লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট
বাংলা সিরিয়াল ও বড় পর্দার অতিপরিচিত অভিনেতার সঙ্গে বসে আড্ডা হচ্ছিল। তিনিই নিজের জীবনের এই অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন।
‘বাসে করে বেলঘড়িয়া যাচ্ছি। বাসটা ফাঁকাই ছিল। একদম পিছনের দিকের সিটে গিয়ে বসলাম। ফাঁকা বাস। ফলে সকলকেই দেখা যাচ্ছে। লক্ষ্য করলাম এক ভদ্রলোক আর এক ভদ্রমহিলা বারবার ঘুরে ঘুরে আমার দিকে দেখছেন। আর নিজেদের মধ্যে কিসব কথা বলছেন। ফের দেখছেন। তা আমায় কেউ বারবার দেখছেন। সেটা বেশ উপভোগ করছিলাম। এমন সময় ভদ্রলোক সিট ছেড়ে উঠে এসে একদম আমার পাশে এসে বসলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন ‘আচ্ছা, আপনি রাজেন না?’ বিবাহ বিভ্রাট সিরিয়ালে আমার চরিত্রের নাম ছিল রাজেন। ওনার দিকে চেয়ে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম। ব্যাস, বাসের মধ্যেই চেঁচিয়ে উঠলেন ওই ভদ্রলোক। দূরে বসা মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘বললাম না উনিই রাজেন। টাকাটা দাও।’ আসলে আমিই রাজেন কিনা তা নিয়ে ওনাদের মধ্যে বাজি হয়েছিল। বাজি জিতে এবার স্ত্রীর কাছে বাজির টাকাটা বাসের মধ্যেই চেয়ে বসলেন ওই ভদ্রলোক। জীবনে মনে রাখার মত ঘটনা যদি বলেন তাহলে এই ঘটনাটা আমি ভুলতে পারিনি’।
বাংলা সিরিয়াল ও বড় পর্দার অতি পরিচিত এক অভিনেতার সঙ্গে বসে আড্ডা হচ্ছিল। পরিভাষায় যাকে বলে সাক্ষাৎকার। তিনিই নিজের জীবনের এই অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন আমায়। ভদ্রলোকের নাম শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। এই মুহুর্তে বাংলা চলচ্চিত্র বা ছোট পর্দার প্রথমসারির অভিনেতা। মানুষের কাছে যিনি প্রধানত কৌতুক অভিনেতা হিসাবেই পরিচিত। শুভাশিসবাবু কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে কৌতুক অভিনেতা আখ্যা দিতে রাজি নন। তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ চরিত্রাভিনেতা হিসাবে পরিচিত হতে চান।
উত্তর কলকাতার দরজিপাড়ার ছিদাম মুদি লেনে বাড়ি। স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র। ফলে হাড়ে মজ্জায় টিপিক্যাল উত্তর কলকাতার ছেলে। তিনি যখন ছোট তখন চুটিয়ে চলছে পেশাদারি নাটক। চারপাশে ‘এক সে বড় কর এক’ হল। সারকারিনা, রঙ্গনা, বিশ্বরূপা, রঙমহল, বিজন থিয়েটার, মিনার্ভা থিয়েটার। দাপুটে অভিনেতা, অভিনেত্রীরা মঞ্চ কাঁপাচ্ছেন। বাবা নাটক দেখতে ভালবাসতেন। প্রায় প্রতি রবিবারই বাবা-মা’র হাত ধরে নাটক দেখেতে যাওয়ার অভ্যাস ছিল ছোট্ট শুভাশিসের। বলা যায় এই দেখতে দেখতেই নাটকের প্রতি আগ্রহ। সেই থেকেই নাটক করা শুরু।
