কোন শিবলিঙ্গ পুজোয় কি ফল
তন্ত্রে শিলা ধাতু মাটি প্রভৃতি দিয়ে নির্মিত কৃত্রিম শিবলিঙ্গের কথা বলা হয়েছে। কৃত্রিম শিবলিঙ্গ আছে অসংখ্য। এর মধ্যে যে কোনও একটি পুজো করা সকলেরই কর্তব্য।
শিবলিঙ্গ দু’প্রকার-অকৃত্রিম ও কৃত্রিম। স্বয়ম্ভূলিঙ্গ, বাণলিঙ্গ প্রভৃতিকে অকৃত্রিম লিঙ্গ বলে। ধাতু মাটি পাথর দিয়ে গড়া লিঙ্গকে বলে কৃত্রিম লিঙ্গ। যে লিঙ্গের মূল পাওয়া যায় না বা স্থানান্তরিত করা যায় না তাকে বলে অনাদিলিঙ্গ। এছাড়া আর এক জাতীয় লিঙ্গ কে বলা হয় জ্যোতির্লিঙ্গ।
ভারতবর্ষে জ্যোতির্লিঙ্গ আছে মোট বারোটি। মহাকালেশ্বর, সোমনাথ, ওঙ্কারেশ্বর, বৈজনাথ (বৈদ্যনাথ), নাগনাথ, রামেশ্বর, বিশ্বনাথ, ঘৃষ্ণেশ্বর, কেদারনাথ, ভীমাশঙ্কর, ত্র্যম্বকেশ্বর ও মল্লিকার্জুন – শিবপুরাণে উল্লিখিত এই জ্যোতির্লিঙ্গগুলি সমধিক আদৃত ও প্রসিদ্ধ।
উক্ত শিবলিঙ্গগুলি স্বয়ম্ভূ ও জ্যোতির্লিঙ্গ। অকৃত্রিম লিঙ্গও বটে। তবে জ্যোতির্লিঙ্গ ঠিক কী বস্তু তা বলা শক্ত। প্রলয় পয়োধিজলে যে লিঙ্গের আবির্ভাব হয় তা জ্যোতির্লিঙ্গ। আমার বিশ্বাস, ওই লিঙ্গের শক্তি যে যে অনাদিলিঙ্গে সন্নিবিষ্ট আছে, সেগুলিই জ্যোতির্লিঙ্গ। পরে আসছি দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে।
মহানির্বাণতন্ত্রে স্বয়ং শিব পার্বতীকে বলেছেন, ‘দেবী! যে ব্যক্তি আগে আমার লিঙ্গের অর্চনা না করে অন্য দেবতার পুজো করে, তার পুজো কোনও দেবতাই গ্রহণ করেন না।’…
এবার মহানির্বাণতন্ত্রে শিলা ধাতু মাটি প্রভৃতি দিয়ে নির্মিত কৃত্রিম শিবলিঙ্গের কথা বলা হয়েছে। এই ধরণের কৃত্রিম লিঙ্গ আছে অসংখ্য। তার মধ্যে বিশেষ বিশেষ কতগুলি দ্রব্য দিয়ে নির্মিত শিবলিঙ্গের বিবরণ ও ফললাভের কথাই বলি।
পাথরে নির্মিত লিঙ্গ পুজো করলে মোক্ষলাভ ও আনুষঙ্গিক ভোগলাভ হয়ে থাকে। পার্থিব লিঙ্গ পুজো করলেও ভোগলাভ ও আনুষঙ্গিক মুক্তিলাভ হতে পারে। দারুময় লিঙ্গ ও বিল্ব-নির্মিত লিঙ্গ পুজো করলেও ওই একই ফল হয়। সোনায় নির্মিত লিঙ্গ পুজো করলে লক্ষ্মী স্থিরতরা হন ও রাজ্যপ্রাপ্তি হয়। তামার তৈরি লিঙ্গ পুজোয় সন্তান বৃদ্ধি এবং রঙ্গ-নির্মিত (রঞ্জকদ্রব্য অর্থাৎ রাং ধাতু) শিবলিঙ্গ পুজো করলে পরমায়ু বৃদ্ধি হয়ে থাকে।
পদ্মপুরাণের কথায়, পারদের শিবলিঙ্গ পুজোয় অতুল ঐশ্বর্য, মুক্তার লিঙ্গ পুজো করলে সৌভাগ্য, চন্দ্রকান্তমণি (Moon Stone) দিয়ে তৈরি শিবলিঙ্গ পুজো করলে দীর্ঘায়ু লাভ হয়। সমস্ত কাম্য বস্তু লাভ করতে পারা যায় সুবর্ণময় লিঙ্গ পুজো করলে।
