রাজার পথ আটকে গ্রামে এলেন মা দুর্গা, ৩০০ বছরের বেশি পুরনো এক ইতিহাস
কিসের এত হাঙ্গামা তা জানতে রাজা এবার স্বয়ং এগিয়ে আসেন। ধর্মপ্রাণা রাজা যেই শোনেন যে মা দুর্গার কাঠামো যাচ্ছে তিনি তৎক্ষণাৎ রাস্তা ছেড়ে সরে দাঁড়ান।
বর্ধমানের সোঁয়াই গ্রাম। গ্রামটাকে আর পাঁচটা গ্রাম থেকে আলাদাই করেছে এখানকার বিখ্যাত মুখোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজো। পুজোর শুরু আজ থেকে ৩০০ বছরেরও আগে। তারও আগে এ পরিবারের দুর্গাপুজো হত। তবে তা হত বর্ধমানের ফরিদপুরে। সে ইতিহাস এখন কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। তবে যে ইতিহাস এখনও সদর্পে বেঁচে আছে তা হল মুখোপাধ্যায় বাড়ির ৩২৫ বছরেরও বেশি পুরনো দুর্গাপুজো।
সোঁয়াই গ্রামে যখন এ পুজোর সূত্রপাত হয় তখন দিল্লির মসনদে বসে আছেন ঔরঙ্গজেব। সময়টা ইংরাজি ১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দ। বাংলার ১১০০ সন। সেসময়ে বর্ধমানের সোঁয়াই গ্রামে থাকতেন মুখোপাধ্যায় পরিবারের পূর্বপুরুষ বাসুদেব মুখোপাধ্যায়। তিনি আদপে ছিলেন ফরিদপুরের মানুষ। কিন্তু টোল-এ পড়াশোনা করতে তাঁর সোঁয়াই গ্রামে আসা। তারপর এই গ্রামেরই মেয়েকে বিয়ে করে এখানে ঘরজামাই হিসাবে থাকতে শুরু করেন। এই বাসুদেব মুখোপাধ্যায় একদিন হঠাৎই স্বপ্নাদেশ পান। স্বপ্নাদেশে মা দুর্গা তাঁকে বলেন তিনি অপূজিত অবস্থায় ফরিদপুরে পড়ে আছেন। এই স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর আর সময় নষ্ট করেননি বাসুদেববাবু। তিনি তাঁর ৪ পুত্র ও পরিবারের অন্যদের নিয়ে সোজা চলে যান বাকলসার কাছে ফরিদপুরে তাঁর পৈতৃক ভিটেয়। তারপর তাঁর পারিবারিক দুর্গার কাঠামো কাঁধে করে সোঁয়াই গ্রামের দিকে পা বাড়ান।
প্রায় সোঁয়াই গ্রামের কাছে পৌঁছে গেছেন তাঁরা। সে সময়ে যে রাস্তা ধরে তাঁরা আসছিলেন সেই রাস্তার উল্টোদিক থেকে বর্ধমানের মহারাজা ভ্রমণ সেরে ফিরছিলেন। রাজা যে পথে যাবেন সেই পথ আগলে কারা এভাবে আসছে তা দেখতে রাজার পাইক, বরকন্দাজ ছোটে। তারা বাসুদেব মুখোপাধ্যায়কে রাস্তা ছেড়ে সরে দাঁড়াতে বলে। কিন্তু বাসুদেববাবু জানিয়ে দেন মায়ের কাঠামো নিয়ে তাঁরা রাস্তা ছাড়বেন না। বরং রাজা সরে দাঁড়ান। মা যাবেন। কিসের এত হাঙ্গামা তা জানতে রাজা এবার স্বয়ং এগিয়ে আসেন। ধর্মপ্রাণা রাজা যেই শোনেন যে মা দুর্গার কাঠামো যাচ্ছে তিনি তৎক্ষণাৎ রাস্তা ছেড়ে সরে দাঁড়ান।
সেখানেই শেষ নয়, এই পুজো যাতে ধুমধাম করে হতে পারে সেজন্য মুখোপাধ্যায় পরিবারকে প্রচুর জমি, পুকুর, সম্পত্তি দান করেন। সে বছরই সেই কাঠামোয় মাটি লেপে তাতে রং করে প্রতিমাকে মৃন্ময়ী রূপ দেওয়া হয়। শুরু হয় পুজো। সেই যে পুজো শুরু হয়েছে তা আজও অমলিন। এ বছর ৩২৭ বছরে পা দিল এই মুখোপাধ্যায় বাড়ির পুজো। আজও চিরাচরিত রীতি মেনে, পুরনো পারিবারিক পুঁথি মেনে হয় পুজো।
গ্রামের সকলকে নিয়ে হয় ভোগ প্রসাদ খাওয়া। পুজোর ৩ দিন গ্রামের কারও বাড়িতে কার্যত হাঁড়ি চড়ে না। এই পুজো বংশানুক্রমিকভাবে এগিয়ে চলেছে। বর্তমানে এই পুজোর ম্যানেজার বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায়। মুখোপাধ্যায় বাড়িতে পুজোর দিনগুলোয় পুজোর পাশাপাশি নানা অনুষ্ঠানও হয়। সেই অনুষ্ঠানের দায়িত্বে রয়েছেন এই পরিবারের তরুণ প্রজন্ম নিগম মুখোপাধ্যায়।
