প্রাণোচ্ছ্বল এক নদীর কথা
বাংলা ভাষায় আবৃত্তি যতদিন বেঁচে থাকবে, যতদিন শ্রুতি নাটক বেঁচে থাকবে বাঙালির মনে, ততদিন এই নামটাও বেঁচে থাকবে সংস্কৃতিমনা বাঙালির অন্তরে।
বিশ্বাস করুন, একজন মানুষ যে এত সুন্দর করে কথা বলতে পারেন তা বোধহয় এই স্বনামধন্য মহিলার সঙ্গে কথা না বললে বুঝতেও পারতাম না। এমনিতে সাক্ষাৎকার নিতে গেছি। ফলে একটা আপাত দূরত্ব থেকেই যায়। কিন্তু সে দূরত্ব তাঁর সামনে বসে মুহুর্তে যেন কোথায় উধাও হয়ে গেল।
ঊর্মিমালা বসু। বাংলা ভাষায় আবৃত্তি নামক বস্তুটি যতদিন বেঁচে থাকবে, যতদিন শ্রুতি নাটক বেঁচে থাকবে বাঙালির মনে, ততদিন এই নামটাও বেঁচে থাকবে সংস্কৃতিমনা বাঙালির অন্তরে। কোনও গুরু নেই। নেই কোনও প্রথাগত তালিম। কেবল আবৃত্তির প্রতি ভালবাসা একটা মানুষকে কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ এই বাঙালি ব্যক্তিত্ব।
সচ্ছল পরিবারে জন্ম। পড়াশোনা ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে। স্কুলে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিতে জোড় দেওয়া হত। সেখানে কেউ গাইত গান, কেউ বা নাচত। ছোট্ট ঊর্মিমালার কিন্তু সবচেয়ে পছন্দের বিষয় ছিল আবৃত্তি। ‘হস্তিমশাই হস্তি মশাই কিসের এত রাগ’, একবার কবিতা বলতে বললেই হল। ছোট্ট মেয়েটি সানন্দে হাত-পা নেড়ে শুরু করে দিত কবিতা বলা। এই একটা কবিতা যে কতবার কত জায়গায় বলেছেন, তা তাঁর আর এই মধ্যবয়সে এসে মনে পড়ে না। তবে এটা বেশ মনে আছে, কেউ কবিতা বলার জন্য বললে কোনও ওজর আপত্তি নয়, কোনও লজ্জা নয়, এককথায় রাজি হয়ে যেতেন কবিতা শোনাতে।
আসলে প্রতিভা লুকিয়ে রাখা যায় না। আর প্রতিভার বিকাশ ঘটে ছোট্ট বেলা থেকেই। জীবনের বিভিন্ন মুহুর্তে কাউকে কিছু না জানিয়েই সে তার ডালপালা মেলে ধরে। বড় হয়ে বাচিক শিল্পী হবেন, এমন কথা ভাবার তখনও বয়স হয়নি। কিন্তু তখন থেকেই মায়ের মুখে রবীন্দ্রনাথের কবিতা শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে যেত ছোট্ট ঊর্মিমালার মন। নিজের অজান্তেই চোখে থেকে গড়িয়ে পড়ত জল। আর এভাবেই বোধহয় জীবনের কোনও এক সময়ে নিজের অজান্তেই নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল কবিতা।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তখন একা চলাফেরার ছাড়পত্র মিলেছে। ফলে শুরু হল শম্ভু মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী সব্যসাচী, প্রদীপ ঘোষ, পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষের মত দিকপালদের গলায় আবৃত্তি শোনা। ঊর্মিমালার মতে, এটা একটা দারুণ সময়। একটা বিরাট প্রাপ্তি। সেসময়ের সেসব নামিদামি মানুষদের গলায় আবৃত্তি শোনার সুযোগটাও একটা ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। আর ছিল বইমেলা। সেখানে কত প্রথিতযশা মানুষকে সামনে থেকে দেখা যেত। তাদের গলায় কবিতা শোনা যেত। ঊর্মিমালার মতে এটাও তাঁর একটা সৌভাগ্য।
পেশাগতভাবে আবৃত্তির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া বিয়ের পরই, অকপটে স্বীকার করলেন ঊর্মিমালা। জগন্নাথ বসুর মত গুণি শিল্পীকে স্বামী হিসাবে পাশে পাওয়া, তাঁর কাছে থাকা, জীবনটাই বদলে দিয়েছিল। প্রথাগত তালিম বলতে স্বামীর কাছে। তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করা, তাঁকে অনুসরণ করা এক সাধারণ মেয়েকে অসাধারণ করে তুলেছিল। নিজস্ব অস্তিত্ব তৈরির একটা ইচ্ছা ছিলই। সেই ইচ্ছাশক্তিই তাঁকে এগিয়ে যাওয়ার পথে অনেকটা সাহায্য করেছিল। তাঁর নিজের মতে, জগন্নাথ বসুর সঙ্গে একসঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারিত হওয়াও একটা প্রাপ্তি। এমন মানুষকে স্বামী হিসাবে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নেপথ্যে স্ক্রিপ্ট লেখা, স্বামীর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করা, অনেকটা সহকর্মীর মত, এটা তাঁকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।
