প্রেমিকা, বাবা ও মায়ের হত্যাকারী উদয়ন দাসকে সাজা শোনাল আদালত
২০১৭ সালে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল সিরিয়াল কিলার উদয়ন দাসকে নিয়ে। প্রেমিকা, বাবা ও মাকে হত্যা করেছিল সে। উদয়নকে বুধবার সাজা শোনাল আদালত।
কলকাতা : বাঁকুড়ার মেয়ে আকাঙ্ক্ষা শর্মাকে প্রেমের জালে জড়িয়ে ভোপালে নিয়ে যায় উদয়ন দাস। সেখানে ২ জনে থাকতেও শুরু করে। কিন্তু উদয়নের আসল রূপ জানতে পেরে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেন আকাঙ্ক্ষা। যা বোঝার পর একদিন আকাঙ্ক্ষা শর্মাকে হত্যা করে উদয়ন। তারপর বাড়িতেই তার দেহ রেখে তার ওপর বেদী বানিয়ে ফেলে। সেই ঘটনা সামনে আসার পর দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। সেই উদয়ন দাসকে বুধবার সাজা শোনাল বাঁকুড়ার ফাস্ট ট্র্যাক আদালত। গত মঙ্গলবার তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল আদালত। এদিন তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা শোনায় আদালত।
ফেসবুকেই আলাপ হয় আকাঙ্ক্ষা শর্মার সঙ্গে উদয়ন দাসের। উদয়ন নিজেকে মার্কিন মুলুকে ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কর্মরত বলে দাবি করেছিল তাঁর কাছে। আকাঙ্ক্ষা তাতে মুগ্ধ হন। উদয়ন তাঁকে ইউনিসেফ-এ কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে। শুধু বলেই না তাঁকে ইউনিসেফ-এর চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারও পাঠায়। আকাঙ্ক্ষাকে দিল্লি চলে আসতে বলে। সেইমত আকাঙ্ক্ষা শর্মা পৌঁছন দিল্লি। সেখান থেকে ভোপালে উদয়নের ফ্ল্যাটে ওঠেন তিনি। এরমধ্যে অবশ্য আকাঙ্ক্ষা জেনে গিয়েছিলেন যে তাঁর ওই ইউনিসেফ-এর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ভুয়ো।
তা সত্ত্বেও উদয়নের সঙ্গে লিভইন চালিয়ে যান তিনি। তবে ক্রমে উদয়নের আসল রূপ তাঁর সামনে আসতে থাকে। এ সবই হয় ২০১০ সালে। বাড়ির সঙ্গে আকাঙ্ক্ষা শর্মার যোগ থাকলেও তা ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসে। অবশেষে উদয়ন দাসের কুকীর্তিতে ক্লান্ত হয়ে আকাঙ্ক্ষা বাঁকুড়া ফেরার ট্রেনের টিকিটও কেটে ফেলেন। তারপর তাঁর আর খোঁজ ছিলনা। যদিও উদয়ন বাঁকুড়ায় আকাঙ্ক্ষার পরিবারকে বুঝিয়ে যায় যে তাঁদের মেয়ে ভাল আছেন। তিনি আমেরিকায় চাকরি করছেন। সেখানেই আছেন। পরে সন্দেহ হওয়ায় বাঁকুড়া পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করে আকাঙ্ক্ষা শর্মার বাবা। তদন্তে নামে পুলিশ।
তদন্তে নেমে আকাঙ্ক্ষা শর্মাকে খুঁজতে তাঁর মোবাইল লোকেশন দেখে ভোপালে হাজির হয় বাঁকুড়া পুলিশ। তারপর স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতায় উদয়নের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বেদীটি দেখতে পায় তারা। সেই বেদী ভাঙতেই বেরিয়ে আসে আকাঙ্ক্ষা শর্মার দেহ। উদয়নকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে ট্রানজিট রিমান্ডে বাঁকুড়া নিয়ে আসা হয়।
আকাঙ্ক্ষা শর্মাকে সেই খুন করেছে। বাঁকুড়া আদালতের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে দাঁড়িয়ে একথা কবুলও করে উদয়ন দাস। তাকে আদালতে পেশ করা হলে উদয়নের আইনজীবী তাঁর মক্কেলের জামিনের জন্য আবেদন জানান। কিন্তু কয়েকটা কথার পরেই উদয়ন জানায় সে-ই আকাঙ্ক্ষাকে খুন করেছেন। জামিন নিতেও অস্বীকার করে সে। এরপর তার গোপন জবানবন্দি দেওয়ার কথা শোনার পর তাতে সম্মতি দেন বিচারক। জানান, তৃতীয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এই জবানবন্দি গ্রহণ করবেন।
