মাত্র ১৮ বছরে ১৪টি সন্তান, মৃত্যুর পর কোথায় হল স্থান
সংসারজীবন মাত্র ১৮ বছরের। এরই মধ্যে তিনি ১৪টি সন্তানের জননী হন। শেষ সন্তান প্রসবের সময়েই মারা গেলেন। শোকার্ত স্বামী তৈরি করলেন দুর্লভ কীর্তি।
”এই সৌধ সম্পর্কে কী ভাবছি তা জিজ্ঞাসা করছ তো, কিন্তু এই সৌধ সম্পর্কে সমালোচনা কীভাবে করব তা আমি নিজেই জানিনা। এর সম্পর্কে আমার অনুভূতির কথা বলতে পারি। আমার দেহের উপরে এইরকম সৌধ যদি করে দেওয়া হয় তাহলে আমি কালকেই মরতে চাই।”
তাজমহল দেখার পর স্লিম্যান-পত্নীর এ মন্তব্যের কথা বিখ্যাত ঐতিহাসিক মেজর জেনারেল স্লিম্যান (Sleeman) লিখেছেন তাঁর ‘Rambles and Recollections’ গ্রন্থে।
তাজমহল মানেই আর্জুমান বানু বেগম। নুর জাহানের ভ্রাতুষ্পুত্রী, তবে এই নাম পরিবর্তন করেছিলেন বাদশা শাহজাহান। প্রেয়সীর নাম রেখেছিলেন মমতাজ মহল। তাজমহল তাঁরই সমাধি স্মৃতিসৌধ। শহর আগ্রা থেকে দেড় কিমি দূরে রুগ্না সুন্দরী যমুনার দক্ষিণ তীরেই এর অবস্থান। শাহজাহান উনিশের আর্জুমানকে বিয়ে করেন ১৬১২খ্রিস্টাব্দে। মমতাজের চেয়ে মাত্র দু-বছরের বড় ছিলেন বাদশা। দরিদ্রের প্রতি দয়া, সুকোমল ব্যবহার, সৌন্দর্য, অপরূপ লাবণ্য আর বাদশার প্রতি মমতাজের আন্তরিকতাই তাঁকে একান্ত অন্তরের করে তুলেছিলেন শাহজাহানের।
মমতাজের সংসার-জীবন মাত্র ১৮ বছরের। এরই মধ্যে তিনি ১৪টি সন্তানের জননী হন। শেষ সন্তান (যিনি গহরা বেগম নামে সুপরিচিত) প্রসবের সময়েই মারা গেলেন। মমতাজের মৃত্যুর পর দুঃখ শোকে মুহ্যমান বাদশার সমস্ত চুল-দাড়ি পেকে গিয়েছিল অল্প কয়েকদিনের মধ্যে। শাহজাহান এত ব্যথিত হয়েছিলেন যে, সাময়িকভাবে রাজপোশাক পরিত্যাগ করেছিলেন। বন্ধ করেছিলেন রাজদরবারে যাওয়া। আর শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল গোটা মোঘল সাম্রাজ্যের প্রজারা। মমতাজ দেহরক্ষা করেন দাক্ষিণাত্যের বারহানপুরে। সেই কারণে তাঁকে সাময়িকভাবে সমাহিত করা হয় তাপ্তি নদীর তীরে জেনাবাদ-এ। এর মাস ছয়েক পরে যুবরাজ সুজার তত্ত্বাবধানে মরদেহ তুলে এনে আবার সমাহিত করা হয় আগ্রায়, জয়পুরের রাজা মানসিংহের বাগানে।
সমকালীন রচনা ‘দেওয়ান-ই-আফ্রিদি’ গ্রন্থের মতে কালজয়ী মর্মর সৌধ তাজমহল নির্মাণ করতে অসংখ্য গুণী শিল্পীর সাহায্য নিয়েছিলেন বাদশা। ভারতবর্ষ ছাড়াও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্থপতি ও শিল্পীদের। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, প্রাণ প্রিয়তমার স্মৃতিতে এমন একটা স্মৃতিসৌধ গড়ে তুলতে হবে যেটি সারা বিশ্বে হয়ে থাকবে চিরস্মরণীয়। বহু প্রথিতযশা স্থপতির কাছ থেকে এল নানা ধরনের, নানা রূপের পরিকল্পনা। সবশেষে শিল্পী ইসফান দিয়ার রুমির তাজমহলের পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হল।