কোনও মেকি স্বর বের করে আবৃত্তি করাকে ঘৃণা করেন ঊর্মিমালা। তাঁর মতে, সহজ স্বাভাবিকভাবে, নিজের বোধ দিয়ে উচ্চারণ করে একটা কবিতা পাঠই সঠিক কবিতা পাঠ। আর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, নিজের বোধ দিয়ে, অনুভব দিয়ে কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়েই উঠে আসে কবিতার আসল ভাবনা। ঊর্মিমালার আক্ষেপ, আজকাল এমন অনেকে শিখতে আসে যাদের মধ্যে প্রতিভা আছে, গলা আছে। কিন্তু বোধটার বড় অভাব। চটজলদি সাফল্যের শিখরে পৌঁছনোর বড্ড তাড়া। বরং যেটা দরকার, সেই ভাবনার লেশমাত্রও তাদের নেই।
তবে শুধুই বাচিক শিল্পী নয়, জগন্নাথ বসু-ঊর্মিমালা বসুর শ্রুতি নাটক এখন বঙ্গ সংস্কৃতির এক বড় পাওনা। এই দুটি নাম একসঙ্গে শ্রুতিনাটকে যে দিগন্ত এনেছে তা শুধু কলকাতা নয়, বিশ্বের প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে থাকা বাঙালির কাছেই সমান সমাদৃত। আর সেই কথাতেই এসে গেল পরিবারের কথা। আবৃত্তি হোক বা শ্রুতি নাটক, কলকাতা থেকে দেশের বিভিন্ন কোণা, এমনকি বিদেশেও বার বার যেতে হয়েছে তাঁকে। শো করতে হয়েছে। দিনের পর দিন বাড়ির বাইরে কাটাতে হয়েছে। আর এতে পরিবার যে কিছুটা হলেও বঞ্চিত হয়েছে, তাও মেনে নিলেন ঊর্মিমালা। তবে সেই পারিবারই আবার তাঁকে উৎসাহ দিয়েছে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য। সাফল্যের শিখরে পৌঁছেও ঊর্মিমালার কাছে প্রথমে তাঁর পরিবার, তারপর সবকিছু। পরিবারের ভালোর জন্য তিনি সব কিছু ছাড়তে পারেন। নির্দ্বিধায় স্বীকার করলেন, নিজের পেশায় এগিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর শ্বশুর বাড়ির অবদান অনস্বীকার্য।
কথা বলতে বলতেই সামনের টেবিলে রাখা আধবোনা সোয়েটারটা হাতে তুলে নিলেন ঊর্মিমালা। কথা বলতে বলতে চলল আঙুল। পরতে পরতে নিখুঁত ছন্দে এগোল হলুদ সোয়েটারের বুনন। আর এই সোয়েটার বোনার ফাঁকে ফের পুরনো দিনে ফিরে গেলেন ঊর্মিমালা। দুই দাদার পর জন্ম। ফলে বাড়িতে বড়ই আদরের। বাবা প্রাচুর্যে বিশ্বাস করতেন না। তবে দারিদ্র কাকে বলে তা কখনও বুঝতে হয়নি। বাবার মৃত্যুর পর জানতে পেরেছিলেন, সচ্ছলই নয়, বেশ ধনী ঘরেরই মেয়ে তিনি। পড়াশোনার জন্য প্রবল চাপ বাড়িতে কখনই ছিলনা। বরং ছিল ভালবাসার উত্তাপ। বড় দাদা একবার পরীক্ষায় খারাপ ফল করেছিল। বকাবকি দুরে থাক। বাবা বরং পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘একবার হয়নি তো কি হয়েছে, মন খারাপ না করে ভাল করে পড়, পরের বার ঠিক ভাল হবে।’ শুধু দাদা নন, একবার পরীক্ষার পড়া তেমন তৈরি ছিলনা। একটা, ঘরে দরজা বন্ধ করে খুব কেঁদে চলেছেন ঊর্মিমালা। ঘরে চলা একটা গানের কলি আরও মন খারাপ করে দিচ্ছে। এমন সময় একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলেন তিনি। বেশ বুঝলেন বাবা পাশে এসে বসেছেন। বললেন, ‘একটা মন ভাল করা গান শোন। ভাল লাগবে।’ সেই স্পর্শ আজও ভোলেননি তিনি।
