বাংলার এই মন্দিরের শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধিকা হেঁটেচলে বেড়ান, কথা কন, এঁরা জীবন্ত
শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় সত্যিই এঁরা জীবন্ত হেঁটেচলে বেড়ান, কথা কন, ভক্তের কাছে খেতে চান।
এখন গঙ্গার সেই রূপও নেই-নেই উত্তাল তরঙ্গায়িত যৌবনও, যেমনটা ছিল প্রায় পাঁচশো বছর আগে দিব্য ঐশ্বর্যের প্রকাশ গৌরসুন্দরের প্রেমভক্তি ধনের ভাণ্ডারী নিরাসক্ত অন্তরঙ্গ প্রধান পার্ষদ কৃষ্ণপ্রেমিক নিত্যানন্দ অবধূতের আমলে। তবুও পুরাণের কাল থেকে নামের ঔজ্জ্বল্যে ভরা রুগ্না-সুন্দরী গঙ্গা শ্যামসুন্দরের চরণ ছুঁয়ে আজও বয়ে চলেছে তরতরিয়ে।
গঙ্গার পূর্ব পারে শ্রীপাট খড়দহের কথা – ‘দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী, কালীঘাটের কালী, আর খড়দার শ্যামসুন্দর – এঁরা জীবন্ত, হেঁটে চলে বেড়ান, কথ কন, ভক্তের কাছে খেতে চান’ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় আজ সেই শ্যামসুন্দরের কথা।
আরও অসংখ্য জনশ্রুতির মধ্যে থেকে আর একটি তুলে ধরছি কমল চৌধুরীর ‘উত্তর চব্বিশ পরগণার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থ থেকে – ‘শ্যামসুন্দর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিত্যানন্দর ছেলে বীরভদ্র গোস্বামী। কথিত আছে, সে সময়ে গঙ্গার পশ্চিম তীরে বল্লভপুর গ্রামের রুদ্র ব্রহ্মচারী স্বপ্নাদেশ পান, শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বলছেন – তিনি যেন গৌড়ের বাদশাহের প্রাসাদ থেকে একখানি পাথর এনে তা দিয়ে বিগ্রহ তৈরি করেন। রুদ্র গৌড়ে গিয়ে স্বপ্ন নির্দিষ্ট পাথর প্রার্থনা করেন বাদশাহর কাছে। বাদশাহ অসম্মত হন। হঠাৎ পাথরের গায়ে ঘাম দেখা দেয়। জনৈক মন্ত্রী বাদশাহকে বলেন, এ এক অশুভ লক্ষণ। সঙ্গে সঙ্গে পাথর দিয়ে দেওয়া হয় রুদ্রকে। সেই ভারী পাথর নৌকায় উঠাতে গিয়ে পড়ে যায় জলে। কিন্তু দৈব প্রভাবে পাথর চলে আসে শ্রীরামপুরের কাছে রুদ্রের বসতবাড়ি বল্লভপুরের ঘাটে। এই পাথর থেকে শ্যামসুন্দর, রাধাবল্লভ ও নন্দদুলালের তিনটি বিগ্রহ তৈরি হয়। বীরভদ্র শ্যামসুন্দর বিগ্রহটি প্রার্থনা করলে রুদ্র দানে অসম্মত হন। পরে কোনও সময়ে রুদ্রর পিতৃশ্রাদ্ধ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হলে বীরভদ্র অলৌকিক ক্ষমতায় বারিবর্ষণ থেকে শ্রাদ্ধমণ্ডপ রক্ষা করেন, কৃতজ্ঞ রুদ্র বীরভদ্রকে দান করেন শ্যামসুন্দর বিগ্রহ।’…
বীরভদ্র প্রথমে শ্যামসুন্দরের বিগ্রহ স্থাপন করেন কুঞ্জবাটীতে। পরে একটি ছোট্ট মন্দির নির্মাণ করেন সেখানে। কালের নিয়মে সে মন্দির বিনষ্ট হয়। আনুমানিক প্রায় দুশো বছর আগে খড়দহের পটেশ্বরী গোস্বামী নামে ধর্মপ্রাণ এক গৃহবধূ নির্মাণ করে দিলেন আজকের মন্দিরটি। সেখানেই প্রতিষ্ঠা করা হয় শ্যামসুন্দরের রাধামনোহারী বিগ্রহ।