ইন্দো-পারসিক শিল্প ধারার শ্রেষ্ঠ ফসল তাজমহল। এর প্রকৃত নকশাটি করেন পারস্যের শিরাজবাসী ওস্তাদ ইসা। শিল্পী ইসা ছিলেন তাজমহল নির্মাণের প্রধান স্থপতি। স্পেনদেশীয় পর্যটক ফাদার সেবাস্টিয়ান মানরিখের মতে, তাজমহলের নকশা তৈরি করেছেন জনৈক ভেনিশিয় স্থপতি জেরোনিমো ভেরেনিও। একটা কথা বলে রাখি, তাজমহল নির্মাণের এই বিশাল কর্মযজ্ঞের অনেক বিষয় নিয়েই ঐতিহাসিকদের নানা মত আছে, মতভেদও আছে নানা গ্রন্থে।
এবার সমাধি-সৌধ নির্মাণে শিল্পী কারিগরদের মধ্যে বিশেষ বিশেষ কাজের দায়িত্বে থাকা কিছু ব্যক্তির কথা, যাঁরা বাদশা আমন্ত্রিত, তাজের কাজে এসেছিল দেশ- বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে। বন্ধনীতে তাদের মাসিক বেতনের কথাও উল্লেখিত হল এখানে।
মণিমুক্তা উৎকীর্ণকারীদের মধ্যে আছেন মুলতানের চিন্তামণি (২৯২), বংশীধর (২৪৪), হিরামণি (২৩৪), মনোহর সিং (২০০), মোহন লাল (২০০), শিবাজী লাল (৩৪২), মনোহর দাস (২৯৫), বসহরত আলি (৬৩২), ভগবান দাস (৬৩০), ছোটে লাল (৬০০), দিল্লির যমুনা দাস (৬০০), আবু মহম্মদ (৫০০), মহম্মদ ইউসুফ খান (৬০০), লাহোরের মাধো রাম (২৫৩), মন্নুলাল (৬৮০) প্রমুখ।
তুরস্কের মহম্মদ ইসা আফাদি (১০০০) ছিলেন নকশা আঁকিয়ে। মহম্মদ শরিফ সমরখন্দ (১০০০) ছিলেন তাজমহলের পরিকল্পক, ইসমাইল অফিউদি (৫০০) গম্বুজ নির্মাতা। আরবের কাদির জিমন খান (৮০০) সাধারণ শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম।
রাজমিস্ত্রিদের তত্ত্বাবধায়ক মহম্মদ হানিফ আকবরাবাদ মহম্মদ (১০০০) ছিলেন আগ্রাবাসী। দিল্লির রাজমিস্ত্রি আবদুল্লাহ (৬৭৫), মহম্মদ সাহিব (৫০০), মুলতানের আবুতুবুর খান (৫০০), বালখ-এর মহম্মদ সোজ্জাক প্রমুখ।
সুন্দর হস্তাক্ষরবিদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সিরিয়ার রোখন খান (৪০০), পারস্যের ওয়াব খান (৬০০), মুলতানের আবদুল গফফর (৬০০), বাগদাদের মহম্মদ খান (৫০০), এবং তুরস্কের সাত্তার খান (১০০০) প্রমুখ।
বুখারার আরা মহম্মদ (৫০০) ছিলেন বিশিষ্ট ভাস্কর। পুষ্পসজ্জক মুলতানের আমির আলি (৬০০), রঙিন মর্মরপ্রস্তর কাচ প্রভৃতির টুকরো জোড়া দিয়ে অলংকৃতকারী শিল্পী দিল্লির চিরণজিলাল (৮৮০) এবং মুলতানের পুষ্পসজ্জা বিশেষজ্ঞ ছিলেন বলদেব দাস (৫৯০), তাজ নির্মাণে এঁদের অবদান আজও মনে রাখার মতো।
তাজমহলের অভ্যন্তরীণ অলংকরণ করেন মুলতান ও কনৌজের শিল্পীরা। সৌধের দেয়ালে কোরানের বাণীগুলি নিখুঁতভাবে খোদাই করেন কান্দাহারের বাসিন্দা আমানত খাঁ মিরাজি। ‘বারোখ’ শৈলীর স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন দেখা যায় তাজমহলে। ঐতিহাসিকদের অনুমান, সমাধি-সৌধের গম্বুজের কাজে প্রধান শিল্পী ছিলেন কনস্ট্যান্টিনোপল থেকে আসা ইসমাইল খাঁ রুমিই।
