
নাটকের ছোট্ট দল। দলের নাম পূর্ব কলকাতা বিদূষক নাট্য মণ্ডলী। নাটকের দল তো অনেকই আছে। কিন্তু নানা দিক দিয়েই এই দলটির বিশেষত্ব। বিশেষত্বটা দলের দিক থেকে নয় দলের মুখিয়ার দিক থেকে। যিনি দিনে দু’বেলা দ্বৈতভূমিকায় অভিনয় করে চলেছেন। সকালে তিনি পাড়ার চাওয়ালা, বেলা গড়ালে তিনিই নাট্য পরিচালক। তিনি ৩৯ বছরের টগবগে যুবক অমিত সাহা। অমিত পেশায় একজন সর্বক্ষণের অভিনেতা। নেশাতেও তিনি অভিনেতাই। জি টিভি, স্টার, ই টিভি-সহ বেশ কিছু টেলিভিশন চ্যানেলে অমিত একাধিক টেলিফিল্মে ইতিমধ্যে অভিনয় করেছেন। থাকেন পূর্ব কলকাতার কাদাপাড়ায়। আসলে অমিত নিজেও একটি গল্প। ওঁর গল্পটাও জীবনের অন্যরকম একটা গল্প। এই অন্যরকম গল্পটা বলবার মতোই।
কাদাপাড়ার যে অঞ্চলে অমিতের বসবাস সেটি মূলত শ্রমজীবীদের এলাকা। ওড়িশা বা বিহার থেকে কাজের খোঁজে কলকাতায় আসা মানুষজন এখানে বসবাস করেন। অমিতের প্রতিবেশিদের কেউ কারখানার শ্রমিক অথবা ছোট ব্যবসায়ী কিংবা নিতান্ত খেটে খাওয়া মানুষজন। ছোটবেলা থেকে নুন আনতে পান্তা ফুরনো মানুষজনের জীবনের গল্প দেখতে দেখতে বড় হয়েছেন তিনি।
অমিতের বাবা অজিত সাহা একসময় ছিলেন স্থানীয় জুটমিলের কর্মী। পরে জুটমিলটি অতর্কিতে বন্ধ হয়ে গেলে দুই ছেলে ও স্ত্রীর ভরণপোষণের জন্যে পাড়াতেই একটি চায়ের গুমটি খোলেন অজিতবাবু। জুটমিলের গেটে তালা ঝোলার পরের বছরগুলিতে ওই চায়ের দোকানটিই অজিতবাবুকে গ্রাসাচ্ছাদনের পথ দেখিয়েছে। চা-দোকানটি প্রায় ২৫-২৬ বছরের পুরনো। এখনও সকাল-বিকেল চা-দোকান চালান অজিতবাবু। দোকানটি তাঁর পরিবারের লক্ষ্মী।
অমিত ছিলেন স্থানীয় গুরুদাস কলেজের ছাত্র। এখান থেকে বাণিজ্য শাখায় স্নাতক হয়েছেন ১৯৯৯ সালে। পাশ করার পর বিচিত্র রকমের চাকরি-বাকরি করেছেন। কখনও জুটমিলে শিক্ষানবিশ শ্রমিক হিসাবে কাজ করেছেন, কখনও ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করেছেন অথবা ডেলিভারি বয়ের কাজ। একসময় একটি বাংলা খবরের টিভি চ্যানেলে মেক আপ আর্টিস্টের চাকরিও করেছেন। ব্যক্তিগত জীবন সংগ্রামই অমিতকে বিভিন্ন মানুষ দেখার সুযোগ জুটিয়ে দিয়েছে।
নানা রকম কাজ করতে করতেই একসময়ে ঠিক করে ফেলেন অভিনয় ছাড়া আর কিছুই করবেন না। আত্মিক যোগ খুঁজে পাচ্ছেন অভিনয়তেই। অভিনয়কে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে ছেলেকে সর্বতোভাবে সমর্থন করেছেন অজিতবাবু। গত ২০ বছর ধরেই অমিতের পেশা বা নেশা যাই বলুন না কেন, সেটা শুধুমাত্র অভিনয়। তাঁর স্ত্রী বিউটিশিয়ানের চাকরি করেন। তিনিও অমিতকে তাঁর কাজটা মনোযোগ দিয়ে করবার জন্য প্রেরণা যুগিয়েছেন।