তবে মায়ের কথা বলতে গিয়ে এক অন্য ঊর্মিমালাকে সামনে থেকে দেখলাম। মা ছিলেন সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ‘আমি যা করেছি তা মায়ের জন্য। আমি মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ’, বলার সময় গলাটা যেন একটু কেঁপে গেল। কথার পিঠেই কোনও প্রশ্ন করতে পারলাম না। মনে হল একটু সময় দেওয়া দরকার। সামলানোর সময়।
আপাদমস্তক ঘরোয়া ঊর্মিমালা কিন্তু বেশ ইন্টারনেট স্যাভি। কম্পিউটারে চ্যাট করার অভ্যাস আছে। সঙ্গে অবসর কাটানোর জন্য আছে গল্পের বই পড়া। আত্মীয় পরিজনের বাড়ি যাওয়ারও রেওয়াজ আছে। আর যেটা তাঁকে আনন্দ দেয় তা হল রান্না। রান্না করতে ভীষণ ভালবাসেন। ভালবাসেন রান্না নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে। নতুন রান্না করতে। একটা বাঁধাকপি রান্নার রেসিপিও কথায় কথায় বলে ফেললেন ঊর্মিমালা। আর যেটা বললেন তাতে বেশ অবাকই হলাম। ‘খুব স্ট্রেস পড়লে রিল্যাক্সড হওয়ার জন্য রান্না করি।’ রান্নাও যে চাপমুক্তির একটা উপায় হতে পারে তা ভেবে বেশ ভালই লাগল।
ছোটবেলার পছন্দ আবৃত্তি হলেও, ইদানিং শ্রুতি নাটকই তাঁর প্রথম পছন্দ। বললেন, ‘গলা নিয়ে খেলতে ভাল লাগে।’ ‘কাল তুমি আমার বাড়ি এসো।’ কথাটা অন্তত ছ’রকম ভাবে আমাকে বলে শোনালেন। মনে হল, সত্যিই তো, এভাবে তো কোনও দিন ভেবে দেখিনি!
গান শুনতে ভালবাসেন। সব ধরণের গান। নিজে ভাল গানও গান। গানের গলায় তালিমের ছাপ স্পষ্ট। বললেন বেশকিছুদিন গান শিখেছেন। আর সেই গানের সুবাদেই সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে আলাপ। সুচিত্রা মিত্রের সান্নিধ্য তাঁর সফল বাচিক শিল্পী হয়ে ওঠার পিছনে অনেকটা কাজ করেছে, কৃতজ্ঞতা স্বীকার ঊর্মিমালার। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘শিল্প থেকে বাড়তি ন্যাকামিগুলো বেরিয়ে গেছিল সুচিত্রাদির সঙ্গে মেশার পর।’ সুচিত্রা মিত্রের প্রভাব এখনও তাঁর জীবনে সুস্পষ্ট। বললেন, সুচিত্রাদিরা মারা যান না, তাঁদের মৃত্যু নেই।
এই মধ্যবয়সেও মনটা সবুজ রয়ে গেছে ঊর্মিমালার। অভিনয় নিয়ে কথা উঠতে বললেন, ‘এই বয়সে তো আর কেউ হিরোইন করবে না’! তবে কথায় কথায় বললেন, ‘বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা কোনও রোমান্টিক চরিত্র পেলে নিশ্চয়ই করবেন।’ বেশ একটা উচ্ছল হাসি ছড়িয়ে পড়ল ইতিহাসে জায়গা করে নেওয়া এই বাচিক শিল্পীর গোটা মুখ জুড়ে।
আধুনিক কিছু গায়কগায়িকাকে নিয়ে তাঁর বেশ অ্যালার্জি আছে। অতটা চাঁছাছোলা ভাবে না বললেও, সেই শ্লেষ তাঁর গলায় পরিস্কার। কটাক্ষের সুরেই হাসতে হাসতে বললেন, ‘আজকাল কয়েকজন শিল্পীর খুব নাম ডাক হয়েছে। কিন্তু তাদের গান না আমি কিছু বুঝতে পারিনা’!
একবার এক আসরে কবিতা পাঠ করছেন। রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান। ‘বোঝাপড়া’ কবিতাটা পড়ে শোনালেন ঊর্মিমালা। অনুষ্ঠানের শেষে হল থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ একটি মেয়ে এসে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। প্রাথমিক হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিলেন ঊর্মিমালা। এবার নিজেকে কিছুটা সামলে মুখ তুলল মেয়েটি। তারপর কান্না ভেজা গলায় ঊর্মিমালার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজ আপনি আমার জীবনটা অনেক হাল্কা করে দিলেন।’ ঊর্মিমালার মতো মানুষরা তো এভাবেই বেঁচে থাকেন মানুষের মনে, মননে। গলার যাদুতে শান্তির বারি বর্ষণ করে যান শুকনো মনের গভীরে। জীবনটাকে ফের নতুন করে বাঁচার রসদ দিয়ে যান। তাই না?