মুখোপাধ্যায় বংশের পুজো যেমন বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। তেমনই এই পুজোর প্রতিমা শিল্পী সূত্রধর পরিবারও বংশ পরম্পরায় এখানে ঠাকুর গড়ে চলেছেন। দাস বৈরাগ্য পরিবার বছরের পর বছর ডাকের সাজ সাজিয়ে আসছেন। এ পরিবারের পুজোয় প্রতিমা একচালার, ডাকের সাজের। বনেদি বাড়ির পুজোর ছাপ প্রতিমায় স্পষ্ট। পুজো যখন শুরু হয় তখন পুজো করতেন এই বংশের মানুষজনই। পরে পুজোর দায়িত্ব সোঁয়াই গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারকে দেওয়া হয়। এখনও তাঁরাই বংশ পরম্পরায় পুজোর দায়িত্ব সামলে আসছেন।
মুখোপাধ্যায় পরিবারের পুজোয় বলি আজও চলে আসছে। পুজোয় ছাগ বলি, আখ বলি তো হয়ই। সেইসঙ্গে এই পরিবারে মোষ বলির রীতি রয়েছে। এখনও প্রতি বছর মহানবমীতে মোষ বলি হয়। সেই মোষ বলির পর মোষটি নিয়ে স্থানীয় আদিবাসীরা চলে যান। এটাই চলমান রীতি। পরিবারে পুজোর ৩ দিন একটি মহাপ্রদীপ প্রজ্বলিত থাকে। যা গব্য ঘৃত দিয়ে জ্বালিয়ে রাখা হয়। প্রদীপের দীপশিখা কখনও নিষ্প্রদীপ হয়না এই ৩ দিনে। প্রতিদিন এই প্রদীপকে নিরন্তর জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব পড়ে পরিবারের এক এক জন সদস্যের ওপর। পুজো পারিবারিক হলেও পুজোয় গ্রামের সকলকে সামিল করার রীতি এ পরিবারের পূর্বপুরুষদের স্থির করা। ফলে পুজোর দিনগুলোয় সোঁয়াই গ্রাম তো বটেই এমনকি আশপাশের গ্রামের মানুষও হাজির হন এখানে। পুজো দেখেন। আরতি দেখেন। ভোগ খান। এ পরিবারে পাত পেড়ে সকলকে অন্নপ্রসাদ খাওয়ানো শত শত বছর ধরে চলে আসছে। পুজোর দিনগুলোয় সকলে মিলে একসঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠাই এর প্রধান লক্ষ্য।
মহাষষ্ঠীর দিন এই পুজো শুরু হয় কল্পারম্ভ দিয়ে। তারপর পুজোর দিনগুলোয় ষোড়শ উপচারে পুজো হয়। স্থানীয় মহাদেব মন্দির বিদ্যেশ্বর বাবার তাঁতপুকুর থেকে নবপত্রিকা স্নান করিয়ে আনা হয়। নবপত্রিকা আসে পালকিতে। মহাষ্টমীর সন্ধিপুজোয় সবচেয়ে বেশি ভিড় জমে। মহারাস নৈবেদ্য সহযোগে সন্ধিপুজো সম্পন্ন হয়। মহানবমীতে হয় মোষ, ছাগ, আখ ইত্যাদি বলি। তার আগে মহাসপ্তমী ও মহাষ্টমীতে ছাগ বলি হয়ে থাকে।
এ পুজোয় বিসর্জনেও প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। বিসর্জন হয় মুখোপাধ্যায় পরিবারের বাড়ি সংলগ্ন একটি পুকুরে। ধুমধাম করে হয় বিসর্জন। বিসর্জনের পর তুলে আনা হয় মায়ের কাঠামো। রেখে দেওয়া হয় সযত্নে। পরের বছর ফের তাতে খড় বাঁধা হয়, মাটি পড়ে, রঙের প্রলেপ পড়ে। ফের আসে পুজো। ফের মুখোপাধ্যায় পরিবার মেতে ওঠে পুজোর আনন্দে। মেতে ওঠে গোটা সোঁয়াই গ্রাম। এ অনুভূতি, এ আনন্দ বেঁচে থাকে পরম্পরার পর পরম্পরা ধরে। সময়ের সরণী বেয়ে যুগ বদলাতে থাকে। কিন্তু বদলায় না এ পরিবারের আবহমান রীতি মেনে পুজোর দিনগুলো। এমন বনেদি পুজো বাংলার বহমান ইতিহাস হয়ে বেঁচে থাকে যুগের পর যুগ।