শুধু আকাঙ্ক্ষা শর্মাকে খুন করাই নয়, উদয়নের মধ্যে ছিল একটা সিরিয়াল কিলার। আকাঙ্ক্ষাকে খুন করার আগে নিজের বাবা-মাকে ২০১০ সালে খুন করে বাড়ির বাগানে পুঁতে সেখানে বেদী বানিয়ে দিয়েছিল উদয়ন। এই চাঞ্চল্যকর স্বীকারোক্তির পর উদয়ন সত্যি বলছে কিনা তা যাচাই করতে তাকে নিয়ে ছত্তিসগড়ের রায়পুরে সুন্দরনগরের বাড়িতে উপস্থিত হয় পুলিশ। উদয়ন দেখিয়ে দেয় বাবা-মাকে কোথায় পুঁতেছিল সে। শুরু হয় খোঁড়াখুঁড়ি। আর তারপরই সকলকে চমকে দিয়ে বার হতে থাকে একের পর এক কঙ্কালের টুকরো। মাথার খুলি, হাড়গোড়, ব্যাগ, প্যান্টের মত বেশ কিছু জিনিস উদ্ধার হয়। উদ্ধার হয় একটি ছুরিও। যত খোঁড়া হতে থাকে ততই দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকে সর্বত্র। পুলিশ সূত্রের খবর, উদয়ন পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে ২০১০ সালে তার মায়ের সঙ্গে তার জীবনযাপন নিয়ে ঝগড়া বাঁধে। সেই ঝগড়ার জেরে একদিন সে মাকে গলা টিপে খুন করে পাশের জমিতে পুঁতে দেয়। তখন তার বাবা বাড়িতে ছিলেন না। ফিরে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতে উদয়ন বিপাকে পড়ে যায়। তখন সে বাবার চায়ে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাঁকে নিস্তেজ করে দেয়।
মায়ের মত একই কায়দায় গলা টিপে খুন করে নিজের বাবাকে। পুঁতে দেয় মাকে যেখানে পুঁতেছিল তার পাশেই। সেখানে বেদী মত তৈরি করে পুজোও করত। আবার ব্যাঙ্কে কোনওভাবে ব্যবস্থা করে ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন পুলিশ কর্তা তার মায়ের পেনশন সে নিজের পকেটে পুরতে থাকে। বেশ কিছুদিন সেখানে থাকার পর ভোপালে তাদের কেনা ফ্ল্যাটে চলে আসে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করতে না পারা উদয়ন দাস। এখানে থাকতেই বাঁকুড়ার মেয়ে আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে সে। তাও ফেসবুকে। এরপর আকাঙ্ক্ষার ঘর ছেড়ে তার কাছে চলে আসা। লিভইন করা। এবং তার হাতে আকাঙ্ক্ষার খুন হওয়া। অবশেষে নিখোঁজ আকাঙ্ক্ষার খোঁজে তদন্তে নেমে সবকিছু সামনে আসে পুলিশের। বেরিয়ে পড়ে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে! ব্যাঙ্ক থেকে কি করে মাসের পর মাস মৃত মায়ের পেনশন উদয়ন তুলে নিত তা নিয়েও তদন্ত শুরু করে রায়পুর পুলিশ।
বাবা-মা ও প্রেমিকা আকাঙ্ক্ষাকে খুন করে নিজের কুকর্ম ঢাকার কম চেষ্টা চালায়নি উদয়ন। সেই কুকর্ম ঢাকতে ফেসবুককে কাজে লাগিয়েছিল সে। পুলিশ জানতে পারে আকাঙ্ক্ষাকে খুন করার পরও ফেসবুকে আকাঙ্ক্ষার হয়ে নিজে পোস্ট করত উদয়ন। সেখানে কখনও থাকত দামি গাড়ি কেনার কথা, কখনও তাদের সুখী জীবনের কথা। সবমিলিয়ে আকাঙ্ক্ষা কত সুখে আছে তা উদয়ন জাহির করত আকাঙ্ক্ষা সেজে। অন্যদিকে নিজের ফেসবুকেও দামি দামি গাড়ির ছবি, উচ্চমার্গের জীবন দর্শনের বাণী, কোনও কিছুই বাদ দেয়নি উদয়ন দাস। যদিও এতকিছু করেও শেষ রক্ষা হয়নি। আকাঙ্ক্ষার খোঁজ করতে গিয়ে উদয়নের একের পর এক কুকীর্তি পুলিশের সামনে এসেছে। যা দেখে বারবার চমকে উঠেছেন দুঁদে পুলিশ অফিসারেরাও।