ছোট থেকেই বন্ধু ছিলনা উদয়নের। অনেক সময় বন্ধুরা খেপাত। ফলে বন্ধুদের কিছু করে দেখিয়ে দেওয়ার কথা তার মাথায় ঘুরত। অঙ্ক বা বিজ্ঞানও তার ভাল লাগত না। কিন্তু বাবা-মায়ের চাপে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে হয়। বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেও ভর্তি হতে হয়। কিন্তু সেখানে দ্বিতীয় সেমেস্টারও উৎরোতে পারেনি সে। কিন্তু সেকথা ঘুণাক্ষরেও বাড়ির কাউকে জানতে দেয়নি। বরং পড়ার জন্য বাড়ি থেকে নিয়মিত টাকাপয়সা নিত উদয়ন। বাবা হাওড়ার বাসিন্দা। পেশাগত কারণে বাইরে থাকতেন। ফলে জন্মসূত্রে উদয়ন বাঙালি হলেও পড়াশোনা সবই ভোপালে। এদিকে একদিন সব জানাজানি হয়ে যায়। ধরা পড়ে যায় উদয়ন। বাবা-মা জানতে পারেন উদয়ন পাশই করেত পারেনি। তারপর থেকেই দিবারাত্র অভিভাবকদের কাছ থেকে গঞ্জনা শুনতে হত উদয়নকে। এভাবে চলতে চলতে একদিন সে ভেবে দেখে যদি বাবা-মাকেই খুন করে দেওয়া যায়, তাহলে বাবা-মার প্রচুর অর্থ সম্পত্তি সবই তার হয়ে যাবে। আবার কেউ বকাঝকা করারও থাকবে না। এসব ভেবেই ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে ২০১০ সালে বাবা-মাকে খুন করে তাঁদের দেহ রায়পুরে তাদের বাড়ির বাগানে ৮ ফুট গভীর গর্ত করে পুঁতে দেয় সে। তারপর সেখান থেকে চলে আসে ভোপালে। বাবা-মায়ের টাকাকড়িও নিজের নামে করে ব্যবহার করতে শুরু করে। এইসময় থেকেই এসকর্ট সার্ভিসের প্রতি আসক্তি বাড়তে শুরু করে তার। এজন্য বিদেশেও পাড়ি দিয়েছিল উদয়ন। নারীর নেশা উদয়নকে এমনভাবে পেয়ে বসেছিল যে দেশের বিভিন্ন শহরেও এজন্য নিয়মিত যাতায়াত করত সে। এভাবে ক’বছর চলার পর এক সময়ে ট্যাঁকে টান পড়ে উদয়নের। তখন সে ভাবে তার একটা স্টেডি গার্লফ্রেন্ড দরকার। সেইমত ২০১৪ সালে বাঁকুড়ার তরুণী আকাঙ্ক্ষা শর্মার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রসঙ্গত ২০০৭ সাল থেকেই সে আকাঙ্ক্ষাকে চিনত। আলাপ হয়েছিল অরকুটে। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আবার ২০১৪ সালে সোশ্যাল মিডিয়া মারফত সে আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আলাপ শুরু করে। এবার দ্রুত তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়ে যায়। উদয়ন আকাঙ্ক্ষাকে জানায়, সে আমেরিকায় রাষ্ট্রপুঞ্জে কর্মরত। আকাঙ্ক্ষাকেও ইউনিসেফে কাজ পাইয়ে দেবে সে। একসময়ে সে আকাঙ্ক্ষাকে ভুয়ো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারও পাঠায়। সেই দেখে আকাঙ্ক্ষা বাড়ি ছেড়ে কার্যত সকলের অমতেই বেরিয়ে চলে আসে দিল্লি। সেখানে উদয়ন তার সঙ্গে দেখা করে। জানায়, আমেরিকা যেতে এখনও ২ দিন দেরি আছে। তাই সেই ২ দিন আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ভোপালের বাড়িতে কাটাতে চায় সে। আকাঙ্ক্ষাও