জাগতিক সমস্ত কামনা পূর্ণ হয় হিরে, স্ফটিক, গুড় অন্ন প্রভৃতি দিয়ে শিবলিঙ্গ নির্মাণ করে পুজো করলে। তবে গুড় বা অন্ন দিয়ে সদ্যনির্মিত লিঙ্গই পুজো করা বিধেয়, পরদিন তা বাসি হবে, পুজো করা যাবে না।
লক্ষ্মণ সমুচ্ছয়ে কথিত আছে, গন্ধলিঙ্গ পুজো করলে মানুষের সৌভাগ্য বৃদ্ধি হয়। গরুড় পুরাণের কথায়, দু-ভাগ কস্তূরী, চারভাগ চন্দন, তিনভাগ কুমকুম (জাফরান), চারভাগ কর্পূর, এগুলো সব একত্র করে শিবলিঙ্গ নির্মাণ করলে তাঁকে গন্ধলিঙ্গ বলে। এই লিঙ্গ পুজো করলে মানুষ বন্ধুদের শিবসাযুজ্য হয় (পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার সংযোগ বা অভেদ, একত্ব বুঝায়)।
মুক্তিলাভ হয়ে থাকে পুষ্পময় লিঙ্গ পুজো করলে। পলি মাটি দিয়ে নির্মিত শিবলিঙ্গে বিবিধ কামনা সিদ্ধি, লবণের লিঙ্গে পুজো করলে সুখ ও সৌভাগ্যলাভ হয়। পাশ-নির্মিত (রজ্জু বা দড়ি) লিঙ্গ পুজো করলে উচাটন কার্য হয়ে থাকে। মূল দিয়ে (বৃক্ষাদির গোড়ার নিচের অংশবিশেষ, শিকড়) তৈরি শিবলিঙ্গ পুজো করলে শত্রুক্ষয় হয়।
ধুলো দিয়ে নির্মিত শিবলিঙ্গ ভক্তিপূর্বক কেউ পুজো করলে তিনি বিদ্যাধর পদ (স্বর্গের গায়করূপে দেবযোনিবিশেষ) প্রাপ্ত হয়ে পরে শিবসদৃশ হন। মানুষ লক্ষ্মীলাভ করতে পারে গোময় (গোবর) দিয়ে তৈরি শিবলিঙ্গ পুজো করলে। তবে গোময় স্বচ্ছ অর্থাৎ শূন্যে ধরা (ভূমিতে পতনরহিত) ও কপিলা গাভির হতে হবে। যব, গোধূম (গম), ধান দিয়ে তৈরি শিবলিঙ্গ পুজোয় লক্ষ্মীলাভ, পুষ্টি ও বংশবৃদ্ধি হয়। সিতাখণ্ড (মধুজাত শর্করা) নির্মিত লিঙ্গ পুজো করলে আরোগ্যলাভ, লবণ হরিতাল (পারদযুক্ত পীতবর্ণ বিষাক্ত ধাতব পদার্থ বিশেষ) শুণ্ঠী পিপ্পলী ও মরিচ মিশিয়ে তৈরি লিঙ্গ পুজো করলে বশীকরণ সিদ্ধ হয়।
গব্যঘৃতের লিঙ্গে বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা, লবণ নির্মিত লিঙ্গ পুজো করলে সৌভাগ্য বৃদ্ধি হয়। তিল পিষে তৈরি শিবলিঙ্গ পুজোয় সমস্ত কামনা সিদ্ধ, তুষের লিঙ্গে মারণ কার্য, ভস্ম দিয়ে তৈরি লিঙ্গ পুজো করলে যাবতীয় অভিপ্রেত সিদ্ধ হয়। গুড়ের শিবলিঙ্গে প্রীতি বৃদ্ধি, গন্ধদ্রব্য (চন্দনাদি যে কোনও গন্ধদ্রব্য) দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পুজো করলে প্রভূত পরিমাণে গুণশালী হতে পারা যায়।
শর্করায় তৈরি লিঙ্গ পুজোয় শত্রু সংহার হয়ে থাকে। কাঠের তৈরি শিবলিঙ্গ পুজো করলে দারিদ্র আসে। দই দিয়ে তৈরি করা শিবলিঙ্গ পুজোয় কীর্তি লক্ষ্মী ও সুখসৌভাগ্য বৃদ্ধি হয়। ধানের লিঙ্গ পুজোয় ধানলাভ, ফলের শিবলিঙ্গ পুজোয় ফললাভ, ফুলের শিবলিঙ্গ পুজো করলে দিব্যভোগ ও পরমায়ু লাভ হয়।
