে রথ চলে নাই অতএব এখানেও চলিল না। যে হউক রথ না চলাতে অনেকের অনেক ক্ষতি হইল যে ব্যাক্তি বাজার ইজারা করিল এবং যে ব্যাক্তি ঠাকুরের মন্দির ইজারা করিল তাহাদিগের লাভ কিছুমাত্র হইল না এবং দোকানি পসারী কলিকাতা হইতে এবং অন্য অন্য স্থান হইতে আসিয়াছে তাহাদিগেরও সামগ্রী বিক্রয় না হওয়াতে যথোচিত ক্ষতি হইল। যখন নিতান্ত রথ না চলিল তখন ২৪ আষাঢ় মঙ্গলবার বিকালে জগন্নাথ দেবকে রথ হইতে নামাইল ও রাধাবল্লব ঠাকুরের বাটী শ্রী মন্দিরে লইয়া রাখিল ও (রথ) খোলাতে লোকযাত্রার অভাব প্রযুক্ত জিনিস অতি শস্তা হইয়াছে অধিক কি লিখিব ১ পয়সাতে আনারস চারিটা পাওয়া যাইতেছে”।
পরের বছর ১৯ জুন ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দ। ৬ই আষাঢ় ১২২৬ বঙ্গাব্দ। ‘সমাচার দর্পণ’ পরিবেশন করল কিছু বিস্ময়কর সংবাদ। পাশা খেলার বাজিতে হারার জন্য দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হয়েছিল মহাভারতীয় যুগে, ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে হয়েছে জুয়া খেলায় হেরে গিয়ে বউ বিক্রি। মাহেশের রথে ঘটে যাওয়া ঘটনার সংবাদ পরিবেশিত হয়েছিল এইভাবে,
“১১ আষাঢ় ২৪ জুন বৃহস্পতিবার রথযাত্রা হইবেক। অনেক অনেক স্থানে রথযাত্রা হইয়া থাকে কিন্তু তাহার মধ্যে জগন্নাথক্ষেত্রে যেরূপ সমারোহ ও লোকযাত্রা হয় মোং মাহেশের রথযাত্রাতে তাহার বিস্তার ন্যূন নহে এখানে প্রথম দিনে এক দুই লক্ষ লোক দর্শনার্থে আইসে এবং প্রথম রথ অবধি শেষ রথ পর্যন্ত নয়দিন জগন্নাথদেব মোং বল্লভপুরে রাধাবল্লভ দেবের ঘরে থাকেন। তাহার নাম গুঞ্জাবাড়ী ঐ নয়দিন মাহেশ গ্রামাবধি রাধাবল্লভপুর পর্যন্ত নানা প্রকার দোকান পসার বসে এবং সেখানে বিস্তর বিস্তর ক্রয় বিক্রয় হয়। ইহার বিশেষ বিশেষ কত লিখা যাইবেক। এমত রথযাত্রার সমারোহ জগন্নাথক্ষেত্র ব্যতিরিক্ত অন্যত্র কুত্রাপি নাই। এবং ঐ যাত্রার সময়ে অনেক স্থান হইতে অনেক অনেক লোক আসিয়া জুয়া খেলা করে ইহাতে কাহারো কাহারো লাভ হয় ও কাহারো কাহারো সর্বনাশ হয়। এইবার স্নানযাত্রার সময়ে দুই জন জুয়া খেলাতে আপন যথাসর্বস্ব হারিয়া পরে অন্য উপায় না দেখিয়া আপন যুবতি স্ত্রী বিক্রয় করিতে উদ্যত হইল এবং তাহার মধ্যে একজন……দশ টাকাতে আপন স্ত্রী বিক্রয় করিল। অন্য ব্যক্তির স্ত্রী বিক্রীতা হইতে সম্মতা হইল না তৎপ্রযুক্ত ঐ ব্যক্তি খেলার দেনার কারণ কএদ হইল”।
৫ জুন ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে জ্যৈষ্ঠ ১২২৬ বঙ্গাব্দ। সমাচার দর্পন লিখল,
“আগামী মঙ্গলবার ৮ জুন ২৭ জ্যৈষ্ঠ মোং মাহেশে জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা হইবেক। এই যাত্রা দর্শনার্থে অনেক অনেক তামসিক লোক আবাল বৃদ্ধ বণিতা আসিবেন। ইহাতে শ্রীরামপুর ও চাতরা ও বল্লভপুর ও আকনা ও মাহেশ ও রিসড়া এই কএক গ্রাম লোকেতে পরিপূর্ণ হয় এবং পূর্বদিন রাত্রিতে কলিকাতা ও চুচুড়া ও ফরাসডাঙ্গা প্রভৃতি শহর ও তন্নিকটবর্তী গ্রাম হইতে বজরা ও পিনিস ও ভাউলে এবং আর আর নৌকাতে অনেক ধনবান লোকেরা নানাপ্রকার গান ও বাদ্য ও নাচ ও অন্য অন্য প্রকার ঐহিক সুখসাধন সামগ্রীতে বেষ্টিত হইয়া আইসেন পরদিন দুই প্রহরের মধ্যে জগন্নাথদেবের স্নান হয় সেখানে প্রায় তিন চার লক্ষ লোক একএ দাঁড়াইয়া স্নান দর্শন করে।
এরপর আর একবারের কথা। মাহেশের স্নানযাত্রা সম্পূর্ণ হয়েছিল মহা সমারোহে। ১৬ জুন ১৮২১ খ্রিস্টাব্দ, ৪ আষাঢ় ১২৩৮ বঙ্গাব্দ। ‘সমাচার দর্পণ’-এ প্রকাশিত হল,
“১৫ জুন, ৩ আষাঢ় শুক্রবার মোং মাহেশের স্নানযাত্রাতে লোক অধিক হইয়াছিল অনুমান হয় তিন লক্ষ লোকের কম নহে। এই বৎসর বৃষ্টিপ্রযুক্ত লোকেদের কোন কষ্ট হয় নাই কিন্তু স্থানে স্থানে অনাবৃষ্টিপ্রযুক্ত জলকষ্ট হইয়াছে”।
পরিশেষে বলি, বৃন্দাবনের নয়, শ্রাবণের বর্ষণ মুখরিত রাতে হাতে বনফুলের মালা ধরা সজল চোখের একাদশী রাধারানীর কথা আজও ভোলা যায় না মাহেশে গেলে।
(তথ্যসূত্রঃ শ্রী ব্রজেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সংবাদ পত্রে সেকালের কথা’, অশোক মিত্র সম্পাদিত ‘পশ্চিমবঙ্গের পূজাপার্বণ ও মেলা’।