Celeb Talk

কানে হেমন্ত, মনে বসন্ত!

পড়ার চেয়ে খেলাধুলো, দুষ্টুমি, দস্যিপনা, ছেলেদের সঙ্গে মারপিট ছিল নিত্যদিনের রুটিন। পাড়ার বড়দের কাছে এজন্য কম বকা, কানমলা খেতে হয়নি তাঁকে।

এককথায় ডানপিটে বলতে যা বোঝায় তিনি তাই। উত্তর কলকাতার গ্রে স্ট্রিটের কাছে এক একান্নবর্তী পরিবারের মেয়ে। বর্ধিষ্ণু পরিবার। ঠাকুরদা ছিলেন ডাক্তার। মায়ের দাদু ছিলেন দীনবন্ধু মিত্র। ছোট থেকেই পড়ার চেয়ে খেলাধুলো, দুষ্টুমি, দস্যিপনা, ছেলেদের সঙ্গে মারপিট ছিল নিত্যদিনের রুটিন। পাড়ার বড়দের কাছে এজন্য কম বকা, কানমলা খেতে হয়নি তাঁকে। তাতে কি? বড়রা পেছন ফিরলেই ফের দুষ্টুমি শুরু। সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক। তারপর এক রকম পড়ার হাত থেকে রেহাই পেতেই মাধ্যমিক দিতে দিতে বিয়ে। এই হল বাংলা ছোট ও বড় পর্দার অতি চেনা মুখ তনিমা সেন। ‌যাঁকে একবার দেখলেই দর্শকদের প্রত্যাশার পারদ চড়ে, এই এবার এক প্রাণোচ্ছল হাসিতে মেতে ওঠা যাবে। তনিমা সেন এসে গেছেন!

না, অভিনয় জগতে আসবেন একথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি কোনোদিন। আর পাঁচটা বাচ্চার মত বাড়ির সামনে সাদা মার্বেল বাঁধানো রকে পর্দা টাঙিয়ে খেলা খেলা নাটক। ব্যস ওই পর্যন্তই। টার্নিং পয়েন্টটা এল বিয়ের পর পাড়ার পুজোয়। বিয়ে হয়ে তখন উত্তর কলকাতার বাপের বাড়ি ছেড়ে সল্টলেকের বউমা তনিমা। চিরকালই মিশুকে। তো সেবার পুজোয় প্যান্ডেলে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ মঞ্চস্থ হবে ঠিক হল। পাড়ার সকলেই অভিনয় করবেন। তা মূল চরিত্র নীতার ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য বেছে নেওয়া হল পাড়ার বউ তনিমা সেনকে। তখন সেই আনকোরা অবস্থায় তনিমার অভিনয় সকলকে মুগ্ধ করে। অভিনয় এতটাই ভাল হয়েছিল যে ‌যাঁরা প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখতে আসছিলেন তাঁরাও তাঁর অভিনয় দেখে দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন। অনেকে সেবার এমনও বলেছিল যে অন্য চরিত্রগুলো পাড়ার লোকজন করলেও নীতার চরিত্র করার জন্য ভাড়া করে পেশাদার অভিনেত্রী আনা হয়েছে।


সেই ছিল প্রথম চোখে পড়া। ইংরাজিতে একটা আপ্তবাক্য প্রচলিত। মর্নিং শোজ দ্যা ডে। সকালই বলে দেয় দিনটা কেমন যাবে। তনিমা সেনের জীবনে সেদিনের সন্ধ্যার অভিনয় তাঁর অভিনয় জগতে প্রবেশের সকালটা ঝলমলে করে দিয়েছিল। তখন সল্টলেকে তাঁর শ্বশুর বাড়ির পাশেই চ্যাটার্জীবাবু বলে একজন থাকতেন। তাঁরই অফিসের নাটক হবে। ‘রাজদর্শন।’ সেখানে অভিনয় করার জন্য তনিমা সেনকে অনুরোধ করলেন তিনি। কিন্তু বাড়ির বউ অফিস ক্লাবে অভিনয় করতে যাবে। এটা কেউই মেনে নিতে পারছিলেন না। এমনকি স্বামীও নয়। যাই হোক, কিছুদিন পর সবাই মেনে নেয়। এই রাজদর্শন নাটক মঞ্চস্থ হয় রঙমহল থিয়েটার হলে। সেখানে অনেকেই অভিনয়ের পর ফোন নম্বর নিয়ে নেয়। ব্যাস সেই যে চাকা ঘুরতে শুরু করেছিল, এখনও তা অব্যাহত। তনিমা সেনকে চেনেন না এমন লোক বাংলায় খুঁজে পাওয়া ভার।