তাতে রাজি হয়ে যায়। ভোপালে সেই ২ দিন কাটার পরও উদয়ন যাওয়ার উচ্চবাচ্য করছে না দেখে সন্দেহ হয় আকাঙ্ক্ষার। এটাসেটা বলে প্রথমে কাটানোর চেষ্টা করলেও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে পরে ঝগড়া হতে শুরু করে। এই সময়েই আকাঙ্ক্ষা একদিন হঠাৎই উদয়নের বাবা-মায়ের পাসপোর্ট আর তাদের ডেথ সার্টিফিকেট হাতে পেয়ে যায়। উদয়নকে চেপে ধরে সে। উদয়ন বলেছিল তার বাবা-মা আমেরিকায় থাকে। তাই যদি হবে তবে তাঁদের পাসপোর্ট এখানে কেন? ডেথ সার্টিফিকেটেরই বা মানে কী? এসব প্রশ্নের কোনও জবাব দিতে পারেনি উদয়ন। আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারে উদয়নের বোনা জালে সে ফেঁসে গেছে। তাই তখন দ্রুত পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু উদয়ন তাকে কার্যত গৃহবন্দি করে রাখে। এরমাঝেই একদিন প্রবল ঝগড়ার মাঝে আকাঙ্ক্ষাকে গলা টিপে খুন করে উদয়ন। হয়তো সে মারতে চায়নি। কিন্তু সেই যে তার বাবা-মাকে খুন করেছে সেকথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই আকাঙ্ক্ষাকে সরিয়ে দেয় সে। তারপর আকাঙ্ক্ষার দেহ একটা টিনের বাক্সে ভরে নিজে হাতেই সিমেন্ট কিনে তার ওপর বেদি বানিয়ে পুজো শুরু করে। এদিকে মেয়ের কোনও খবর না পেয়ে আকাঙ্ক্ষার পরিবার পুলিশে খবর দেওয়ার পর পুলিশ খোঁজ শুরু করে। মোবাইল নম্বর ট্রেস করে দেখা যায় তা ভোপালে গিয়ে স্থির হয়ে গেছে। এদিকে উদয়নের কথা জানত শর্মা পরিবার। সে যে ভোপালে থাকে তাও পুলিশকে জানান তাঁরা। পুলিশ হানা দেয় উদয়নের বাড়িতে। সেখানে উদ্ধার হয় আকাঙ্ক্ষার মোবাইল। পুলিশি জেরার মুখে উদয়ন বেদী দেখিয়ে জানায় সেখানেই সে আকাঙ্ক্ষাকে পুঁতে রেখেছে। বেদী ভেঙে লাশ বার করার পর দিদির গলার হার দেখে তার দেহ শনাক্ত করে আকাঙ্ক্ষার ভাই। এরপর জেরায় উদয়ন স্বীকার করে নেয় বাবা-মাকে হত্যার কথা। এদিন বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বিস্তারিতভাবে উদয়নের এই স্বীকারোক্তির কথা তুলে ধরেন। এদিন সাংবাদিকদের সামনে একবার আনাও হয় উদয়নকে। ঝকঝকে পোশাকের উদয়নকে দেখে নির্বিকারই ঠেকেছে। বাঁকুড়া পুলিশ মনে করছে আকাঙ্ক্ষার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ৭০ হাজার টাকা পড়ে আছে। কোনও অর্থের লোভ নয়, বাবা-মাকে খুনের কথা যাতে বাইরে না যায় সেজন্যই আকাঙ্ক্ষাকে খুন করে উদয়ন। উদয়ন দাস নিজেই ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে গোপন জবানবন্দি দিতে চেয়েছে। তাই আগামী বুধবার উদয়নকে আদালতে পেশ করে এবিষয়ে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্রের আবেদন জানাবে পুলিশ। আদালত ছাড়পত্র দিলে সে গোপন জবানবন্দি দিতে পারবে। এরপর রায়পুর পুলিশ তাকে সেখানে নিয়ে যাবে তদন্তের স্বার্থে।