ধাত্রীফলে নির্মিত লিঙ্গ পুজো করলে মুক্তিলাভ, ননী দিয়ে তৈরি শিবলিঙ্গ পুজোয় কীর্তি ও সৌভাগ্য বৃদ্ধি, দূর্বাকাণ্ড দিয়ে প্রস্তুত লিঙ্গ পুজো করলে নিবারণ হয় অপমৃত্যুর। কর্পূরের শিবলিঙ্গ তৈরি করে পুজো করলে ভোগ ও মোক্ষলাভ হয়।
নবরত্নের মধ্যে মুক্তা নির্মিত লিঙ্গ পুজোয় সৌভাগ্য, স্ফটিক লিঙ্গে সর্বকামনাসিদ্ধি হয়। সোনার শিবলিঙ্গ তৈরি করে পুজো করলে অতুল ঐশ্বর্যভোগ, কাঁসা ও পিতল মিশ্রিত শিবলিঙ্গে শত্রুবিনাশ, শুধু কাঁসার তৈরি শিবলিঙ্গে কীর্তিলাভ, শুধু পিতলের লিঙ্গে ভোগ ও মোক্ষলাভ, রাং সিসা কিংবা লোহার লিঙ্গে শত্রুনাশ এবং অষ্টধাতু নির্মিত শিবলিঙ্গ পুজো করলে সমস্ত কামনাসিদ্ধি হয়। অষ্টধাতুর লিঙ্গ পুজোয় নিবারণ কুষ্ঠরোগ। সোনা রুপো ও তামা মিশিয়ে তৈরি শিবলিঙ্গ পুজো করলে বিজ্ঞান বিষয়ে সিদ্ধিলাভ হয়ে থাকে।
যাদের ধনাকাঙ্ক্ষা আছে, তাদের কর্তব্য গন্ধপুষ্প নির্মিত লিঙ্গ, অন্নাদি দ্বারা নির্মিত অথবা কস্তূরী দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পুজো করা, এ কথা বলা হয়েছে কালোত্তরে।
মাতৃকাভেদ তন্ত্রে দ্বাদশ পটলে আছে, বালুকাময় শিবলিঙ্গ পুজো করলে কামনাসিদ্ধি, গোময় শিবলিঙ্গ পুজো করলে শত্রুবিনাশ হয়। উক্ত শিবলিঙ্গের মাহাত্ম্য এমনই, এতে ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষলাভ হয়ে থাকে।
‘শিবধর্ম’ নামক ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, ব্রহ্মা নিয়মিত শিলাময় লিঙ্গ পুজো করেন। এ জন্যই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মত্বপদ প্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। ভগবান বিষ্ণু নিয়ত পুজো করেন ইন্দ্রনীলময় শিবলিঙ্গ। তার প্রভাবেই তিনি প্রাপ্ত হয়েছেন সর্ব-পালকত্বরূপ বিষ্ণুত্বপদ। নিয়ত নির্মল স্ফটিকময় শিবলিঙ্গ পুজো করে থাকেন বরুণ। এ জন্যই তিনি প্রাপ্ত হয়েছেন তেজোবল সমন্বিত বরুণত্বপদ।
যে সব শিবলিঙ্গের কথা বলা হয়েছে, এর মধ্যে যে কোনও একটি শিবলিঙ্গ পুজো করা সকলেরই কর্তব্য। লিঙ্গার্চনতন্ত্রে প্রথম পটলের কথা, সমস্ত পুজোর মধ্যে লিঙ্গ পুজোই শ্রেষ্ঠ ও মুক্তিদায়ক।
দেবাদিদেব সদাশিব পার্বতীকে বলেছেন, ‘দেবী, অচল শিবলিঙ্গ স্থাপনের মাহাত্ম্য তোমার কাছে বেশি আর কী বলব; এই শিবলিঙ্গ স্থাপন করলে মানুষ সমস্ত মহাপাতকাদি থেকে বিমুক্ত হয়ে পরমপদ লাভ করে’।