বিস্ময়কর এই সৌধ নির্মাণের জন্য এদেশের নানা প্রদেশের রাজা মহারাজা এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ- প্রধানদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল সোনা রুপো, নানান ধরনের রত্ন, পাথর ও দ্রব্যসামগ্রী। এইগুলির মধ্যে আছে সর্বোৎকৃষ্ট, নীলা,পান্না, চুনি, হীরা, প্রবাল, মুক্তা, ফিরোজাসহ প্রায় ৪৩ রকমের পাথর ও রত্ন।
ভারতের জয়পুর, ফতেপুর সিক্রি, গোয়ালিয়র, জবলপুর, জয়সলমির, হায়দ্রাবাদ, কুমায়ুন, সুরাটের মতো অসংখ্য জায়গা ছাড়াও বাগদাদ, তিব্বত, সিংহল, রাশিয়া, আরব প্রভৃতি দেশ থেকে তাজ নির্মাণের জন্য কেনা হয়েছিল পাথরগুলি।
নানা ধরনের অত্যন্ত মূল্যবান পাথর রত্ন আর দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে শুরু হয় তাজ নির্মাণের কাজ। ২০হাজার শিল্পী ও শ্রমিকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় লাগাতার পরিশ্রমে ১২বছর ৬ মাসের মধ্যে গড়ে ওঠে বিশ্বের বিস্ময়কর সমাধি-সৌধ তাজমহল। শ্রমিকদের থাকার জন্য তাজগঞ্জ নামে একটি কলোনি হয়েছিল আগ্রায়। মমতাজের মৃত্যুর এক বছর পরে, ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় সৌধ নির্মাণের কাজ, তাজমহলকে ঘিরে অন্যান্য আরও সমস্ত কাজ শেষ হতে ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দ গড়িয়ে যায়।
এই সৌধ নির্মাণের কাজে জোর করে কাউকেই নিয়োগ করেননি শাহজাহান। কোনও শ্রমিককে তার প্রাপ্য পারিশ্রমিকের একটি পয়সাও কম দেননি। রাজকোষ পূর্ণ থাকা সত্ত্বেও ত্রিশটি গ্রাম থেকে বাৎসরিক আদায় করা রাজস্ব ৩০ লক্ষ টাকা তিনি শুধু ব্যয় করতেন তাজমহল নির্মাণে। এর নির্মাণ ব্যয় হয় ১, ৮৪, ৬৫, ১৩৬ টাকা। এনিয়ে মতভেদ আছে। পাদিশাহ নামাতে উল্লিখিত হয়েছে ৫০ লক্ষ টাকা। আবার কারও মতে ৪, ১১, ৪৮, ৮২৬ টাকা ৭ আনা ৬ পাই। ট্যাভার্নিয়ের মতে, ২২ বছর ধরে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে এই সৌধ।
জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রাচ্যের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা বুকের রক্ত উজাড় করে দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করে গড়ে তোলেন এই কালজয়ী সৌধ। ‘বাদশানামা’ গ্রন্থে আব্দুল হামিদ লাহোরি লিখেছেন, “দেশের নানা প্রান্তের সর্বোত্তম দক্ষ শিল্পী এবং তাদর সহযোগীরা প্রত্যেকেই তাদের সবটুকু দক্ষতা নিংড়ে দিয়েছেন তাজমহলকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করার জন্য।”