কাদাপাড়ায় অজিতবাবুর চায়ের দোকানে সকালের দিকে গেলে দেখা মিলবে অমিতের। সকালের দিকে কয়েক ঘণ্টা তাঁকে দেখা যাবে একজন সামান্য চা-দোকানির ভূমিকায়। আসলে প্রত্যেক মানুষের গোটা জীবনটাই তো অভিনয়। এই দুনিয়া হল আস্ত একটি রঙ্গমঞ্চ। সেখানে সকলেই এক-একজন কুশীলব। জীবনের রঙ্গমঞ্চে নিজের ভূমিকায় নিখুঁতভাবে অভিনয় করতে পারাটাই হল আসল কথা।
প্রতিদিন সকালে কাদাপাড়ায় বাবার ওই চায়ের দোকানটি চালান অমিত। চায়ের গ্লাসে চিনি গুলে খদ্দেরদের হাতে গরমাগরম চায়ের কাপ ধরিয়ে দেন। দামবাবদ গুনে নেন খুচরো পয়সা। খদ্দেরদের অনেকে জানেনও না যে তিনি আসলে একজন পেশাদার অভিনেতা। তবে ইদানিং অনেকে টিভিতে অমিতের অভিনীত ছবি দেখেছেন। তাঁরা চিনতে পারেন। ওঁদের কেউ কেউ অবাক হন। হয়তো বা ভালোওবাসেন।
পাড়ার চায়ের দোকানির নির্দেশিত নাটক নাট্য উৎসবগুলিতে অভিনীত হচ্ছে। দর্শকরা বাহবা দিচ্ছেন। সংবাদ মাধ্যমের কাছে এটি একটি দারুণ স্টোরি তো বটেই। টেলিফিল্মের পাশাপাশি অমিত বাংলা সিরিয়ালগুলিতেও অভিনেতা হিসাবে কাজ করছেন। তবে নিয়মিত কাজ নেই। এদিকে অমিত বিবাহিত। ৯ বছরের পুত্র সন্তানের পিতা। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা রয়েছেন। তাছাড়া, ৩৯ বছর বয়সে তাঁর পক্ষে নতুন করে চাকরি জোটানোও মুশকিলের। অমিতের কথায়, একদিন তো ভেবেছিলাম, চাকরি-বাকরি আমি করবই না। অভিনয় করেই জীবন চালাব। ওই শপথ আর ভঙ্গ করি কীভাবে? ফলে চা-দোকানই সই!
রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর আয়োজিত নাট্যমেলায় ইরানের লেখক সামাদ বাহারাঙ্গির ‘কালো মাছের গল্প’-তে অমিতের নির্দেশনার অভিনয় করেছেন যে সমস্ত কুশীলব – তাঁদের বয়স ১৯ থেকে ৩৫-এর ভিতর। কালো মাছের গল্পটার সঙ্গে নাট্য পরিচালক অমিতের জীবনের গল্পের প্রচুর মিলও রয়েছে। একটি ছোট্ট কালো মাছ একটি ঝর্ণার বাসিন্দা। সেই বাচ্চা কালো মাছটি ঝর্ণার শেষ দেখতে চায়। কিন্তু তাতে ঘোরতর আপত্তি রয়েছে তার মায়ের, পাড়াপ্রতিবেশিদের। একে তো সে নিতান্ত বাচ্চা, তারওপর দুনিয়া দেখা ব্যাপারটা রোগ ছাড়া আর কী! মাথায় ভূত চাপলে ওরকম সাধ জাগে! তাই সেই কালো মাছকে ঝর্ণার শেষ দেখতে সকলেই নিরুৎসাহিত করে। আর তার মায়েরও ওই এককথা, না বাপু, নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে অজানায় পাড়ি দেওয়ার সাধ আমাদের মতো কাউকে মানায় না। শেষপর্যন্ত কিন্তু কালো মাছের জেদের কাছে সকলেই হার মানলেন। আর সেই কালো মাছটি একাকী দুনিয়া দেখতে বার হল। নিজের চেনা গণ্ডি ছেড়ে দেখতে গেল কোথায় আছে এই ঝর্ণার শেষ। এই নাটকের উপজীব্য হল অজানার