এটি ছাড়া সরস্বতী পুজো অসম্ভব, কিন্তু পুজোর আগে ছোঁয়া মানা
লোভে রসনার জল শুকিয়ে গেলেও হাত পা বাঁধা। যুগ যুগ ধরে এমন মনখারাপ করা রীতির কথাই আমরা শুনে আসছি অভিভাবকদের কাছ থেকে।
মাঘের হাওয়া গায়ে লাগা মানেই কেমন যেন পুজো পুজো গন্ধ। ১ বছরের অপেক্ষা শেষে বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে কাছে পাওয়া। এক দিনের জন্য লেখাপড়ার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি। আর অঞ্জলি দিয়েই মুখ ভর্তি টোপা কুল বা নারকেল কুলের রূপ-রস-স্বাদ-গন্ধ-বর্ণটুকু নিংড়ে নেওয়ার মোক্ষম সুযোগ। মাঘের শেষ হলেই যে আর কুল খাওয়া যাবে না। সরস্বতী ঠাকুর নইলে রাগ করবেন! আর তিনি রাগ করলে পরীক্ষায় পাশ করা বা ভালো ফল করা হয়ে উঠবে মুশকিল। তা সে যে যতই মেধাবী হোক না কেন। আবার পুজোর আগেও বিন্দুমাত্র দাঁতে কাটা যাবে না কুল।
পড়ুয়াদের জীবনে লোভনীয় এই ফলের বরাদ্দ কেবল মাঘ মাসটুকুতেই। লোভে রসনার জল শুকিয়ে গেলেও হাত পা বাঁধা। যুগ যুগ ধরে এমন মনখারাপ করা রীতির কথাই আমরা শুনে আসছি অভিভাবকদের কাছ থেকে। খারাপ ফলাফলের ভয়ে একপ্রকার বাধ্য হয়েই সেই গতানুগতিক নিয়ম মেনে চলতে বাধ্যও হয় পড়ুয়ারা। সরস্বতী পুজোর আগে বাজার জমিয়ে ক্রেতাদের হাতছানি দেয় টোপা, বিলাতি, নারকেল কুলের সম্ভার। তবুও কাছে পেয়েও তাদের আপন করার উপায় থাকে না। আসুন জেনে নি তার কারণটা।
কৃষিপ্রধান দেশ আমাদের বঙ্গভূমি। উর্বর কৃষিক্ষেত্র চাষিদের কাছে মায়ের সমান। সেই জমিতে উৎপন্ন মরসুমের প্রথম ফসলকে বাজারজাত করার আগে তাই পুজো করে থাকে কৃষক পরিবার। যেমন, নতুন ধান ঘরে তোলার আগে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে পালন করা হয় ‘নবান্ন’ উৎসব। ‘নবান্ন’ অর্থাৎ নতুন ফসলকে বরণ করে, পুজো করে ঘরে তোলার উৎসব। কুলের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য বলা যায়। কুল মূলত শীতকালীন একটি ফল। ইংরাজি বছরের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে বাজারে কুলের আমদানি সবচেয়ে বেশি। এই সময়েই কুলের ফলনে ম’ম করে ওঠে চারদিক। স্বাভাবিকভাবেই মাঘ মাসে পূজিতা দেবী সরস্বতীকে আদর করে বরণ করা হয় মাঘের নতুন ফল দিয়েই। দেবীর চরণে সেই ফল উৎসর্গ না করা পর্যন্ত কুলের রসনা লাভ থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় সকলকে। এই লোকাচার কালক্রমে পরিণত হয় লোকায়ত বিশ্বাসে।
তবে লোকাচারের বাইরে আছে আরও একটি যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা। যা থেকে আভাস মেলে মাঘ মাসের শুক্ল পঞ্চমী তিথির আগে কুল গলাধঃকরণ করতে না পারার কারণ। বসন্তপঞ্চমীর আগেই গাছে গাছে কুলের ভারে নুয়ে যেতে থাকে শাখা-প্রশাখা। হাল্কা বা গাঢ় সবুজ রঙের কুলের গন্ধ মাতাল করে দেয় আট থেকে আশি সকলকেই। কুল তো আর গোনাগুনতি খাওয়া চলে না। তাই মুঠো ভর্তি কুল গালে চলে যায় টপাটপ। কাঁচা কুলের মারাত্মক টক ভাব মোটেই সুস্বাদু নয়। সেই কুল দাঁতে ঠেকানোর অর্থ দাঁতকে একপ্রকার কষ্ট দেওয়া। তাছাড়া, কাঁচা অপক্ব কুল খেলে পেট খারাপের সম্ভাবনাও থেকে যায়।
কিন্তু এত কথা কি আর শৈশব বা কৈশোরে কেউ শোনে? অতঃপর ‘জুজু’-র মতো বাগদেবীর কোপের ভয় দেখিয়ে অসময়ে কুল খাওয়া থেকে বিরত রাখতেই জন্ম হয় এক নতুন লোকবিশ্বাসের। আর যে যতই ডেঁপো বা দুঃসাহসিক হোক না কেন, বিদ্যার দেবীর রোষে কেই বা পড়তে চায়! তাই প্রতি বছর ‘আসছে বছর আবার হবে’ ভেবেই প্রচলিত বিশ্বাসে বিশ্বাসী পড়ুয়াদের শুরু হয় ফের কুল খাওয়ার জন্য দিন গোনার পালা।