যাক্, কাজ তো শেষ হল। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এবার প্রাণপ্রিয়ার স্মৃতি সমাধি-সৌধ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়লেন শাহজাহান। এখানে একটি জনশ্রুতি আছে। বাদশা জানতে পারলেন, তাজমহল নির্মাণের জন্য সৌধ এলাকায় বাঁশ, কাঠের মঞ্চ আর নানান অজস্র দ্রব্য সামগ্রীতে পূর্ণ হয়ে আছে। ওই বিশাল পরিমাণ জিনিস সরাতে গেলে যেমন প্রচুর অর্থ ব্যয় হবে তেমনই লেগে যাবে কয়েক মাস সময়। চিন্তায় উদ্বিগ্ন হলেন সম্রাট। পরামর্শ করলেন সভাসদদের সঙ্গে। সমস্যা সমাধানের পথ বাতলে দিলেন প্রধানমন্ত্রী। বাদশা ঘোষণা করলেন, সমস্ত নগরবাসী ওইগুলি নিজেদের প্রয়োজনে নিয়ে যেতে পারে বিনা পয়সায়। ব্যস, একদিনেই সাফ হয়ে গেল গোটা তাজ এলাকা। খুশি হলেন বাদশা। চলে গেলেন একান্ত আপনজনের সমাধি-সৌধ দেখতে। দেখে হতবাক হলেন বিস্ময়ে।
সৌধ দর্শনে যেতে প্রধান ও পশ্চিমদ্বারটি সর্বসাধারণের প্রবেশদ্বার। এটি আগ্রা শহর এবং ক্যান্টনমেন্ট মুখী। বিশাল দ্বার। এর বাইরে লাল বেলে পাথরের ফতেপুরি মসজিদ। ফতেপুরি বেগম ছিলেন শাহজাহানের স্ত্রীদের মধ্যে অন্যতম। এটি তারই স্মৃতিতে নির্মাণ করেন বাদশা।
প্রবেশদ্বারের বাঁ দিকেই সতলুন্নিসা খাদানের কবর। সাদা পাথরে নির্মিত। নিঃসন্তান খাদান ছিলেন মমতাজ বেগমের অত্যন্ত প্রিয় ও অনুগত, রাজকুমারী জাহানআরা-বেগমেরও। ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে সতলুন্নিসা মারা যান। লাহোরে। সেখানে তাঁকে সমাধি দেওয়া হয়। ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে বাদশা তাঁর মরদেহ আগ্রায় এনে আবার তাকে সমাহিত করেন এখানে।
তাজ দর্শনে যাওয়ার আরও দুটি দ্বার পূর্ব ও দক্ষিণে, পূর্বদ্বারের কাছে শাহজাহানের স্ত্রীদের মধ্যে আর একজন শিরহিন্দি বেগমের, আর দক্ষিণদ্বারের ডান পাশে রয়েছে মমতাজের এক প্রিয়সঙ্গিনীর স্মৃতি-সমাধি। লাল বেলে পাথরে নির্মিত। মোট তিনটি দ্বারই মোঘল স্থাপত্যের এক অনবদ্য উদাহরণ।
প্রধান প্রবেশদ্বারের পরেই বিশাল চাতাল। বাদশার আমলে এখানে ছিল রাজকীয় সরাইখানা, বাজারও বসত। একটু এগোলেই তাজ গেট। এর প্রবেশ মুখের বাঁ- পাশে একটি পাথরে খোদিত ভাষাটি এই,
“The Tajmahal was built between 1631 and 1653 by Emperor Shah Jahan (1627-1658) as the Tomb for his wife Arjumand better known as Mumtaz Mahal, “Ornament of the place” born in 1592, the daughter of Asaf khan, she married Shah jahan in 1612 and died in 1631. After his death the Emperor was buried by her side.”
তিনতলা বিশিষ্ট তাজগেটটি লাল বেলে পাথরে নির্মিত। উচ্চতায় ২১১ ফুট এবং চওড়া ৩৬ ফুট। সারাটা গা কোরানের বাণীতে ভরা। মোঘল আমলে তোরণের পাল্লাটি নির্মিত হয়েছিল রুপো দিয়ে। তখন আনুমানিক মূল্য ছিল ১,২৭,০০০ টাকা। এর গায়ে বসানো রুপোর ১১০০ পেরেকের প্রত্যেকটির মাথায় ছিল নানান ধরনের মুদ্রা। মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর জাঠেরা তাদের রাজত্বকালে খুলে নেয়। পরে নির্মিত হয় পিতলে। তাজে যাওয়ার এই প্রবেশদ্বারটি একটি আটকোনা বিশিষ্ট ঘর।