কুঞ্জবাটী রইল ডানদিকে, বাঁদিকেই শ্যামসুন্দর মন্দিরের পথ। পুজোর ডালি সাজানো কয়েকটি দোকানকে রেখে একটু এগোলেই প্রথমে বাঁদিকে পড়বে মদনমোহন মন্দির। পশ্চিমমুখী আটচালা মন্দির। আকারে বেশ বড়ই। পদ্মের উপরে দাঁড়ানো শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ কষ্টিপাথরের, শ্রীরাধিকার বিগ্রহ নির্মিত অষ্টধাতুতে। দুটি বিগ্রহই ভারী সুন্দর। এ ছাড়াও গর্ভমন্দিরের বেদিতে স্থান পেয়েছে শালগ্রামশিলা সহ গোপালের চিরপরিচিত বিগ্রহ।
মদনমোহন মন্দির ছেড়ে কয়েক পা এগোলেই ডান পাশে শ্যামসুন্দরের ভোগ রান্নাঘর। এর পরেই বিশাল আটচালা পূর্বমুখী মন্দির। গৌড়ীয় নির্মাণকলা ঢঙে নির্মিত। কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় উপরে। সেকালের নির্মাণ, চওড়া দেওয়াল। মন্দিরের সামনেই বিস্তৃত নাটমন্দির, গর্ভমন্দিরে বেদির উপরে অলঙ্কৃত রূপোর সিংহাসন তথা মঞ্চেই শ্রীশ্যামসুন্দরের অধিষ্ঠান। একরাশ ঝাঁকড়া কালো চুলে ভরা মাথা। টানা টানা ফালা ফালা চোখ দুটো যেন একটা পটলের দুটো ফালি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সোনা-রূপার নানা অলঙ্কারের ছড়াছড়ি। কেয়ূরে কুণ্ডলে কঙ্কণে অপূর্ব শোভা। মাথায় সুসজ্জিত ময়ূরপুচ্ছের মুকুট। হাতে অপ্রাকৃত রাধাপ্রেমের রাধানামের উজানভরা মোহন বাঁশি। সঙ্গে বৃন্দবনি আদলে দাঁড়ানো বৃষভানুনন্দিনী রাধার অষ্টধাতুর বিগ্রহ। এক ঢাল এলোচুল নেমে গিয়েছে পিঠ ছাড়িয়ে। শ্যামকে পেয়ে মুখে হাসি যেন আর ধরছে না। বসনে–ভূষণে যেন সেকালের জমিদার বাড়ির গিন্নি। এমন মনোহর চোখের আরাম সুন্দর শ্যাম এ বাংলায় আর আছে বলে মনে হয় না। শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় সত্যিই এঁরা জীবন্ত হেঁটেচলে বেড়ান, কথা কন, ভক্তের কাছে খেতে চান।
প্রতিদিন ভোরে শ্যামসুন্দরের মঙ্গলারতি, বাল্যভোগ, স্নান ও বস্ত্র পরিবর্তন তো হয়ই, কম করেও ১০/১২ রকমের ভোগ নিবেদিত হয় দুপুরে। যেমন – অন্ন, ঘি-ভাত, পোলাও, শাক বা অন্য কোনও ভাজা, শাক চচ্চড়ি, মোচার ঘণ্ট, শুক্তো, ধোঁকার ডালনা, ডাল, ডালের ঘণ্ট, পনির, পায়েস, মালপোয়া, চাটনি – এমন অসংখ্য রান্নাভোগ দেওয়া হয় প্রতিদিন, কোনও ভক্তের দেওয়া ভাণ্ডারা থাকলে ভোগের উপকরণ আরও বাড়ে বই কমে না। আগের দিন জানিয়ে গেলে পরের দিন প্রসাদ পাওয়া যায় অনায়াসে। রাতে সন্ধ্যারতি, সেবা, শীতল ভোগ দিয়ে বন্ধ হয় মন্দিরের দরজা। কোনও ব্যতিক্রম ছাড়াই শ্যামসুন্দরের এমন সেবা চলে আসছে প্রতিদিন, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর।
সারাবছর শ্যামের দুচোখের পাতা এক করার ফুরসত আছে বলে মনে হয় না। বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই আছে। বৈশাখ মাসে পূর্ণিমায় ফুলদোল উৎসব দিয়ে শুরু, তারপর হাজারো উৎসব। কার্তিক পূর্ণিমার রাসযাত্রা, মাঘী পূর্ণিমায় বার্ষিক উৎসব, ফাল্গুনী পূর্ণিমায় দোলযাত্রা ছাড়াও নানান উৎসব-অনুষ্ঠান ভাণ্ডারায় শ্যামসুন্দরের মন্দির অঙ্গন একেবারে মুখরিত হয়ে আছে বছরভর, ফি বছর। এই উৎসবগুলির খ্যাতি আজ সারা বাংলা জুড়ে। বৈশাখী পূর্ণিমায় ফুলদোল উৎসব হয় বাহারি ফুলের সমারোহে। মেলা বসে। দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থী ভক্তের ঢল নামে শ্যামমন্দিরে। আসার পথও সুগম। স্টেশন খড়দহ থেকে অটো আসে মিনিট ৮/১০ অন্তর।