‘স্কুলে পড়তে ক্লাস ফোর-এ প্রথম স্কুলেই নাটক করা। সেই হাতেখড়ি। তারপর ক্লাস সেভেনে পড়তে স্কুলের বাংলা স্যার গৌড়বাবু আমাকে আর আমার যে বন্ধু আমাকে হাত ধরে অভিনয় জগতে নিয়ে আসে সেই কাঞ্চনকে তাঁর নাটকের দল ‘সপ্তর্ষি’তে নাটক করার জন্য ডাকেন। বন্ধু কাঞ্চন এখন আর বেঁচে নেই। তবে সেসময়ে আমরা দু’জনে স্যারের গ্রুপে নাটক করেছিলাম। প্রশংসাও কুড়োইনি এমন নয়। সেই বয়সে আমার অভিনয় দেখে অনেকেই খুব প্রশংসা করেছিলেন। যা আমায় নাটকে আসার জন্য আরও উদ্বুদ্ধ করেছিল।’ বলে চললেন হালফিলের ডাকসাইটে অভিনেতা শুভাশিস মুখোপাধ্যায়।
‘আশির দশকের শুরুর দিক। স্কুলের দেড়শ বছর পূর্তি উৎসব। সেখানেই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্ররা মিলে একটা নাটক মঞ্চস্থ করে। সেই নাটকে আমিও অভিনয় করি। নির্দেশক ছিলেন গন্ধর্ব নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার দেবকুমার ভট্টাচার্য। দেবুদা আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘শুভাশিস তুমি পেশাদার নাটক করছ না কেন’? এদিকে আমিও তখন চাইছি কি করে পেশাদার নাটকে আসা যায়। দেবুদা তখন নাট্যব্যক্তিত্ব উজ্জ্বল সেনগুপ্তর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। উজ্জ্বলদা আমাকে নিয়ে যান শ্রাবন্তি মজুমদারের কাছে। সেই আমার পেশাদার নাটকের জগতে ঢুকে পড়া’।
‘একবার জগন্নাথ বসুর নির্দেশনায় একটা নাটক করছি। সেই সময় জগন্নাথদা অল ইন্ডিয়া রেডিওর একজন স্তম্ভ। জগন্নাথদার সেই নাটক দেখতে এসেছিলেন সেসময়ে আকাশবাণীর নামকরা নাট্য প্রযোজিকা শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায়। নাটকে আমার অভিনয় দেখে তিনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি রেডিওয় অভিনয় কর না কেন’? তারপর উনিই জগন্নাথদাকে বলেন, ‘একি, তোমার স্কুলের ছেলে, ও রেডিওতে অভিনয় করছে না কেন? ওকে রেডিওতে নিয়ে নাও।’ জগন্নাথদা তখন আমায় আসতে বলেন। অডিশনের একটা ফর্ম তুলে জমা দিই। নির্বাচিতও হই। এভাবেই আমার রেডিও জগতে প্রবেশ করা’।
‘তখনকার দিনে অভিনয়ে তেমন টাকা ছিল না। তাই বাড়ি থেকে পড়া ছেড়ে অভিনয় কর একথা কখনই বলতে পারত না। তবে বাবার অনুপ্রেরণা ছিল। বাবা চাইতেন আমি অভিনয় করি। বাবা আমার নাটকও দেখতে আসতেন। তবে চাইতেন পড়াশোনাটা করেই নাটক করি। নিজে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলেন। হয়তো চেয়েছিলেন তাঁর পেশায় যাই। কিন্তু সত্যি বলতে কি আমি তেমন পড়াশোনা করতাম না। তার চেয়ে খেলতে বা নাটক করতে আমার অনেক বেশি ভাল লাগত।’ অকপটে বললেন শুভাশিস।
কথায় কথায় খেলার কথা আসতে বেশ নড়েচড়ে বসলেন তিনি। ‘ফুটবল, হকি, বাস্কেটবল, সব খেলতাম। একসময়ে চেয়েছিলাম ফুটবলার হতে। সেই সময় ফুটবল খেলতে গিয়ে হাঁটুতে চোট পাই। সেই চোটই আমার মাথা থেকে ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছাটা উড়িয়ে দিল। হয়তো আমার ভাগ্যই আমাকে এই চোট দিয়ে ফুটবল থেকে সরিয়ে নাটকে পুরোপুরি মনঃসংযোগটা করিয়ে দিয়েছিল। তবে এখনও ফুটবলটা ভালোবাসি। যদি কেউ আমাকে একটা ফুটবলার বা কোনও খেলোয়াড়ের চরিত্র দেন তাহলে আমি খুব খুশি হব। অন্তত অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে নিজের শখটা তো মেটানো যাবে’!
