জগন্নাথদেবের জন্মদিন কবে, জ্বরলীলা উৎসবের মাহাত্ম্য
ভক্তের সঙ্গে ভগবান অন্তরঙ্গ হতে কত রকম কায়দাকানুন ছুতো-নাতার পর নিজেকে উন্মোচিত করেন তা নীলাচলে জগন্নাথদেবের কাণ্ডটা দেখলে বোঝা যায়। শ্রীভগবানের স্নানযাত্রা তার একটা উদাহরণই বটে।
কালী ও কেষ্টঠাকুরের যেমন শতনাম, তেমনি জগন্নাথক্ষেত্রের। বিভিন্ন নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে প্রভুর এই তীর্থ। শ্রীক্ষেত্র, শ্রীজগন্নাথধাম, শঙ্খক্ষেত্র, উচ্ছিষ্টক্ষেত্র, পুরুষোত্তমক্ষেত্র, উড্ডীয়ান পীঠ, জমনিক তীর্থ, কুশস্থলী, পুরী, মর্তবৈকুণ্ঠ, নীলাদ্রি ব আনীলাচল। এত নাম অন্য কোনও তীর্থে বড় একটা দেখা যায় না। বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পশ্চিম উপকূলেই প্রাচীন তীর্থ মর্তবৈকুণ্ঠ।
ভক্ত, ভক্তি ও ভাস্কর্য – এই তিন নিয়েই পুরুষোত্তমক্ষেত্র, ওড়িশা। এখানে ভক্তের সঙ্গে ভগবান অন্তরঙ্গ হতে কত রকম কায়দাকানুন ছুতো-নাতার পর নিজেকে উন্মোচিত করেন তা নীলাচলে জগন্নাথদেবের কাণ্ডটা দেখলে বোঝা যায়। শ্রীভগবানের স্নানযাত্রা তার একটা উদাহরণই বটে।
জ্যৈষ্ঠমাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা মহোৎসব। এ সময় সুদর্শনের সঙ্গে জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রা স্নানবেদিতে ‘পহাণ্ডি’ বিজয় করেন। অর্থাৎ সুদর্শনের (চক্র) সঙ্গে তিনজনের একশো আটটি সোনার কলসের সুশীতল জলে মহাস্নান হয়ে থাকে। জগন্নাথসহ সকলকে স্নান করানো হয়। ‘জয়’ শব্দ ভরা নানান স্তবস্তুতির মাধ্যমে বন্দনা করা হয় প্রভু জগন্নাথকে।
সমস্ত দেবদেবীরা যাতে সুন্দরভাবে স্বচ্ছন্দে জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা উৎসব দেখতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে মহারাজা শ্রীইন্দ্রদ্যুম্ন স্নানযাত্রাকালে স্নানবেদির চারদিকে মূল্যবান নানান রত্নশোভিত চাঁদোয়া ও আবরণবস্ত্র আচ্ছাদিত করে দিতেন। স্নানবেদি কালের নিয়মে জীর্ণ হয়ে যায়। বর্তমানের স্নানবেদি নির্মাণ করে দেন মহারাজা শ্রীঅনঙ্গভীম দেব।
স্নানযাত্রার দিন নানা ধরণের মণিমুক্তা মালা চামর পতাকা ও তোরণ দিয়ে সাজিয়ে, চন্দন আতর ইত্যাদি মিশিয়ে সুগন্ধ সুশীতল পবিত্র জল ও সুগন্ধি ধূপ গন্ধ দিয়ে সুরভিত করা হয় স্নানমঞ্চ। তারপর মন্দিরঅঙ্গনে দক্ষিণের কূপ থেকে স্নানের জল আনেন প্রভু জগন্নাথের সেবকরা। সেই জল সুগন্ধ দ্রব্যে সুবাসিত করে ‘পাবমানী’ মন্ত্রে সোনার কলস পরিপূর্ণ ও অধিবাস করেন গর্ভমন্দিরে। পরে সুদর্শনের সঙ্গে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে স্নানমঞ্চে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলে।