প্রত্যেকটি কোণে রয়েছে ছোট ছোট বিশ্রামাগার। উপরে যাওয়ার সিঁড়িও আছে। একেবারে উপরটি শোভিত ২২টি মিনার এবং চারটি স্তম্ভে। মোট ২২বছরে তাজমহল সহ পারিপার্শ্বিক সমস্ত কিছু নির্মিত হয়েছিল তাই ২২টি মিনার এখানে বছরের নির্দেশ করে। মিনার বছরের হিসাব বলে দেয়।
প্রবেশদ্বারে কালো রং করা ছাদের মাঝখানের লন্ঠনটি পিতলের এটি পারসিক শিল্পের অনুকরণে তৈরি। লর্ড কার্জন ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সংগ্রহ করেন পারস্য থেকে। দান করেন এখানে। তৎকালীন এটির মূল্য ছিল ৩৫০ পাউন্ড।
তাজ গেট পেরিয়ে ভিতরে বাঁ-দিকে তাজ মিউজিয়াম। গেটের ঠিক মাঝখানে দাঁড়ালে সামনেই চারকোনা বিস্তৃত সাজানো বাগান। এখান থেকে সোজা চলে গিয়েছে সাড়ে দশ ফুট চওড়া একটি বাঁধানো খালের মতো। এর দুপাশে হাঁটা পথ। এ পথের দুধারে লাইন দিয়ে দেবদারু আর সাইপ্রাস। তাজগেট ও তাজমহলের মাঝামাঝি রয়েছে জলে ভরা একটি জলাধার। পাঁচ ফুট গভীর। তাজগেটের সামনেও রয়েছে একটি। সুন্দর নিখুঁত দূরত্বের এই জলাধারটিতে সুন্দরভাবে দেখা যায় তাজমহলের প্রতিবিম্ব।
মোঘলযুগে তাজগেট থেকে স্মৃতি-সৌধ পর্যন্ত অসংখ্য ঝরনার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল যমুনার। এখন আর নেই। সমগ্র এই তাজ উদ্যানের পরিকল্পনা করেছিলেন শাহজাহানের মোঘল দরবারের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব আলি মর্দান খান। কাশ্মীরের হিন্দু বাগিচা- বিশারদ রণমল তৈরি করেছেন বাগিচা।
এক সময় তাজ এবং তার পারিপার্শ্বিক সামগ্রিক পরিকল্পনা দেখে অভিভূত বিয়ার্ড টেলার (Beyard)বলেছিলেন।
“ভারতে আর যদি কিছু দেখার না থাকে তাহলে এই তাজ একাই যাতায়াত খরচ পুষিয়ে দেবে। দূর থেকে দেখা তাজমহল আমাকে এতই মোহিত করেছিল যে, এর বিশ্বজোড়া খ্যাতি সত্যিই যুক্তিযুক্ত। এটা এতই পবিত্র এবং এত অপরূপ যে, আমি কাছে যেতেই ভয় পেতাম। যদি কাছে গেলে আমার স্মৃতিকোঠায় জমে থাকা অনুভূতি চিড় খায়।”
তাজের দিকে যেতে পথের দুপাশ গাঢ় সবুজের অ্যাপরনে মোড়া। সামনেই দাঁড়িয়ে যেন জমানো দুধের বিশাল মণ্ডপ। রূপসি তাজমহল। একদা এরই রূপে মুগ্ধ হয়ে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের সদস্য স্যামুয়েল স্মিথ (Samual Smith) তাঁর ‘My life work’ গ্রন্থে লিখেছেন,
“সমাধি স্মৃতিসৌধের সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। এটি যেন আগের তৈরি সমস্ত প্রাচীন স্থাপত্যকে মলিন করে দিয়েছে রুপে।…. দেখে মনে হয়, হাতির শুভ্র দাঁত দিয়ে তৈরি করা একটি সাদা মন্দির। এর দেয়ালের গায়ে নিখুঁত কারুকার্য ও অঙ্গসজ্জা দেখে স্থাপত্য বলে মনে হয় না, দেখে মনে হয় যেন স্বর্গের কোনও অপরূপ বস্তু।”…….
