সরস্বতী পুজোর দিনই হয় অন্য এক হাতেখড়ি, কী সেই ঘটনা
সরস্বতী পুজোর দিন কেন সিংহভাগ মেয়েরা শাড়ি পড়ে থাকে? বিশেষ করে স্কুলের ছাত্রীদের মধ্যেই কেন দেখা যায় শাড়ি পড়ার উন্মাদনা?
সকাল হতেই ঘুম থেকে তিতলিকে তাড়াতাড়ি ডেকে দিল মা। ‘কিরে ওঠ। চট করে স্নান সেরে নে। তারপরেই তো তোকে শাড়ি পরিয়ে দিতে হবে। অঞ্জলিতে বসতে হবে তো। ঠাকুরমশাই এলেন বলে’। মায়ের কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় তিতলি। আজ তো সরস্বতী পুজো। আজই তো সে প্রথম মায়ের হলুদ রঙের সুন্দর তাঁতের শাড়িটা পড়বে। উফ, কি আনন্দ। ছোট্ট থেকে তিতলির ইচ্ছা, শাড়ি পরে সরস্বতী পুজোয় বিদ্যার দেবীকে অঞ্জলি দেওয়া। তারপরে বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে দেখা করে প্রসাদ খেয়ে ঘুরতে যাবে সে। বন্ধুরাও তো সবাই এবারেই প্রথম শাড়ি পরবে।
বঙ্গকন্যা আর শাড়ির সম্পর্ক চিরন্তনের। যে কোনও উৎসবে পরিপাটি করে শাড়ি পরে নিজেকে গুছিয়ে সাজিয়ে তোলে বাঙালি মেয়েরা। শাড়িতেই অনন্যা বঙ্গতনয়া। শাড়ি পরার সেই প্রথম হাতেখড়ি ঠিক কবে হয়েছিল? এই প্রশ্ন করলে দেখা যাবে বেশিরভাগ মহিলার উত্তর হবে একটাই, সরস্বতী পুজোর দিন। ছোট্ট বেলায় যখন ছোট্ট ছোট্ট পায়ে তারা চলতে শিখেছে, তখনই অনেকের গায়ে উঠেছে বাসন্তী রঙের শাড়ি। বসন্তপঞ্চমীতে বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে আবাহন করেন মর্ত্যবাসী। ঘরে ঘরে লক্ষ্মীর মতই মহাসমাদরে পূজা পেয়ে থাকেন বাগদেবী। সবার ঘরেই যে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে।
কিন্তু, সরস্বতী পুজোর দিন কেন সিংহভাগ মেয়েরা শাড়ি পড়ে থাকে? বিশেষ করে স্কুলের ছাত্রীদের মধ্যেই কেন দেখা যায় শাড়ি পড়ার উন্মাদনা? আসলে, সারা বছর একই রঙের এক রকমের ‘স্কুল ইউনিফর্ম’ একঘেয়ে করে দেয় ছাত্রীদের মন। বাড়িতে, কোথাও বেড়াতে গেলে বা টিউশন পড়তে গেলে তারা এমন পোশাকই পড়ে, যাতে তারা স্বচ্ছন্দ বোধ করে। সেই একঘেয়েমি কাটাতেই একটু অন্য সাজে, অন্য ‘লুক’-এ ধরা দিতে সাধ জাগে কিশোরী মনে। আর তাদের সেই সাধে অনন্যতার ছোঁয়া এনে দেয় শাড়ি।
দেবী সরস্বতী নিজে সাদা পোশাক পরলেও তাঁর পছন্দের রং কিন্তু বাসন্তী। তাই পুজোর দিন হালকা হোক বা গাঢ়, হলুদের ছোঁয়া মাখা শাড়ি পরে স্কুলের সামনে ভিড় জমায় পড়ুয়ারা। চোখে কাজল, মাথায় ছোট্ট টিপ, ঠোঁটে লিপস্টিক। মায়ের সুন্দর করে বেঁধে দেওয়া চুল। স্কুলে ঢুকতেই শিক্ষিকাদের গাল টিপে বলা, ‘কি মিষ্টি দেখাচ্ছে তোমাকে’। এইসব কিছু নিয়েই মধুর হয়ে ওঠে নির্মল শৈশবের স্মৃতি। আর যারা শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে গিয়ে প্রথম শাড়িতে সাজিয়ে তোলে নিজেদের? তাদের অনুভূতি কিরকম?
মায়ের শাড়ির সম্ভার থেকে জহুরির চোখ দিয়ে পছন্দমত শাড়ি বেছে নিতে পুজোর দিনকয়েক আগে থেকেই চলে প্রস্তুতি। তারপরে কে কোন রঙের কেমন শাড়ি পড়ছে, কিভাবে শাড়ি পড়বে, তাই নিয়ে বন্ধুমহলে বসে বৈঠক। মায়ের ব্লাউজ হাঁটকে ম্যাচ করে তাতে চলে সেলাই করে নিজের পরনের মত করে তোলার আপ্রাণ লড়াই। আর যখন আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, সেদিন সাজুগুজু করে শাড়ি পরার পরেই বুকটা কেমন ঢিপঢিপ করে ওঠে।
শাড়ি পরার অভ্যাস তো নেই। হাঁটব কি করে? মায়ের নির্দেশের অন্ধ অনুসরণ করে স্কুলের দোরগোড়ায় গিয়ে পৌঁছাতেই চিন্তার বোঝা নামে বুক থেকে। এরপরে প্রথম শাড়ি পরে কাকে কেমন দেখাচ্ছে তাই নিয়ে চলে ছাত্রী ব্রিগেডের চুলচেরা বিশ্লেষণ। বন্ধু বা শিক্ষিকাদের টুকরো টুকরো মন্তব্যে প্রথম শাড়ি পরার দিনটা রয়ে যায় মনের মণিকোঠায়।
‘তোকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে রে’। ‘বাঃ, কাকিমার শাড়িটা কি সুন্দর’। ‘এটা কি শাড়ি রে? খুব সুন্দর করে শাড়ি পরেছিস তো।’ ‘তোমাকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে শাড়িতে’।
এদিক ওদিক থেকে ভেসে আসা বিক্ষিপ্ত প্রশংসার বন্যায় ভরে থাকে দিনটা। জিনস-টপ, কুর্তি, সালোয়ার, চুড়িদারে অভ্যস্ত তিতলির মতো হাজার হাজার কিশোরীর মত পাল্টে যায় নিমেষে। শুধু একবার নয়, প্রতি বছর সরস্বতী পুজোতে বা বাঙালির উৎসবে শাড়িতেই সাজিয়ে তুলতে হবে নিজেকে। পণ করে বসে ‘প্রথম শাড়ি’-তে অনন্য হয়ে ওঠা কৈশোরের মন।