এরপর চামর ও তালপাতার পাখা দিয়ে জগন্নাথসহ সকলকে বাতাস দিতে থাকেন সেবকরা। স্নানমঞ্চে নিয়ে যাওয়ার সময় অসাবধানে যদি কোনও দোষ হয়, এই আশঙ্কায় প্রভুর সেবকরা সুন্দর পট্টবস্ত্র দিয়ে ঢেকে দেন জগন্নাথের সর্বাঙ্গ। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় স্নানমঞ্চে।
জগন্নাথ মন্দিরঅঙ্গনে বাইরের প্রাঙ্গণে এত উঁচুতে বেদি স্থাপন করা হয়েছে যে, পুরীর প্রশস্ত রাজপথ (বড়দাণ্ড) থেকেও দর্শন করা যায় স্নানযাত্রা।
স্নানমঞ্চে সর্বতীর্থময় কূপ থেকে জল তুলে সেই জল দিয়ে জ্যৈষ্ঠমাসে পূর্ণিমা তিথিতে ভোরবেলায় স্নানসেবা করা হয় ব্রহ্মার সঙ্গে শ্রীজগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রার। স্নানের পর জগন্নাথ ও বলরামের হাতিবেশ কিংবা গণেশবেশ হয়ে থাকে।
জ্যৈষ্ঠমাসের পূর্ণিমাতে স্বয়ম্ভু মনুর যজ্ঞপ্রভাবে প্রভু জগন্নাথ আবির্ভূত হয়েছিলেন। তারই আজ্ঞামতে জগন্নাথের পুণ্য জন্মদিন হিসাবে পালন করা হয় উক্ত মাস তিথিতে। মহাসমারোহে ‘স্নানসেবা’ অনুষ্ঠিত হয় স্নানবেদিতে।
জগন্নাথদেব আদেশ দিয়েছিলেন মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নকে, ‘মহাস্নানের পর পনেরো দিন ভগবানের অঙ্গরাগবিহীন রূপ যেন কেউ কখন না দর্শন করে। ‘ফলে স্নানের পর প্রভু জগন্নাথের মন্দিরে প্রবেশ হলে মন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকে পনেরো দিন। এই সময় দর্শন হয় না বলে বলা হয়, ‘অনবসরকাল’। দেব জগন্নাথ তখন অবস্থান করেন মন্দিরে জগমোহনের পাশে ‘খটশেষগৃহে’ বা ‘নিরোধনগৃহে’।
স্নানযাত্রার পর নরলীলা মাধুর্য বিস্তার করতে জ্বরলীলা প্রকাশ করেন প্রভু জগন্নাথ। এসময় জগন্নাথের জ্বর হয়েছে বলে দয়িতা-পতিরা ওষুধ পথ্য অর্থাৎ মিষ্টি রসের পানা বিশেষ পাচন ও নানা ধরণের মিষ্টান্ন ভোগ দেন প্রতিদিন।
জগন্নাথদেবের পনেরো দিনের জ্বরলীলা প্রকাশ একটা ছুতোমাত্র। পনেরো দিন দেহ প্রসাধনহীন অর্থাৎ অঙ্গরাগবিহীন থাকে। দেখতে মোটেই ভালো লাগবে না ভক্তদের, শ্রদ্ধা ভক্তি নষ্ট হতে পারে শ্রীহীন দেহ দেখলে, তাই জগন্নাথের আদেশ – ওই সময় কেউ যেন তাঁকে দর্শন না করে। আসলে জ্বরলীলা নামক ছুতোর দিনগুলিতে চলে জগন্নাথসহ অন্য সকলের অঙ্গরাগ তথা দেহসজ্জা। এই ‘অঙ্গরাগসেবা’ প্রতিবছরই হয় স্নানযাত্রার পরে। তারপর যখন নবমূর্তিতে নানা বেশভূষায় সুসজ্জিত হয়ে জগন্নাথ দর্শন দান করেন তখন উৎসবকে বলা হয় নেত্রোৎসব বা নবযৌবনোৎসব।