তাজমহলের দোরগোড়ায় দু-পাশেই ওঠার সিঁড়ি। বিশাল সৌধ চত্বরের চারটি কোণে ১৪০ ফুট উঁচু চারটি গোলাকৃতি মিনার। প্রত্যেকটি মিনারে তিনটি করে গ্যালারি, ১৬৮টি করে সিঁড়ি। একেবারে উপরের গ্যালারিতে ৮টি করে জানলা। এই মিনারগুলির কারিগরি কৌশল এমনই বিস্ময়কর, কখনও কোনও ভাবে ভেঙে পড়লে তা বাইরেই পড়বে, সৌধের উপরে নয়।
সৌধ তাজের প্রবেশ দ্বারে খোদাই করা আছে কোরানের ৮৯টি অধ্যায়। এই অংশটির নাম আলফারজ। এর সুন্দর অর্থ, ‘রাতের অন্ধকার ভেঙে সকালের শুরু।’
দেশ-বিদেশের রঙবেরঙের ৩৫ রকমের মূল্যবান পাথর ব্যবহৃত হয়েছে তাজের অঙ্গসজ্জায়, কারুকার্যে। একদা সমাধি স্মৃতি-সৌধ দেখে বিমুগ্ধ ফরাসি বিশপের অলংকৃত মন্তব্য,
“কোনও বর্ণনা সেটা বিস্তারিতই হোক বা পুঙ্খানুপুঙ্খই হোক কোনও রং সেটা যত উজ্জ্বলই হোক বা মহান শিল্পীর তুলিতে আঁকা হোক, কোনওমতেই তাজের অসাধারণত্ব প্রকাশ করতে পারে না। এটি পূর্ব বিশ্বের স্থাপত্য শিল্পের এক অভূতপূর্ব, অবিস্মরণীয়, অকল্পনীয়, অবর্ণনীয়, অতুলনীয় এক সৃষ্টি।”
তাজের ভিতরে, ঠিক মাঝখানে মমতাজের সমাধিক্ষেত্র। এখানেই সর্বশেষ সমাহিত করা হয় বেগমকে। সমাধিক্ষেত্রের শান্তি ও সুরক্ষার জন্য নিচের মূল সমাধির উপরে অনুরূপ একটি কবর শোভিত। মূল কবরটি লম্বায় সাড়ে দশ ফুট, চওড়ায় সাড়ে ছয় ফুট আর উচ্চতায় দেড় ফুট। এটির অবস্থান একটু উঁচু সমতল বাঁধানো স্থানের উপরে। সমাধি-স্মৃতি ফলকে কালো অক্ষরে লেখা আছে,
“এই সমাধিটি আর্জুমান বানু বেগমের যিনি মমতাজ মমতাজ মহল নামে পরিচিত। তিনি মারা যান হিজরী ১০৪০ (১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে)। স্বর্গের দেবদূতরা তাঁকে সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্য নেমে এসেছিলেন এবং তাঁরা মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন, মমতাজের আসন চিরকালই স্বর্গে থাকবে।”
বাদশা শাহজাহান আন্তরিকভাবে ভালো বেসেছিলেন মমতাজকে। তাই মৃত্যুর পরেও কেউ কাউকে ছেড়ে থাকেননি। তাঁর নশ্বর দেহও স্থান পেয়েছে প্রিয়তমা বেগমেরই পাশে, পশ্চিমে মাত্র পাঁচ ইঞ্চির ব্যবধানে। লম্বায় সাড়ে ১১, চওড়ায় সাড়ে ৭ আর উচ্চতায় ২ ফুট এই সমাধি-স্মৃতি ফলকের গায়ে লেখা আছে,
“রাজকীয় আড়ম্বরপূর্ণ এই সমাধি যাঁর, তিনি স্বর্গে নিশ্চয়ই স্থান পাবেন। নক্ষত্রপুঞ্জ চিরকাল সেখানে বিকশিত হয়ে থাকবে। রাজব মাসের ২৮ তারিখে হিজরী ১০৭৬ (১৬৬৬খ্রিস্টাব্দ) তিনি রাত্রিবেলায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।”
মোঘল বাদশার গভীর পত্নীপ্রেমের প্রস্ফুটিত ফুলই তাজমহল। কবির কথায়, এই সৌধ হল, “মার্বেলে তৈরি প্রেমের শোক-সংগীত।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “এটি হল সম্রাটের দুঃখবিগলিত হৃদয় থেকে নিঃসারিত ‘অশ্রু বিন্দু’।”
এই সমাধিক্ষেত্রের চারপাশে বিস্ময়কর সূক্ষ্ম কারুমত শ্বেত পাথরের জাফরি। এমনভাবে নির্মিত জালির পর্দা, তার ভিতরে দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ে পাশাপাশি শুয়ে থাকা বাদশা বেগমের সমাধিতে। প্রথমে শাহজাহান এটি নির্মাণ করেছিলেন রুপোর উপরে মণিমুক্তা বসিয়ে। তৎকালীন ব্যয় হয় ৬ লক্ষ টাকা। পরে, ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে অতুলনীয় পাথরের বর্তমান জাফরিটি বসান সম্রাট ঔরঙ্গজেব। এটি নির্মাণ করতে সময় লাগে সাত- মতান্তরে দশ বছর। ব্যয় হয় ৫০ হাজার টাকা।