অফিস ক্লাবে বছর দেড়েক চুটিয়ে অভিনয় করার পর ১৯৮৫ সালে সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে অভিনয় দিয়ে পেশাদার নাটকের জগতে প্রবেশ করেন তনিমা। স্টার থিয়েটারে সেই ‘বালুচরি’ নাটকে সুপ্রিয়া দেবীর বিপরীতে অভিনয় নিয়ে এখনও কথা বলতে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়েন তিনি। তখন সুপ্রিয়া দেবী তারকা। আর তিনি নিজে একজন নিউ কামার। ফলে একটা শিহরণ তো কাজ করবেই। তবে হ্যাঁ, মঞ্চে অভিনয় করার সময় তাঁর বিপরীতে কে, তা নিয়ে অত ভাবতেন না তনিমা সেন। নিজেই সেকথা স্বীকার করলেন তিনি। বালুচরিতে অভিনয়ের জন্য বাহবাও কম কুড়োননি তিনি।


এরপর একের পর এক ডাকসাইটে অভিনেতা অভিনেত্রীদের সঙ্গে অভিনয়। ‘কাঁচের পুতুল’-এ সাবিত্রী চ্যাটার্জীর সঙ্গে, ‘স্বীকারোক্তি’ আর ‘ঘরজামাই’-তে চিরঞ্জিতের বিপরীতে। ‘ঘরজামাই তো রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মঞ্চস্থ হয়। আর যেখানেই হত, সেখানেই যেতে হত দলের সঙ্গে। এমনিতে আমি বড় একটা বাইরে বাইরে ঘুরে অভিনয় পছন্দ করি না। তবে চিরঞ্জিতদা সাফ জানিয়েছিলেন, যদি তনিমা না যায় তাহলে ঘরজামাইয়ের শো হবে না। দলের ছেলেরাও ধরল না গেলে অনেক টাকার ক্ষতি। তাই চলে গেলাম।’ হাসতে হাসতে বললেন তনিমা সেন।

একসময় নিজের একটা নাটকের দল গড়েছিলেন। কিন্তু সে দল ভেঙে যায়। তনিমা সেনের নিজের মতে, দলের মধ্যে দলবাজিই শেষ করে দিল সেই উদ্যোগ। পরে নিজের লেখা একটা গল্প নিয়ে সিনেমা করার কথাও ভাবেন। কিন্তু হাসিখুশি খোলা মনের এই মানুষটির আক্ষেপ, অনেক চেষ্টা করেও প্রযোজক পাওয়া যায়নি। ‘বহু চতুর লোক এসেছে। বলতে দ্বিধা নেই এদের ধূর্ত বললেও কম বলা হয়। আমার নাম ভাঙিয়ে অন্য লোকের সঙ্গে কাজ করেছে, কিন্তু আমায় সিনেমা করায় সাহায্য করেনি।’ ক্ষোভের সুরেই বললেন বাংলা অভিনয় জগতের অন্যতম চেনা নাম তনিমা সেন।

অনেকেই অভিনেত্রী তনিমা সেনকে চেনেন। কিন্তু লেখক তনিমা সেনকে কত জন চেনেন? অনেকেই কিন্তু জানেন না তনিমা সেন খুব ভাল লেখেনও। অভিনয়ের পাশাপাশি লেখালিখিতেও তাঁর দক্ষতা তারিফের দাবি রাখে। তাঁর লেখা নাটক ‘স্বর্গের কাছে’ দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাঙালি অধ্যাপিকা। কুড়ি বছর পর কলকাতায় এসে নাটকটা দেখেন তিনি। নাটকটা দেখার পর তনিমা সেনকে তিনি বলেছিলেন, ‘কুড়ি বছরে কলকাতাটা অনেক বদলে গেছে। তবে এতদিন পর কলকাতায় এসে সারা জীবনের জন্য বুকে একটা সঞ্চয় নিয়ে ফিরলাম।’ তাঁর সেই কথা তনিমা সেনের এখনও কানে বাজে।

