সরস্বতী শুধুই কি বিদ্যার দেবী, কীভাবে জন্ম হল তাঁর
সরস্বতীর জন্মবৃত্তান্তের মতই বিতর্কিত তাঁর স্ব-পরিচয়ও। আসলে নানা সময়ে সরস্বতী স্বর্গে পেয়েছেন নানা পরিচয়।
লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে। আর গাড়ি ঘোড়ায় চড়তে গেলে মন দিয়ে সাধনা করতে হবে কার? দেবী সরস্বতীর। কারণ, বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-কলা বিভাগের দায়িত্ব যিনি একা হাতে সামলাচ্ছেন তাঁর নাম দেবী সরস্বতী। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে মর্ত্যলোকে পূজিতা হন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার ঘরণী দেবী সরস্বতী। যিনি আবার দেবাদিদেব মহাদেব ও দেবী দুর্গার প্রিয় কন্যাও বটে। দেবী সরস্বতীর জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে যদিও নানা পুরাণের নানা মত।
কথিত আছে, প্রজাপতি ব্রহ্মা নাকি একবার গভীর ভাবনায় পড়ে যান। মর্ত্যে সব দেবতার তীর্থ আছে, ব্রহ্মা বাদে। এখন মর্ত্যের কোথায় ব্রহ্মাতীর্থ গড়ে তোলা যায়? সেই সমস্যার সমাধান করতে ব্রহ্মা ‘সর্বরত্নময়ী শিলা’ ছুঁড়ে দিলেন পৃথিবীর বুকে। সেই শিলা গিয়ে পড়ল চমৎকারপুর বলে একটি জায়গায়। সেখানেই প্রজাপতি ‘ব্রহ্মাতীর্থ’ গড়ে তুলবেন বলে মনঃস্থির করলেন। তীর্থস্থানে পবিত্র নদী থাকা আবশ্যিক। কারণ, তিনবেলা নদীর পবিত্র জল পূজার্চনার কাজে লাগবে। অতঃপর ডাক পড়ল দেবী সরস্বতীর। কেন? কারণ, গতিশীল জ্ঞানের জন্য সরস্বতী নদীরূপে কল্পিত। হিমালয়ের সিমুর পর্বতে তাঁর উৎপত্তি। সেখান থেকে হরিয়ানার আম্বালা জেলায় সমতলভূমিতে নদীরূপে অবতরণ করেন তিনি।
গঙ্গার অভিশাপে ৫ হাজার বছরের জন্য মর্ত্যে নদী হিসেবে বাস করতে বাধ্য হন সরস্বতী। যাইহোক, ব্রহ্মার আহ্বানে পাতাললোক থেকে উঠে এলেন দেবী। কিন্তু মর্ত্যে নদীরূপে তিনি বিরাজ করতে পারবেন না। লোকজনের স্পর্শে ভয় পান বলেই তো তিনি পাতালে অবস্থান করেন। সেই সমস্যারও সমাধান বার করলেন ব্রহ্মা। চমৎকারপুরে পাতাললোকের সঙ্গে যুক্ত একটি হ্রদ খনন করলেন তিনি। সেখানেই দেবী সরস্বতী বিরাজ করতে লাগলেন অন্তঃসলিলা হয়ে।
ভাগবত পুরাণে আবার পাওয়া যায় সরস্বতীর জন্মের অন্য বৃত্তান্ত। দেবী আদ্যা প্রকৃতির একটি অংশ হিসেবে জন্ম হয় দেবী সরস্বতীর। শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে ২ দৈত্য একবার মর্ত্য ও স্বর্গে ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। তাদের অত্যাচারের হাত থেকে দেবলোক ও ভূলোককে রক্ষা করতে দেবী দুর্গার শরীর থেকে জন্ম হয় আরেক দেবী প্রকৃতির। তিনি কৌষিকী। তিনিই সরস্বতী। আবার কথিত আছে, জগতের সকল জ্ঞানের আধার শ্রীকৃষ্ণের জিহ্বা থেকে নাকি জন্ম হয় দেবী সরস্বতীর। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণই মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পুণ্য পঞ্চমী তিথিতে বাগদেবীর আরাধনার প্রবর্তন করেন।
বায়ুপুরাণ আবার জানায় অন্য তথ্য। দেবাদিদেব মহাদেব একবার পাপে পরিপূর্ণ পৃথিবীকে ধ্বংস করবেন বলে স্থির করেন। তাঁর প্রবল তাণ্ডবে জগতের সৃষ্টি সম্পূর্ণভাবে বিনাশ হয়ে যায়। ধ্বংসের পরেই শুরু হয় নতুন করে সৃষ্টির বীজ বপনের প্রক্রিয়া। সেই সময় অনেক ভেবে সৃষ্টির দায়িত্ব পালনকারী প্রজাপিতা ব্রহ্মা তাঁর অন্তর থেকে জন্ম দেন এক দেবীর। নতুন জগতকে জ্ঞান, শিল্প ও সৌন্দর্যের আলো দিয়ে ভরিয়ে তোলাই ছিল সেই দেবীর কাজ। তিনি পরে জগতে বন্দিত হন দেবী সরস্বতীরূপে।
সরস্বতীর জন্মবৃত্তান্তের মতই বিতর্কিত তাঁর স্ব-পরিচয়ও। পদ্মপুরাণ মতে, সরস্বতী দক্ষরাজের কন্যা, কাশ্যপ মুনির পত্নী। আবার ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে তিনি নারায়ণের ঘরণী। যাঁর সতীন আবার গঙ্গা। গঙ্গা তো আবার মহাদেবের উপপত্নী। তাহলে বিদ্যার দেবী মহেশ্বরের কন্যা হন কি করে? সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। আসলে নানা সময়ে সরস্বতী স্বর্গে পেয়েছেন নানা পরিচয়। কখনো তিনি স্ত্রী, কখনো সেবাদাসী, কখনো বা মোহময়ী সুন্দরী। আবার কার্তিকের পত্নী হিসেবেও তো তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে। দক্ষিণ ভারতে ময়ূরবাহন সরস্বতীর যে মূর্তি পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে কার্ত্তিক পত্নী কৌমারীর আশ্চর্য মিল। তাহলে সেদিক থেকে দেবী সরস্বতী শিবের পুত্রবধূও বটে। তবে দেবী সরস্বতীর উৎপত্তি ও পরিচয় নিয়ে যাই বিতর্ক থাক, সময়ের সরণী বেয়ে তাঁর এখন একটাই পরিচয়, মা সরস্বতী বিদ্যার দেবী।