এই মুহুর্তে শুভাশিস মুখোপাধ্যায় মানেই বাংলা সিনেমা বা সিরিয়ালের নামকরা কৌতুক অভিনেতা। তবে এই তকমায় একেবারেই খুশি নন শুভাশিস। বরং সব ধরণের চরিত্রেই অভিনয় করতে চান তিনি। নিজেই বললেন, ‘আমার অপূর্ণ ইচ্ছা যদি বলেন তাহলে সেটা ওই বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করা। আরও ভাল চরিত্র। অন্য ধারার ছবি।’ কোনও নির্দেশক তেমন একটা সুযোগ দিলে তিনি যে সত্যিই খুশি হবেন তা তাঁর মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম।
১৯৮১ সালে প্রথম বাংলা ছবিতে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে বড় পর্দায় হাতেখড়ি। ১৯৮৬তে ‘অভিনন্দন ভগীরথ’ নামে একটি সিরিয়ালের মধ্যে দিয়ে টিভির জগতে পা। দ্বিতীয় সিরিয়াল ১৯৮৭তে বন্ধু রাজা সেনের ‘সুবর্ণলতা।’ তারপর সুযোগ ‘লম্বকর্ণপালা’ সিরিয়ালে। তবে শুভাশিস মুখোপাধ্যায় দর্শকদের ঠিকঠাক নজরে পড়েন ‘বিবাহ বিভ্রাট’ সিরিয়ালে রাজেনের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য। সেই যে ‘কমেডিয়ান’ ছাপটা পড়ে গেল তা থেকে বেরনোর সুযোগ কোনও পরিচালক তাঁকে আর দেননি। বরং সন্দীপ রায় তাঁকে কখনও কমেডি চরিত্রে অভিনয় করাননি বলে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করলেন শুভাশিস। তবে সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ চিত্র পরিচালক স্বপন সাহার প্রতি। শুভাশিস জানালেন, এখনও পর্যন্ত পঞ্চাশটারও বেশি সিনেমায় তাঁকে সুযোগ দিয়েছেন স্বপনবাবু।
সিনেমা, সিরিয়াল করলেও নাটকটাই এখনও সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম তাঁর কাছে। তবে পেশাগত নাটক ব্যাপারটা বিদায় নেওয়ায় এখন আর নাটকে অভিনয় করা হয় না। যাত্রা করেন। শুভাশিসের নিজের কথায় যাত্রা করলে দুটো জিনিস হয়। এক, মঞ্চে অভিনয় করার খিদেটা মেটানো যায়। আর দুই, যাত্রায় অভিনয় করলে মোটা টাকা পারিশ্রমিক পাওয়া যায়। সেটাও তো ফেলে দেওয়া যায়না।
শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য তাঁর বাড়িতে ঢুকেই যেটা নজর কেড়েছিল তা হল গৃহসজ্জা। ঘরের কোনা থেকে দেওয়াল সর্বত্র মাদুর, বাঁশ, পটচিত্রের মত বিভিন্ন গ্রাম বাংলার শিল্প দিয়ে সাজানো। কথাটা জিজ্ঞেস করেই ফেললাম। এমন গৃহসজ্জা সাধারণত কারও বাড়িতে দেখা যায় না। এমন এক গৃহসজ্জার ভাবনা এল কোথা থেকে? এজন্য স্ত্রীকে একশোয় একশো দশ নম্বর দিলেন শুভাশিস। অকপটে স্বীকার করলেন, এসবই তাঁর স্ত্রীর ভাবনা। স্ত্রী ঈশিতা ভীষণভাবে পুরনো সাজসজ্জা পছন্দ করেন। মূলত তাঁর ইচ্ছাতেই সব কিছু। তা আপনার বিয়েটা কেমনভাবে হল? লাভ ম্যারেজ? ফের নড়ে চড়ে বসলেন শুভাশিস। ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’ যাকে বলে আমার ঠিক তাই। ১৯৮২-৮৩ সাল। আমি তখন চেতলার একটা নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। আমার স্ত্রী ঈশিতার তখন নিজের একটা নাটকের দল ছিল ‘উষ্ণিক।’ ওরা মূলত ম্যাক্সমুলার ভবনে নাটক মঞ্চস্থ করত। ওখানে গ্রিন রুমে ওকে প্রথমবার দেখার পরই ভাল লেগে যায়। তারপরই হঠাৎ কাছে আসার সুযোগটা পেয়ে গেলাম। আমার এক বন্ধু শুভ ঈশিতাকে চিনত। শুভ আমাকে বলল ঈশিতা ওর পরবর্তী নাটকের মূল চরিত্রের জন্য একজন অভিনেতা খুঁজছে। কিন্তু যেটা মুশকিল করল সেটা হল ও ঈশিতাকে বলেছিল তোমার পছন্দ হলেও শুভাশিস কিন্তু টাকা ছাড়া কোনও কাজ করেনা। আমি মনে মনে ভাবলাম যার কাছে আসার চেষ্টা করছি তাকেই টাকার কথা বলে মহামুশকিল করল শুভ। যাই হোক আমাকে দেখে ঈশিতার পছন্দ হল। আমি ঈশিতার ‘ঘর’ নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করলাম। নাটকের পর একশো টাকা পারিশ্রমিকও দিয়েছিল ঈশিতা। সে টাকা তখন নিতেও হয়েছিল। এরপর ঘনিষ্ঠতা বাড়ল। দু’জনে তখন সেলসের চাকরি করতাম। চেতলার একটা দোকানের কাছে দু’জনে কাজ সেরে দেখা করে একসঙ্গে ফিরতাম। আমার বাড়িতে ওকে মেনে নেওয়ায় আপত্তি ছিল। তবে ওর বাড়ি থেকে সাপোর্ট পেয়েছি। বিশেষত ওর মা, মানে আমার শাশুড়ি আমায় খুব ভালবাসতেন। তবে আমাদের বিয়েটা পালিয়ে গিয়ে। ওকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করি। তারপর আর কী। এখন সুখে সংসার করছি।’ কথা শেষ করে মুচকি হাসলেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম নক্ষত্র শুভাশিস মুখোপাধ্যায়।