অনেকক্ষণ আড্ডা চলছে। নানা প্রসঙ্গ, নানা কথা। একটার পিঠে আর একটা প্রসঙ্গ উঠে আসছে। কিন্তু এই হাসিখুশি মানুষটার মধ্যেও যে একটা চাপা ক্ষোভ ফেটে বের হতে চাইছে তা বুঝতে পারলাম কিছুক্ষণ পর। এখন কি কাজ করছেন? কথাটা জিজ্ঞেস করতেই সেই ক্ষোভটা সুযোগ বুঝে গড়গড় করে বেরিয়ে এল তাঁর ভেতর থেকে। ‘এখন কম কাজ করছি, কম কাজ করছি, কারণ কম কাজ পাচ্ছি। আমি মানুষকে হাসাতে পারি ঠিকই। তবে আমি সিরিয়াস কাজও সমান দক্ষতায় করতে পারি। রামকৃষ্ণ মিশন আমাকে দিয়ে ভৈরবী চরিত্র করিয়েছিল। বহু মানুষের কাছে সেজন্য প্রশংসা পেয়েছি। তারপর ৫০ বছরের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দিল্লি থেকে মাতঙ্গিনী হাজরার চরিত্রে অভিনয় করার জন্য সারা ভারত থেকে ৭৫ জনের মধ্যে আমাকে বেছে নেওয়া হয়। হিন্দি উচ্চারণে কিছু ভুল ত্রুটি থাকলেও ওঁরা ডাবিং করেননি। পাছে অভিনয়টা কোনোভাবে প্রভাবিত হয়। এখনও প্রচুর শো পাই, সেখানে সকলে আমায় দেখতে ভালবাসেন। পরে বড় কোনও আর্টিস্ট থাকলেও আমার পিছন পিছন স্টেজের বাইরে পর্যন্ত আসেন। কথা বলেন। অথচ দেখুন আজকাল বাংলা সিরিয়ালে কাজ করতে গেলে নির্দেশক, প্রযোজকরা বলছেন আমার করার মত কোনও চরিত্রই নাকি নেই। এটা শুনতে না খুব খারাপ লাগে। ওনাকে দেওয়ার মত চরিত্র নেই বলে আসলে ওরা আমাকে কাটিয়ে যায়। আরও মজার ব্যাপার কি জানেন, ‌যাঁরা এগুলো বলছেন তাঁদের হাতেই এখন সব ক্ষমতা।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তনিমা। তারপর কিছুক্ষণ থেমে বললেন ‘আসলে কি জানেন, হয়তো আমিই ঠিক মানিয়ে নিতে পারছি না। আমি রাত জেগে শুটিং করতে পারি না। সবাই আজকাল কেমন রাত জেগে কাজ করছে। কিন্তু ও আমার দ্বারা হবে না। তাছাড়া দেখুন না, ‘সোনায় সোহাগা’ সিরিয়ালে অভিনয় করতে গিয়ে দেখলাম আগের পরিবেশটাও আর নেই। দেখলাম একটা কিছু নিজের মত করতে গেলেই নির্দেশক বলছেন এটা কেন? ওটা কেন? কিন্তু জিজ্ঞেস করুন, কেন এটা নয়, ওটা নয়! কিচ্ছু বলতে পারবে না। তাই কিছুটা সরে যাওয়া ছাড়া কিছু করাও ছিল না।’ যদিও এসবের পরও আশাবাদী তনিমা সেন। আগের মত ফের চুটিয়ে কাজ করার জন্য তিনি ডাক পাবেন, এ বিশ্বাস তাঁর আছে।

অবসর জীবনে রাঁধতে ভালবাসেন। মানে যাকে বলে ভীষণ ভালবাসেন। কোনও শুটিং সেরে বাড়ি ফিরেও রান্নাঘরে ঢুকে পড়েন তিনি। রান্নাটা তাঁর কাছে একটা নেশা। সিনেমা বানানোর মতই তাঁর স্বপ্ন, সুযোগ পেলে একদিন নিজের একটা রেস্তোরাঁ খুলবেন। আর ভালবাসেন বেড়াতে। সময় পেলেই গাড়ি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে। আর একটা জিনিস তাঁকে চুম্বকের মত টানে। সেটা হল মিষ্টি। নিজের সেই প্রাণখোলা হাসি হেসে তনিমা সেন বললেন, ‘জানেন আমি মিষ্টি খাওয়ার জন্য হাঁটি।’ প্রতিদিন নিয়ম করে ভোরে হাঁটেন তনিমা। হাঁটার সময় কানে গোঁজা থাকে হেডফোন। তাতে একটানা বেজে চলে রবীন্দ্রসংগীত অথবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। বেশ রসিকতার সুরেই হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি তো সকলকে মজা করে বলি, জানো তো, আমার কানে হেমন্ত আর মনে বসন্ত’!

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button