বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর সেই পার্বণ প্রেম ছাড়া কেমন যেন পানসে। বন্ধু বিনে যেমন প্রাণ বাঁচে না, তেমনই প্রেম ছাড়া বন্ধ্যা বাঙালির উৎসব। আর সেই উৎসবের নাম যদি হয় ‘সরস্বতী পুজো’, তাহলে তো চোখ বন্ধ করে দিনটাকে বলাই যায়, অকাল বসন্তের ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’।
চোখে কাজল, ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক আর পরিপাটি করে পরা শাড়ি। শুধুই কি তা সরস্বতী পুজোর সাজ? নাকি যত্ন করে বিশেষ দিনটিতে বিশেষ মানুষটার চোখে ‘বিশেষ’ হয়ে ওঠার অনুরাগ মিশে থাকে তাতে! ওদিকে প্রিয়তমাকে আজ কেমন লাগে দেখার অপেক্ষায় কেতাদুরস্ত পাঞ্জাবি-জিনসে একেবারে ফিটফাট হয়ে তৈরি বঙ্গ নব যৌবন।
প্রেমিকা যদি হয় ‘বং ভ্যালেন্টাইনস ডে’-র সুচরিতা। তবে ‘উত্তম’ হওয়ার চেষ্টায় মরিয়া প্রেমিকের দল। বছরের বাকি ৩৬৪ দিনের লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেমের আগল সরস্বতী পুজোর দিনে অনেকটাই শিথিল করে দেন প্রেমের পথে ‘কাঁটা’ হয়ে দাঁড়ানো অভিভাবকেরা। এই দিনটাতে থাকেনা অহেতুক চোখরাঙানি বা বাড়ি ফেরার তাড়া। মেয়েদের স্কুলে মেয়েরা। ছেলেদের স্কুলে ছেলেরা। চুলোয় যাক ‘লিঙ্গ বৈষম্য’-এর নামে হীর-রাঞ্ঝাকে আলাদা করার অপচেষ্টা। অঞ্জলি দিয়ে তড়িঘড়ি মেয়েদের স্কুলের খোলা গেট পার হওয়ার উত্তেজনায় বঙ্গ কৈশোরকে বাধা দেয় কার সাধ্য!
চুলটাকে এদিন আর আলুথালু করে আঁচড়ানো যাবে না। নাহলে সুন্দরী প্রজাপতিদের মাঝে নজর কাড়া যাবে কি করে? মাকে আগেই বলে রাখা আছে। জামার কোনও ভাঁজ যেন অবিন্যস্ত না থাকে। ওদিকে মনে ‘লাড্ডু’ ফুটছে পঞ্চদশী, অষ্টাদশীর মনেও। তারা জানে, আজ স্কুলের গেটে শুধু অভিভাবকরাই নয়, তাদের খুঁজবে আরও আরও শত শত চোখ।
যারা প্রেমবিরোধী ঝাণ্ডা হাতে সারাবছর গলা ফাটিয়ে বেড়ায়, এদিন তাদেরও মনের পাথর ভেঙে উঁকিঝুঁকি মারে কাঞ্চনজঙ্ঘার রক্তিম আভা। যাদের ভালোবাসার বীণার তন্ত্রী ভালো করে বাজার আগেই গেছে ছিঁড়ে, তাদের হৃদয়ে বেজে ওঠে বিসর্জনের বিষাদের সুর। অন্তত সরস্বতী পুজোর দিনের জন্য একজন বিশেষ কেউ থাকলে ভালোই হত। এই ভাবনা নিয়েই হাসি হাসি মুখে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় অনেককেই।
যারা আর একটু স্বাধীন, সদ্য স্কুল পেরিয়ে কলেজের নতুন জীবনের রোমাঞ্চ গায়ে মেখে হাওয়ায় ভেসে চলেছে, তাদের উন্মাদনা আবার অন্য রকমের। নিছক চোরা চাহনিতে আর কতদিন নিজেদের আটকে রাখা যায়? তাই আর প্রতীক্ষা নয়। বন্ধুদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে টুক করে এক ফাঁকে ভ্যালেন্টাইনের হাতে হাত রেখে তারা বেরিয়ে পড়ে এদিক-ওদিক। ময়দান, ভিক্টোরিয়া, ইকো পার্ক বা গঙ্গার ধার। ঝাঁকে ঝাঁকে রঙিন প্রজাপতিতে ঝিলমিলিয়ে ওঠে শহর বা মফস্বলের আনাচ-কানাচ। পুজোর গন্ধকে ছাপিয়ে যায় প্রেমের নতুন বা পুরাতন গন্ধ।
সরস্বতী পুজো। যার আরেক নাম ‘বাঙালির ভ্যালেন্টাইনস ডে’। তবে এইদিনটি পালন করতে সদ্য প্রেমে পা দেওয়া বা প্রেমে হাত পাকানো অভিজ্ঞরা কার্ড খুঁজতে ঢুঁ দেয় না আর্চিস গ্যালারিতে। একরাশ গোলাপ দিয়ে প্রেমিকার খোঁপা সাজিয়ে তোলার ট্র্যাডিশন বড্ড সেকেলে আজকের ‘হাইটেক’ প্রজন্মের কাছে। তার থেকে শীততাপনিয়ন্ত্রিত শপিং মলে গিয়ে সেলফি ঝড় তোলা বা মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে পপকর্ন খেতে খেতে পছন্দের সিনেমা দেখতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ জেন এক্স।
কেউ কেউ আবার ঘোরার ফাঁকে বিশেষ মানুষের সঙ্গে ফোন বা ক্যামেরায় বন্দি করে রাখে নিজেদের আনন্দের মুহুর্তটুকু। ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে দিন কাটানোটাই আসল কথা। আবার কেউ কেউ নরম ঘাসের চাদরে বসে আলতো ছোঁয়ার আলাপচারিতায় খুঁজে পায় স্বর্গসুখ। বন্ধুদের সঙ্গে তো স্কুল বা কলেজ টাইমে আড্ডা চলে। কিন্তু সরস্বতী পুজো তো বছরে একবার করেই আসে।
ভ্যালেন্টাইনস ডে নিয়ে ইদানিং যা প্রচার চলছে, তাতে বাবা-মায়েদের এই দিনের মাহাত্ম্য বুঝতে আর বাকি নেই। তাই ওই দিন বাড়িতে ‘ম্যানেজ’ করে বাইরে বার হওয়াটা চাপের হয়ে যায়। তাছাড়া, হতচ্ছাড়া পরীক্ষাগুলোওতো ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে ফেব্রুয়ারি থেকেই। অতএব, উৎসবের মধ্যেই খুঁজে নাও প্রেম করার ফুরসত। অঞ্জলি দেওয়া সেরে, শিক্ষাপ্রাঙ্গণে মুখ দেখিয়েই ঝোড়ো হাওয়ার গতিতে কপোত-কপোতীরা উড়ে চলে তাদের গন্তব্যে। মা সরস্বতী, রাগ কোরো না প্লিজ। বিদ্যার সাথে সাথে প্রেমের বেলুনে অক্সিজেন যুগিও মা। মনে মনে এইটুকু প্রার্থনা জানিয়েই একগুচ্ছ গোলাপের টাটকা গন্ধ গায়ে মেখে শুরু হয়ে যায় বঙ্গের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীদের প্রেম দিবসের শুভ মহরৎ।