রাজহাঁস কেন মা সরস্বতীর বাহন, কী এর তাৎপর্য
প্রত্যেক দেবদেবীরই একটি করে বাহন থাকে। যার পিঠে চড়ে তাঁরা এক স্থান থেকে অন্যত্র চলাফেরা করেন। দেবী সরস্বতীর বাহনও তেমনই শ্বেতশুভ্র রাজহংস।
মকরসংক্রান্তির হাত ধরে পৌষের সমাপ্তি। মাঘের মুখে এবারে দেবী সরস্বতীকে আবাহনের পালা। শ্বেতপদ্মে আসীন দেবীর পরনে শ্বেতশুভ্র বস্ত্র। সাদা রঙের বীণা, রুদ্রাক্ষ ও পুস্তক দেবীর চার হাতে শোভা পায়। দেবীর পায়ের কাছে অনুগত বাহন রাজহংস স্বস্থানে বিরাজমান। প্রত্যেক দেবদেবীরই একটি করে বাহন থাকে। যার পিঠে চড়ে তাঁরা এক স্থান থেকে অন্যত্র চলাফেরা বা ভ্রমণ করেন। দেবী সরস্বতীর বাহনও তেমনই শ্বেতশুভ্র রাজহংস।
রাজহংসের বুদ্ধিমত্তা ও জহুরির চোখ সম্ভবত মন জয় করে নিয়েছিল দেবী সরস্বতীর। শ্বেতশুভ্র হাঁসের সামনে যদি একটি পাত্রে জলের সাথে দুধ বা ক্ষীর মিশিয়ে রাখা যায়, তাহলে সে নাকি মিশ্রণ থেকে দুধ বা ক্ষীরটুকুই শুষে পান করবে। আর পাত্রে পড়ে থাকবে শুধু জল। রাজহংসের এই স্বভাব জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
বিশ্বচরাচরে সর্বত্র আমরা যা কিছু দেখি, যা কিছু শুনি, আর যা শিখি, সবকিছু গ্রহণ করার মতো নয়। নিত্য-অনিত্য, প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয়, ভালো-মন্দ নিয়েই সংসার। বিচার বুদ্ধি দিয়ে যা কিছু দরকারি, যা কিছু মঙ্গল, সেটুকুই সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে মানব জাতিকে, বিশেষত পড়ুয়াদের। তাছাড়া, স্থল, জল ও আকাশ, সবজায়গায় বিচরণ করতে সক্ষম রাজহাঁস। ঠিক তেমন করেই জ্ঞানকে হতে হবে মুক্ত। সর্বব্যাপী হবে তার প্রকাশ।
লক্ষ্য করার মতো বিষয়, হাঁস জলে ভেসে বেড়ায়, অথচ তার পাখনা জলে ভেজে না। জল লাগলেও তা ঝেড়ে ফেলে দেয় রাজহাঁস। বিদ্যা অর্জনের পদ্ধতিও হবে অনেকটা এইরকমই। মানুষ যে জ্ঞান অর্জন করবে, তা বিদ্যার্থীকে আসক্তিমুক্ত করে গড়ে তুলবে। তাই বিশুদ্ধ জ্ঞানের বাহন হিসেবে দেবী সরস্বতীর সাথে হাঁসও পুজো পেয়ে থাকে ভক্তদের।
আবার পুরাণে সরস্বতীর সহচর হিসেবে ময়ূরের উল্লেখও পাওয়া যায়। আসলে হাঁসের মতো ময়ূরও বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ময়ূর এমন এক প্রাণি, যার মেজাজ প্রকৃতির রূপের মতই পরিবর্তনশীল। ঋতুর রংবদলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজের মেজাজ বদলায় সে। কখনো সে বর্ষা নামার আনন্দে কলাপ খুলে আত্মহারা নৃত্যে মগ্ন হয়ে ওঠে। তার সেই নিজেকে পূর্ণরূপে বিকশিত করে তোলার সঙ্গে শিল্পকলার নান্দনিক শ্রীবৃদ্ধির যোগ নিবিড়। আবার কখনো অজানা রহস্যে প্রকৃতির কোলে মনের দুঃখে কেঁদে ওঠে ময়ূর। যেন সে পরাজ্ঞানকে লাভ করতে চায়। এই জ্ঞানের স্পৃহা একজন যথার্থ জ্ঞান পিপাসুর মধ্যে বিশেষভাবে চোখে পড়ে। ময়ূর চঞ্চল। তার সেই চঞ্চলতা মানুষের মনের চিরন্তন কৌতূহলের পরিচয়বাহী।
পার্থিব জ্ঞান আহরণের মূর্ত প্রতীক ময়ূর স্বভাবে রাজহাঁসের ঠিক উল্টো। আর সেই বিপরীত গুণের যুগলবন্দি মানুষের জ্ঞানরাজ্যের নিত্য ও অনিত্যতার সূত্রকে যুগ যুগ ধরে বহন করে চলেছে। স্থিরতা ও চঞ্চলতার মেলবন্ধনেই পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হয়ে চলেছে নব নব ধারণা, আবিষ্কার, দর্শন। এই কারণেই দেবী সরস্বতীর মতই অঞ্জলির দাবিদার তাঁর দুই বাহন হাঁস ও ময়ূর।