Entertainment

এক উজ্জ্বল অপরাজিত ইতিহাসের সমাপ্তি

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এমন একটা মাইলস্টোনের নাম যার কথা বাংলা সিনেমা জগতে চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে। তিনি একজন অভিনেতা নন, এক উজ্জ্বল ইতিহাসের নাম।

জলের ধারে দাঁড়িয়ে যে ক্ষিতদা ফাইট কোনি ফাইট বলে গলা ফাটাতেন তিনি নিজের জীবনেরও শেষ মুহুর্তটা পর্যন্ত লড়াই দিয়ে গেলেন। যে লড়াই চিকিৎসকদের পর্যন্ত উদ্বুদ্ধ করেছে। তাঁরাও উৎসাহ পেয়েছেন তাঁদের শেষ লড়াইটা দেওয়ার। তবে প্রকৃতির নিয়ম মেনে সব কিছুরই একটা সময় শেষ আছে। জীবনেরও তাই। সেই প্রকৃতির নিয়মে তাঁর লড়াই হয়তো থামল। কিন্তু তিনি রয়ে গেলেন। চিরকাল রয়ে গেলেন মানুষের মনে। রয়ে গেলেন বাঙালির স্মৃতিতে, মননে।

১৯৩৫ সালে মধ্য কলকাতার সূর্য সেন স্ট্রিটে জন্ম হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। শৈশব কেটেছে কৃষ্ণনগরে। তারপর চলে আসেন হাওড়ায়। হাওড়া জেলা স্কুলে পড়ার পর তিনি কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে বাংলা অনার্স নিয়ে স্নাতক হন। বাংলা নিয়েই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেন তিনি। সেইসময় তাঁর নাটকের প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়ে গেছে। শিশির ভাদুড়ীর নাটক তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। কার্যত সেই নাটক দেখেই তিনি অভিনেতা হওয়ার মনস্থ করে ফেলেন। সেইসঙ্গে অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে তিনি ঘোষকের কাজ করতে শুরু করেন।


সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’ সিনেমার শ্যুটিং চলার সময় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় গিয়েছিলেন শ্যুটিং দেখতে। সেখানেই সত্যজিৎ রায় তাঁকে অবাক করে অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে জানান সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ই হতে চলেছেন তাঁর অপুর সংসারের অপু। অবাক হয়ে যান সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ১৯৫৯ সালে এই ‘অপুর সংসার’ দিয়েই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সিনেমা জীবনে পা রাখা। তাঁর ডেবিউ সিনেমাতেই তিনি নজর কাড়েন। বিশেষত সত্যজিৎ রায়ের বড় পছন্দের অভিনেতা হয়ে ওঠেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার চরিত্র থেকে শুরু করে ১৪টি সিনেমায় অভিনেয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষ সিনেমা ‘গণশত্রু’।

শুধু সত্যজিৎ রায় বলেই নয়, সৌমিত্রবাবু অভিনয় করেছেন বহু সিনেমায়। মৃণাল সেন, তপন সিনহা সহ বহু পরিচালকের সঙ্গেই কাজ করেছেন তিনি। তাঁর ‘স্ত্রী’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘ঝিন্দের বন্দি’, ‘আকাশ কুসুম’, ‘তিন ভুবনের পারে’-র মত একের পর এক সিনেমা আজও মানুষের চোখে ভাসছে। চোখে ভাসছে সৌমিত্রবাবুর চরিত্র। ‘কোনি’ সিনেমায় এক সাঁতার প্রশিক্ষকের অভিনয় করে চমকে দিয়েছিলেন তিনি। ক্ষিতদার সেই চরিত্র আর তাঁর মুখে ‘ফাইট কোনি ফাইট’ আজও খেলোয়াড় থেকে সাধারণ মানুষকে শিহরিত করে, উজ্জীবিত করে।


Soumitra Chatterjee
ফাইল : নিজের শেষ জন্মদিনে কেক কাটছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ছবি – আইএএনএস

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সকলেই চেনেন এক চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসাবে। কিন্তু তিনি একাধারে ছিলেন এক নাট্যকর্মী। ছিলেন পত্রিকার সম্পাদক। ছিলেন কবি ও নাট্যকার। নাট্য পরিচালনাও করেছেন তিনি। ছিলেন একজন প্রথমসারির বাচিক শিল্পীও। সৌমিত্রবাবু অভিনীত ‘কিং লিয়ার’ নাটকটি রীতিমত হৈচৈ ফেলে দেয়। তাঁর অভিনীত নাটক ‘টিকটিকি’-ও নাম করে। এছাড়া ‘রাজকুমার’, ‘ফেরা’, ‘নীলকণ্ঠ’, ‘ঘটক বিদায়’-এর মত একের পর এক নাটকে তাঁর অভিনয় এখনও এক ঝলমলে ইতিহাস।

জীবনে অজস্র পুরস্কার পেয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ২০০৪ সালে পান পদ্মভূষণ সম্মান। এছাড়া ১৯৯৮ সালে পেয়েছিলেন সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার। ২০০৮ সালে পান সেরা অভিনেতা হিসাবে জাতীয় পুরস্কার। যদিও তার আগে অনেক সিনেমা তিনি করে ফেলেছেন। সেখানে তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে। অথচ তিনি জাতীয় পুরস্কার পাননি। এজন্য প্রকাশ্যে বেশ কয়েকবার ক্ষোভ উগরে দেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অবশেষে ‘পদক্ষেপ’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান তিনি। ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান ২০১২ সালে। এছাড়া ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান ‘লিজিয়ন অব অনার’ সম্মান পেয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

দীর্ঘ কর্মময় জীবনের বেলাশেষে এক অপরাজিতের সমাপ্তি শারীরিকভাবে হতে পারে কিন্তু মানুষের মনে তিনি চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবেন। সাক্ষাৎকারে তাঁকে বলতে শোনা গেছে তিনি চলে গেলে সঙ্গে নিয়ে যাবেন একটা গীতবিতান আর একটা আবোল তাবোল। সৌমিত্রবাবু চলে গেলেন। হয়তো যেখানে গেছেন সেখানে আরও অনেক শান্তিতে গীতবিতানের পাতাগুলো উল্টোতে শুরু করেছেন তিনি। হয়তো সেখান থেকেই দেখবেন তিনি না থাকতে পারেন কিন্তু তাঁর কাজ বাঙালি চিরকাল মনে রেখেছে। আলোচনা করছে। আনন্দিত হচ্ছে, শিহরিত হচ্ছে। মহীরুহেরা বোধহয় এমনই হন। তিনি থাকুন বা না থাকুন তাঁর অস্তিত্ব আজীবন বেঁচে থাকে তাঁকে ঘিরে থাকা মানুষগুলোর মনে, মননে।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button