সন্ধানে পাড়ি দেওয়ার পরে বাচ্চা কালো মাছটি কী ধরনের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে সমুদ্রের দিকে চলেছে, তার গল্প। অর্থাৎ গল্পটি সম্পূর্ণভাবে অচেনা পথের অভিজ্ঞতার গল্প। পথে যেতে যেতে বাচ্চা কালো মাছটি নানান বিপদ-আপদের সম্মুখীন হল। সারস, হাঙ্গর কিংবা গাঙচিলের মতো ভয়ঙ্কর শিকারিদের বিপদ সম্পর্কে বাচ্চা কালো মাছকে পথে আলাপ হওয়া শুভানুধ্যায়ীরা বারংবার সতর্ক করে দিলেন। তাও শেষপর্যন্ত আত্মরক্ষা করতে পারল না কালো মাছটি। এক শিকারি গাঙচিলের পেটেই গেল সে। এত সত্ত্বেও একটি দায়িত্ব একাকী পালন করল সে। গাঙচিলের পেটের দুর্গন্ধময় অন্ধকারে আটকে থাকা আর একটি মাছকে সেই কালো মাছ কীভাবে নিষ্কৃতি দিল, সেও কালো মাছের গল্পের উপজীব্য। পরিচালক অমিত নিজেও সব ছেড়েছুড়ে নাটকের গল্পের বাচ্চা কালো মাছের মতোই দুনিয়াদারি করতে বেরিয়েছেন অভিনয়ের মাধ্যমে। এ জন্য বাস্তব জীবনে তাঁকে লড়তে হচ্ছে সাংসারিক টানাপোড়েনের সঙ্গে।
দলের সদস্যরা নানান পেশার সঙ্গে যুক্ত। কেউ চাকরি করেন, কেউ ফ্রিলান্সার, কারও কারও নিজস্ব ব্যবসা আছে। এমনকি দলের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন পুলিশ কর্মীও।
অমিত নিজে কোথাও প্রথাগতভাবে অভিনয় শেখেননি। বরং, তিনি দেখে শেখায় বিশ্বাসী। প্রিয় অভিনেতা বলতে বিশেষ কারও নাম করতে চাইলেন না। অমিতের কথায়, অনেকেই আমার প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষিকা। কলেজ শেষ হওয়ার পরে কিছুদিন রবীন্দ্রভারতীতে নাটক শিখতে ভর্তি হয়েছিলেন। গতানুগতিক পদ্ধতিতে ক্লাস করতে তাঁর ভাল লাগেনি। তাই তিন মাস বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের পরে ও পথ আর মাড়াননি।
গায়ক অথবা ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন অমিত। গানের গলা তাঁর নেই। একসময়ে ফুটবলটা ভালোই খেলতেন। আসলে কোনও না কোনওভাবে একজন পারফর্মার হিসাবে বরাবর আত্মপ্রকাশ করার স্বপ্ন দেখেছেন। শেষপর্যন্ত নাটকই টানল তাঁকে। কেমন সেই টান? হাসতে হাসতে অমিত জানালেন, সেটা ভাষায় প্রকাশ করাটা বেজায় কঠিন। ভালোবাসার টান ভালোবাসার মতোই অনির্বচনীয়। এ যেন ওই বাচ্চা কালো মাছটার মতন। যে অচেনার টানে ঘর ছাড়ে, বিপদ-আপদকে মোটেও ডরায় না। যত বিঘ্নবিপদ চোখরাঙাক কেউ কেউ সত্যিসত্যিই বরাবরের মতো জেগে থাকতে চান। তাঁদেরই একজন বোধহয় অমিত। খদ্দেরদের চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বিনিময়ে খুচরো পয়সা গুনে নেওয়ার যে প্রাত্যহিক জীবন যাপন করেন অমিত, সে পাট তো শুধু নিজের শিল্পীমনকে চাঙ্গা রাখতেই।