লর্ড রবার্ট (Lord Robert) তাজমহল সম্বন্ধে তাঁর ‘Forty one years in India’ গ্রন্থে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন, এইভাবে,
“যেটা অবর্ণনীয় সেটা আমি বর্ণনা করতে যাব না। কোনও শব্দ, কোনও লেখনীই কোনও মতেই পাঠকের কল্পনাপ্রবণ মনকে তাজমহলের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য এবং তার স্রষ্টার পবিত্র কল্পনা সম্বন্ধে সঠিক রূপ দিতে পারবে না।”
সৌধ তাজের মূল গম্বুজের মাঝখানে রয়েছে একটি আংটা। এতে কারুকার্য ভরা একটি মূল্যবান ঝাড় লন্ঠন লাগিয়েছিলেন শাহজাহান। পরবর্তীকালে সেটি লুট করে নিয়ে আসে জাঠেরা। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ব্রোঞ্জের একটি লন্ঠনে আংটাটি সুশোভিত করেন লর্ড কার্জন।
মিশরের পিরামিড দুবার দেখার পর তাজমহল তৈরির ৫০ বছরের মধ্যে ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ার (Barnier) তাজ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, “বিশ্বের আশ্চর্যতম মিশরের পিরামিডের চেয়েও তাজমহল অনেক বেশি করে মনে রাখার মতো।”
ভারতীয় এবং পারসিক স্থাপত্যের যৌথ শিল্প-কলার এক নির্বাক প্রকাশ এই তাজমহল। সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে সূক্ষ্ম শিল্প নির্যাস আর অসাধারণত্বের এক লোমহর্ষক বিস্ময় হিসাবে নিজেকে সাড়ম্বরে রাজকীয় মর্যাদায় প্রকাশ করতে পেরেছে। মহিমময় তাজ, স্মরণীয় করে রাখতে পেরেছে মোঘল সাম্রাজ্যের অধিশ্বর ও তাঁর প্রেমকে, আজও। এখানেই বাদশা শাহজাহান সার্থক, সার্থক তাঁর দুর্লভ প্রচেষ্টার রূপায়ণ।
তাজমহল এমনই এক স্মৃতি-সৌধ, যেখানে উৎসর্গিত হয়েছে মোঘল বাদশার হৃদয়মথিত প্রেম। তাজমহল, এ এমনই এক দুর্লভ কীর্তি, যারা শিল্পরসকলা আর রূপ বর্ণনার কোনও ভাষা খুঁজে পায়নি পৃথিবীর কোন মানুষ। সৌন্দর্যের অদম্য গতি যেন আপন সৌধে অবরুদ্ধ করে দিয়েছে তাজ। সেই জন্যেই তো বিখ্যাত পর্যটক অস্কার ব্রাউনিং (Oscar Browning) এমন স্মরণীয় মন্তব্য করেছিলেন মমতাজের সমাধি স্মৃতি-সৌধ দেখে,
“তাজমহল ভারত তথা বিশ্বের এক অতুলনীয় সৌধ….তাজ দেখুন… এটি আপনাকে এত মোহিত করবে যে আপনি আপনার অনুভূতি প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাবেন না। এবং এই অপ্রকাশিত অনুভূতি মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সজীব থাকবে আপনার অন্তরে।”
এবার প্রেমিক শাহজাহানের কথা। মনোমুগ্ধকর এই সৌধের অলৌকিক চরিত্র প্রসঙ্গে বাদশা নিজেই লিখেছেন,
“কোনও অপরাধী এখানে আশ্রয় চাইলে তার দোষ খন্ডিত হয়, কোনও পাপী এই গৃহে প্রবেশ করলে তার সমস্ত পাপ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। এই সৌধ দর্শনে দুঃখের দীর্ঘশ্বাস নির্গত হয়, অশ্রু- বিসর্জন করে চন্দ্র এবং সূর্য, এই সৌধ সৃষ্টি কর্তার মহিমা প্রচারের জন্যই নির্মিত হয়েছে।”
(তথ্যসূত্র: Illustrated Agra Guide ছাড়াও আরও বহু গ্রন্থের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। পরিসরের কথা ভেবে সেগুলির নাম অনুল্লিখিত রয়ে গেল। এর জন্য লেখক ও প্রকাশকের কাছে লেখক আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।)